তবে বেশিরভাগ লেখা ভাবাবেগ দোষে দুষ্ট বা অনুমান নির্ভর। আসলে বিতর্ক হচ্ছে দুটি বিষয় নিয়ে।
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আমি কিছু তথ্য উপস্থান করতে চাই। এই ক্ষেত্রে আমি প্রতিবেশী ভারত বা পাকিস্তানের উদাহরণ না টেনে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ টানবো।
চীনের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা মান্দারিন ভাষায় হয় ‘Guako’। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ৮৬টি কেন্দ্রীয় সংস্থা ও ২৩টি সংযুক্ত দফতরের নিয়োগ অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১.৪৪ মিলিয়ন পরীক্ষার্থী। চীনে সিভিল সার্ভিসের চাকরিকে ‘Iron Rice Bowl’ বলা হয়। চাকরির নিরাপত্তা ও উচ্চ বেতনের জন্য এই নামকরণ করা হয়েছে।
পরীক্ষার বিষয়বস্তু ঠিক অনেকটা আগের মতোই। যেমন: চাইনিজ অ্যাফেয়ার্স, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, গাণিতিক যুক্তি, প্রভৃতি। ২০১৮ সালে ২৪ হাজার পদের বিপরীতে পরীক্ষা দেয় প্রায় ১.৪ মিলিয়ন। এর অর্থ প্রতি ৬০ জনের ১ জন নিয়োগের সুযোগ পাবেন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকারি চাকরি পাওয়ার ইচ্ছা আরও প্রবল। এই করোনার সময়েও প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার চাকরি প্রত্যাশী কোরিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য বসেছে। এক জরিপে দেখা যায়, কোরিয়ায় প্রায় প্রতি ৪ জনে ১ জন সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহী।
সুতরাং সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে। এর কারণ হিসেবে সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে চাকরি হারানোর ভয়, সামাজিক চাপ বা ব্যক্তিগত ইচ্ছাও রয়েছে। সুতরাং আমাদের দেশে কেনো এতো প্রার্থী সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে তা নিয়ে এতো চুলচেরা বিশ্লেষণ অপ্রয়োজনীয়।
দ্বিতীয় প্রশ্বের উত্তরে যাওয়ার পূর্বেই আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদ সবাইকে পড়ার জন্য অনুরোধ করবো। বাংলাদেশের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে তার ইচ্ছা মাফিক বৈধ কোনো পেশা নির্বাচনের অধিকার দিয়েছে। সুতরাং ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়াররা কেনো সাধারণ ক্যাডারে আসছে এই প্রশ্নই অবান্তর।
এখন আমি এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন সার্ভিসের উদাহরণ দিচ্ছি। এই সার্ভিসে প্রবেশের ক্ষেত্রে সব পরীক্ষার্থীকে ‘FSOT’ পরীক্ষা দিতে হয়। ‘FSOT’ বা Foreign Service Officer Test নামের পরীক্ষাটিতে অংশগ্রহণের জন্য কোনো বিষয়ের বাধ্যবাধকতা এমনকি নূন্যতম কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার উল্লেখ থাকে না।
যুক্তরাষ্ট্রে জিওলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা অর্থনীতির অনেক ছাত্রও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন সার্ভিসের মান কমছে বলে শোনা যায়নি। আমাদের দেশে টেকনিক্যাল বিষয় থেকে জেনারেল সার্ভিসে আসার ট্রেন্ডকে স্বাগত জানানো উচিত। কারণ জেনারেলিস্ট সার্ভিসে এই টেকনিক্যাল বিষয়গুলো থেকে আসা গ্র্যাজুয়েটরাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময় দেশকে পথ দেখাবেন।
আবার প্রত্যেক পেশার আলাদা ডাইমেনশন ও স্কোপ আছে। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের প্রায় সকল সিভিল সার্ভিসেই জেনারেলিস্টদের একটু দাপট থাকেই। উদাহরণ হিসেবে Singapore Administrative Service এর উদাহরণ দেয়া যায়। সিঙ্গাপুরের প্রায় ১৫টি মন্ত্রণালয় ও ৫০টি বোর্ডের প্রধান হচ্ছেন এই সার্ভিসের সদস্যরা। এই সার্ভিসের সুযোগ সুবিধা ও বেতন- সবকিছুই বেশ অকর্ষণীয়। কিছুদিন আগ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের আইন সচিব ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার।
সিভিল সার্ভিসের নতুন ধারণা হচ্ছে- টেকনিক্যাল সেবাগুলোকে বেসরকারিকরণ বা পদভিত্তিক বা প্রজেক্টের ভিত্তিতে টেকনিক্যাল লোকজন নিয়োগ প্রদান। সিভিল সার্ভিসের মূল কাজ হচ্ছে তদারকি ও ব্যবস্থপনা। বাংলাদেশের মতো খুব কম দেশই আছে যারা সরাসরি জনগণকে এতো সরকারি সেবা দেয়। যেমন: বিদ্যুৎ বা পানির সরবরাহ যুক্তরাষ্ট্রে বেশিরভাগ স্টেটেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রদান করে।
সুতরাং যতোদিন যাবে সিভিল সার্ভিসের ভূমিকা বিশেষত টেকনিক্যাল সার্ভিসগুলোর পরিসর সীমিত হবে। এতে জেনারেল ক্যাডারগুলোতে ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তারদের আগমন ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। আরেকটি কথা- সেটি হচ্ছে আমাদের সমাজ বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য যেমন চাপ দেয়, ঠিক তেমনি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্যও চাপ দেয়।
আবার আমাদের অনেকে চাকরি বা অর্থের জন্য এইসকল বিষয় বেছে নেয়। সতরাং কত শতাংশ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার তার নিজ পেশাকে ভালোবাসে এটাও একটি প্রশ্ন। সুতরাং বিসিএস এ ডাক্তার, প্রকৌশলীদের আসা নিয়ে যে অযাচিত বিতর্ক হচ্ছে তা বন্ধ করা উচিত।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিসিএস এর ফলাফল নিয়ে মতামাতি যেমন দৃষ্টিকটু ঠিক তেমনি বিসিএস বিরোধী পোস্টও একই রকম অসুন্দরের সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দরকার সঠিক সময়ে সঠিক ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং এবং সামাজিক চাপের বিপরীতে ব্যক্তির ইচ্ছাকে প্রধান্য দেয়া।
এই দুইটি প্রশ্নের সমাধান করতে পারলেই আমাদের এই বিষয় নিয়ে আর সময় নষ্ট করতে হবে না।
লেখক: কে এম ইশমাম, সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা জেলা প্রশাসন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১২ ঘণ্টা, জুলাই ০৯, ২০২০
এমআর/টিসি