গত বছরের ৭ অক্টোবর একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের হাতে রাতভর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাওয়া বুয়েট শিক্ষার্থী ফাহাদ আবরারের হত্যাকাণ্ডও তেমনি একটি বিষয়। এ হত্যাকাণ্ডে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তাৎক্ষণিকভাবে হত্যায় সম্পৃক্ত সন্দেহে আটক করা হয় সন্দেহভাজনদের এবং সেই সঙ্গে বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়।
দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করে ফেনীর নুসরাত হত্যার বিচার সম্পন্ন হলেও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী থাকা সত্ত্বেও এ হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হওয়ার সৌভাগ্য এখনো জাতির চোখে পড়েনি। আদৌ কতটা পড়বে সেটা ভবিষ্যতই বলে দেবে।
দুই.
এ বছরের ১১ মে বিকাল ৪টায় উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরে এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়, পরে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে তার পরিচয় শনাক্ত হয়, তিনি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন। ইনি কিছুদিন আগেই কিছুটা আলোচিত হয়েছিলেন দুর্নীতির সঙ্গে আপস না করায় ওএসডি হয়ে। আর এবার আলোচিত হলেন দুর্নীতি ও অসদুপাইয়ের বিরুদ্ধে আপসহীন পথ থেকে চিরতরে ওএসডি হয়ে। যে পথে ওএসডি হলে আর ফেরা যায় না।
প্রকৌশলী দেলোয়ার বুঝেছিলেন, এই পথে তিনি বেশিদিন চলতে পারবেন না। আর তাই দেশের প্রধান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই মেধাবী ও সৎ প্রকৌশলী চাকরির জটিল পথ ছেড়ে ব্যবসার চিন্তার কথা প্রায়ই বলে আসছিলেন পরিবারের সদস্যদের কাছে। এমন বড় ও লোভনীয় পদে থেকেও কতটা হতাশ হলে চাকরি ছেড়ে ব্যবসার চিন্তা করা যায়, তা হয়তো তার মতো ব্যক্তিত্ববান সৎ কর্মকর্তা ছাড়া আর কারো পক্ষে বোধগম্য হওয়া সম্ভব নয়। সৎ ও নির্লোভ ব্যক্তিদের জন্য পৃথিবীতে চলা সত্যিই যে কঠিন সেই বার্তাই হয়তো জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন দেলোয়ার। এতে কারো না কারো লাভ তো হয়েছেই তবে ক্ষতিটা হয়ে গেলো এই অভাগা জাতির। এই দুষ্টে ভরা ঘূণে ধরা সমাজে আরও দশজন সৎ কর্মকর্তা হওয়ার বাসনা থাকলেও তারা নিজের আর পরিবারের চিন্তা করে এবং দেলোয়ারের পরিণতি ভেবে হত্যাকারী দুর্নীতিবাজদের কথায় হয়তো তাদের কলম সৎ পথে আগাবে না, চরম লুটেরাদের বিলের ফাইলও টেবিলে পড়ে থাকবে না সদুত্তরের আশায়। 'জ্বী হুজুর' হয়ে তাদের সাথেই হয়তো হাত মিলিয়ে পরিবার রক্ষা করে গোবেচারার মতো জীবন কাটাবে ভৌত কাঠামোর এই উচ্চ শ্রেণীর কর্মকর্তারা অথবা ঠুনকো দেশপ্রেম কে আঁকড়ে না ধরে উন্নত বিশ্বের বিলাস জীবনে পাড়ি জমাবেন। আর আমরা হয়তো তাদের নিমোকহারাম বলে কয়েকদিন গালাগালি করে থেমে যাবো। এভাবেই একদিন মেধাশূন্য অসৎ কর্মকর্তায় ভরে উঠবে আমাদের পেশাদার সমাজ।
তিন.
বুয়েট শিক্ষার্থী ফাহাদ আবরার প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াশোনা করলেও তার চিন্তা চেতনার পরিধি সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিদ্যা চর্চাও তার দখলে ছিল, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া পোস্টগুলো থেকেই অনুমেয়। একই সাথে তার দেশ নিয়ে ভাবনার গভীরতা ছিল অন্যদের থেকে আরও গভীরে। তার এই দেশপ্রেমই হয়ে উঠেছিল তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের কারণ। যে সময় গণতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক চলছে, প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন, কার্যত যেখানে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলার কেউ নেই, সেখানে গঠনমূলক সমালোচনা করাই ছিল আবরারের মতো সাধারণ শিক্ষার্থীর অপরাধ। প্রকৌশল বিদ্যা পড়ে এত দেশপ্রেম অনেকেরই সহ্য হলো না। আর তাই জীবন দিতে হলো একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে।
ঠিক একইভাবে প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে যিনি স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, তিনিও দেলোয়ারের সহকর্মী। তিনিও একজন প্রকৌশলী। 'কাকের মাংস কাকে খায় না' বলে যে প্রবাদ প্রচলিত তা আমাদের মানব সমাজের জন্য আর প্রযোজ্য নয়। আবরার বা দেলোয়ারের সহপাঠী বা সহকর্মীরা সেটাই প্রমাণ করেছে। দুজনের একই পরিণতি হয়েছে বলতে গেলে একই কারণে। দুজনেই দেশের স্বার্থ দেখেছিলেন, দুজনেই তাদের সৎ চিন্তাকেই এগিয়ে রেখেছিলেন।
আবরারের জন্য তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে দ্রুত বিচার ও আসামিদের গ্রেফতারে অবদান রাখলেও দেলোয়ারের সহকর্মীদের কোনো তৎপরতা এখনো চোখে পড়েনি এবং পেশাদারিত্বে এটা খুব বেশি দেখাও যায় না। আবরারের হত্যাকারীরা ছিল সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের পদাধিকারী নেতা আর এখানে তার সহকর্মী ও তার ভাড়াটে খুনিরা কোন দলের বা মতাদর্শের বিশ্বাসী তা তদন্ত শেষে হয়তো জানা যাবে। তদন্ত সঠিক হলে হয়তো জানা যাবে কারা বা কেনইবা তাকে ওএসডি করা হয়েছিল কাদের সুবিধার্থে। কিন্ত আমাদের সিদ্ধহস্ত তদন্ত কমিটি যে সময় তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন, ততদিনে আরও হাজার খানেক নতুন ইস্যুতে সয়লাব হয়ে হারিয়ে যাবে ফাহাদ আবরারের মত দেলোয়ার হত্যাকাণ্ডও।
৪.
সারা পৃথিবী যখন কভিট-১৯ এ আক্রান্ত, তখন খুনি পিপিই পরে নিরাপত্তা নিয়েই খুন করলেন প্রকৌশলী দেলোয়ারকে। ঠিক একইভাবে সারাদেশব্যপী যখন তারুণ্যের মুক্তিযুদ্ধ চেতনা ও দেশপ্রেমের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছিল, ঠিক তখনই দেশের স্বার্থের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জীবন দিতে হয় তরুণ আবরারকে।
আমরা যদি এভাবে দেশপ্রেমিক ও সৎ ব্যক্তিদের কদর না করি, তাদের হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচারের দাবিতে তৎপর না হই, তাহলে অনিক সরকারের মতো অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী গুগল, মাইক্রোসফটে চাকরি নিয়ে দেশ ছেড়ে ইউরোপ আমেরিকায় পাড়ি জমাবে। এভাবেই দেশ মেধাশূন্য করে বিদেশে পাড়ি জমাবে দেশের অর্থে পড়াশোনা করা ডাক্তার বা অন্যান্য পেশাজীবীরা। তখন হাজার উন্নয়নের ছবি চোখে ভাসলেও আমাদের চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতে হবে উন্নত বিশ্বের কাছে এসব মেধাবীদের কিনে আনতে। তাই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক ফেনীর নুসরাত হত্যার বিচারের মতো দ্রুত সময়ে।
আমরা চাই না, তনু, ত্বকী বা সাগর রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের মতো আবরার বা দেলোয়ার হত্যাকাণ্ডের বিচারও হারিয়ে যাক নতুন আলোচনার ভীড়ে। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলির ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক 'দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন'। আমাদের মেধাবী সম্পদেরা নিরাপদ আবাসন গড়ে তুলুক আমাদেরই চারপাশে।
লেখক: কবি ও নাট্যকার
[email protected]