মাননীয় প্রেসিডেন্ট এরশাদ চাচা,
'আমার সালাম গ্রহণ করিবেন। আমাকে আপনার না চিনারই কথা।
ধীমান পাঠক ব্যতীত অন্যরা জানতেনই না গেদুচাচা আসলে কে! গ্রন্থনায় থাকতেন খ ম হ। মহৎপ্রাণ এই যুগন্ধরই খোন্দকার মোজাম্মেল হক।
আশির দশকে দুর্দান্ত প্রতাপশালী রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে সাপ্তাহিক সুগন্ধা সম্পাদনাকালীন ‘গেদুচাচার খোলা চিঠি’ নামে ব্যতিক্রমধর্মী এই কলামটি প্রবর্তন করেছিলেন। এতে ‘আর্ট অব ব্লিঙ্কিং’ কায়দায় সরস কথায় তীব্র সমালোচনা করে লাইম লাইটে উঠে এসেছিলেন তিনি।
বন্ধুর পরিবেশেও অক্লান্ত সারথির মতো লিখে প্রথিতযশা কলমযোদ্ধা খোন্দকার মোজাম্মেল হক হয়ে উঠেছিলেন সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় কলাম লেখক। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার নির্লোভ নির্ভীক সাংবাদিকতার কিংবদন্তি পথিকৃৎ। সাংবাদিকতায় নবধারা সূচনা করে সততা ও নিয়ম-নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নিজেকে কালক্রমে পরিণত করেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানে।
তিনি শুধু সেলিব্রেটি সাংবাদিকই ছিলেন না, সেলিব্রেটিদের সেলিব্রেটি ছিলেন। অনেক খ্যাতিমান সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতার গুরু তিনি। তথ্যনির্ভর ক্ষুরধারে রসাত্মক উপস্থাপনায় কলামে থাকত হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সুরের সম্মোহনী শক্তি। যাতে পাঠক পড়তে পড়তে একাত্ম হয়ে যেতেন তার কলামের সঙ্গে।
গেদুচাচার ছিল দৃষ্টির বৈভব আর ভাষার জাদু। কলামের বৈশিষ্ট্য ও আকর্ষণ ছিল বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রশ্নে উচ্চকণ্ঠ। তথ্যের ব্যাপৃতি ছিল নিম্নবর্গ থেকে উচ্চবর্গ, মেঠোপথ থেকে রাজপথ, অজপাড়া থেকে প্রাসাদ অবধি। এতে সংখ্যাগুরু আঞ্চলিক ভাষাকে শৈল্পিক রূপ দিয়ে নবঢঙ্গে চিত্তাকর্ষক করে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার মতো ভাষাশৈলীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা। লেখায় বৈপরীত্য বিষয়বস্তুতে অন্তর্দৃষ্টি ফেলে অসংখ্য পাঠকের হৃদয়শীর্ষে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন।
গেদুচাচার কলামে ছিল গণমানুষের অভাব-অভিযোগ, দাবি-দাওয়া এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের যতসব অনিয়ম-অসঙ্গির বিরুদ্ধে অনিরুদ্ধ এক গতি। দিব্য চোখে স্বচ্ছ সে দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক বৈষম্যসহ খুঁটিনাটি সামগ্রিক বিষয়। নিরলস লিখে গেছেন জনমত সংগঠনের লক্ষে। লেখনিতে কখনই পাঠকের হাতের তালুতে বসতে চাননি, বসতে সক্ষম হয়েছিলেন আস্থার জায়গাটিতে। ফলে হয়ে উঠেছিলেন ৬৮ হাজার গ্রামের অভিভাবক ও মুখপাত্র।
জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে কঠিন খারাপ সময়ে গেদুচাচার আবির্ভাব ঘটেছিল ক্ষেতের আইল ও উত্তপ্ত রাজপথ থেকে ধূমকেতুর ন্যায়। যখন দেশ চলছিল রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের মুখোশে নির্ভেজাল ডিক্টেটরি স্টাইলে। তখন সাংবাদিকতাও ছিল গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামেরই অংশ।
সে সময় বিশেষ করে বিবিসির সাংবাদিক আতাউস সামাদ, ভয়েস অব আমেরিকার সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী, সাপ্তাহিক যায়যায়দিন সম্পাদক শফিক রেহমান, সাপ্তাহিক বিচিন্তার সম্পাদক মিনার মাহমুদ ও মতিউর রহমান চৌধুরীরা যখন নানানভাবে ভীষণ হয়রানির শিকার শুধু নয়, অনেকের পত্রিকা বন্ধ করে পাঠানো হয়েছিল নির্বাসনেও।
জনগণের তথ্য জানার অধিকার থেকেই কলামটির জন্ম। গেদুচাচার ভাষায়- 'চাচারে, আপনারা তো শহরের মানুষ। থাকেন চাইর দেওয়ালের ভেতরে। চলেন ৪ কাঁচের ভেতর। কিন্তু আমরা যারা গেরামে থাকি, তাদের মরণের খবরও অন্যগেরামে জানে না। '
জানানোর এই ওয়াকিয়ানবিস বা বার্তাবাহকের কাজটি কাঁধে নিয়েছিলেন গেদুচাচা। কলামটির আত্মপ্রকাশই ছিল ভিমরুলে ঢিল ছোড়া। যেন বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের ভেলা, গতি স্রোতের উজানে।
টিকে থাকতে ঝুঁকি তো ছিল ঠিকই, কিন্তু দেশপ্রেমিক সাংবাদিক হিসেবে মানুষকে তথ্য জানানোটাও তো কর্তব্যে বর্তায়। তজ্জন্য অধিক নিউরন খাঁটিয়ে উত্তম তরিকা ‘আর্ট অব ব্লিঙ্কিং’ বের করতে হয়েছিল তার। যা গেদুচাচার ভাষায়- ‘কৌশলী হলে স্ত্রীর চাইতে শাশুড়ির সাথেও চটিয়ে ঠাট্টা মশকরা করা যায় বৈকি!’ তাই লিখতেন জাদুময়ী ব্যঞ্জনায় টক-ঝালে মিষ্টি মিশিয়ে-
‘গতকাইল আমাদের গেরামের চৌধুরী বাড়ির আবু চৌধুরী বাড়ি আসিয়াছে। তিনি বলিলেন, এই বছরই আবার নাকি একখান ভোট হইবে। সেই কথাখানা শুনিবার পর হইতে সারারাইত আমার ঘুম হয় নাই। ...চাচা, আপনার আল্লার কসম লাগে আপনি আর ভোট দিয়েন না। এই বছরের পয়লা যেই দুইখানা ভোট দিয়াছেন, তাহাতেই সারাজনমের হাউস মিটিয়া গিয়াছে। সেই নির্বাচন দেখিয়া আমার ‘৪৭ সালের রায়টের কথা মনে পড়িয়া গিয়াছিল। ...শুনিতেছি আপনি নাকি ভোটের নিয়ম বদলাইয়া দিবার কথা ভবিতেছেন। তাহাতে আমার একখান পরামর্শ আছে। সেইটা হইলো, দশ বছরে একবার ভোট দিবেন। ভোটকেন্দ্রে আমরা যাইতে চাই না। অবশ্য না গেলেও ঠিকমতো ভোট হইয়া যায়। এমনকি যাহারা বাঁচিয়া নাই, তাহারাও ভোট দিয়া যায়। খামোখা ভোটের দরকার কি?’
খোন্দকার মোজাম্মেল হক এভাবেই গেদুচাচা হিসেবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দরদি ভাষায় বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপনার পাশাপাশি কলামে উঠে আসত রাষ্ট্রপতি এরশাদের স্বৈর রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের গঠনমূলক সমালোচনার উপস্থাপন ও এর সমাধান।
নব্বই দশকের গোড়াতে সুগন্ধা ছেড়ে সূর্যোদয় এবং পরে আজকের সূর্যোদয় পত্রিকা প্রকাশ করে এযাবৎকাল লাভ করেন জনমতকে প্রভাবিত করার দুর্লভ ক্ষমতা। জাতীয় স্বার্থের প্রতি অবিচল ও দায়িত্বশীল থেকে যুক্তির ভাষায় তিনি প্রতিটি ইস্যুর গণতান্ত্রিক ফয়সালার দিকনির্দেশনা দিতেন। কারোর প্রতি ব্যক্তিগত বিরাগ বা বিদ্বেষ নয়, জনসাধারণের প্রতি অগাধ ভালোবাসার উম্মুখে তিনি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সম্যক দৃশ্যপট উম্মোচনে প্রয়াস পেতেন।
গেদুচাচার খোলা চিঠিতে থাকত আদরণীয় সম্বোধন- মাননীয় প্রেসিডেন্ট এরশাদ চাচা। প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ যখন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তখন লিখে দিলেন মাননীয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কডু চাচা। ৬৮ হাজার গ্রামেরই ছিল গেদুচাচার সোর্স। বিশ্বস্ত সোর্সে জেনে নিয়েছিলেন কডু মিয়া ছিল উঁনার পারিবারিক নাম, ব্যাস্। এমনিভাবেই লিখতেন তিনি।
খোন্দকার মোজাম্মেল হক খালেদা-হাসিনা শাসনামলেও প্রতি সপ্তাহে সমাজে, রাষ্ট্রে ও সরকারে ঘটে যাওয়া চুম্বকাংশে তৃতীয় নয়নে গেদুচাচার মুখেই যেন নিজের মতামত ও পরামর্শ বলে যেতেন। যা বলতেন বা লিখতেন, তা যুক্তিগ্রাহ্য করে খোলাখুলিভাবেই বলতেন। পরিমিত কিন্তু চৌকস ভাষায় ক্ষহিষ্ণু সমাজ ও রাষ্ট্রের অনিয়ম-অসঙ্গতি তুলে ধরার মেধাবী বিশ্লেষণ ও সমাধানই ছিল তার শক্তির উৎস।
তিনিই ভিন্ন ধাঁচের প্রিন্টার্স লাইনের জন্ম দিয়েছিলেন। ‘লেখালেখির জন্য প্রধান সম্পাদক ব্যতীত কাউকে দায়ী করা যাবে না’- সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় উৎকীর্ণ এ লেখা সম্পাদকী নীতি ও তার দুর্দান্ত তেজস্বী সাংবাদিকতারই সাক্ষী, যা আমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। ‘ফ্যাক্টস আর সিক্রেটস কমান্ডস আর ফ্রি, নিউজ ইজ ব্যাইড ফিকশন ইজ নট নিউজ’ বলে একটা বিশ্বাসে ছেড়ে দিতেন সংশ্লিষ্টদের। আর ‘খবর ভালো হোক মন্দ হোক আমরা সত্য কথা বলব’- পত্রিকার এই স্লোগানের মধ্যে পাঠক সমাজ তাদের প্রিয় গেদুচাচাকে আবিষ্কার করতেন।
চলার পথও মসৃণ ছিল না। সত্যের পথে হাঁটতে মাসুলও গুণতে হয়েছে ৬৬টি মামলা খেয়ে। প্রচারসংখ্যার বিচারে কাগজের বরাদ্দ মিলত না, না মিলত বিজ্ঞাপন। বেসরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ পড়া থাকলেও মর্দনে হাত ছিল না বলে পাঠকই ছিল লক্ষী। ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী সম্পাদক হয়ে পাহাড়সম সম্পদ গড়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দৈন্যতাকে বেছে সততাই ছিল নীতি।
খোন্দকার মোজাম্মেল হকের পরিচয় একজন কলাম লেখক ও সাংবাদিক হলেও তার ভূমিকা ছিল একজন ‘স্টেটসম্যান’-এর মতোই অসামান্য। একজন স্টেটসম্যান যেমন জাতীয় দুর্দিনে জাতিকে দিশা ও সঠিক পরামর্শ দেন এবং জাতি তা নিঃসঙ্কোচে পালন করে, তেমনি গেদুচাচার আহ্বান বা পরামর্শ জাতি ঠিক সেভাবেই গ্রহণ করেছে।
কর্তৃপক্ষীয় সমাধান যে আসত না তা কিন্তু নয়। গত ২৩ জুন'১৯ খোন্দকার মোজাম্মেল হকের স্বনামে লেখা 'সু-সংবাদ দুঃসংবাদ' কলামেও উল্লেখ রয়েছে গেদুচাচার প্রতি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের চিরকুটের কথাটি। তাতে মি. এরশাদ লেখেন, 'আপনি অত্যন্ত পণ্ডিত ব্যক্তি। আপনার জ্ঞান গরিমা এবং মূল্যবান পরামর্শের প্রতি আমার যথাযথ সম্মানবোধ রয়েছে। আমার উদ্দেশ্যে লেখা আপনার খোলা চিঠি আমি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে পাঠ করেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি এবং উপদেশাবলি গ্রহণের চেষ্টা করেছি। '
রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান তাদের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে গেদুচাচার খোলা চিঠিকে কীভাবে মূল্যায়নে নিতেন তা তো ছিলই, তার চেয়েও বড় কথা গেদুচাচাতে আসক্ত থাকতেন পাঠককুল। এখানেই গেদুচাচা একটি প্রজন্মের নেতা।
খোন্দকার মোজাম্মেল হক-সৃষ্ট গেদুচাচা চরিত্রটি সত্যিই অনন্য। 'গেদুচাচার খোলা চিঠি' কলামটি তাকে ছাপিয়ে সৃষ্ট গেদুচাচাই যেন হয়ে ওঠেন ‘টেন আউট অব টেন’- দশে দশ। তিনি জি-নিউজ ওয়ার্ল্ড এবং রূপসীবাংলা টিভির পরিচালকও ছিলেন।
ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার গতিয়া পূর্ব সোনাপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। পিতা এটিএম খোন্দকার ওবায়দুল হক এবং মাতা সৈয়দা আজিজুন নেছা খানম। তার পিতার পূর্বপুরুষ ছিলেন বাগদাদের অধিবাসী। মাতা আওলাদে রাসুল সৈয়দজাদী। খোন্দকার মোজাম্মেল হকও ছিলেন বিনয়ী, মানবসত্তা ও সচ্চরিত্রের অধিকারী এবং ধর্ম দর্শনে পণ্ডিত ব্যক্তি।
খোন্দকার মোজাম্মেল হকের ফেসবুক স্ট্যাটাস ছিল- ‘দুই কন্যা তাসনুভা হক ইভা এবং তানহা তাবাসসুম মম। তিন পুত্র তানভীর মোজাম্মেল রিদয়, রাহাত এম হক এবং রিফাত এম হক। আমার নাতি-নাতনিদের নিয়ে বেঁধেছি খেলাঘর এই নশ্বর ভুবনে। '
এই ভুবনে তিনিই আজ নেই। রাষ্ট্রীয় পদক-পদবির পথ মাড়াননি, গেদুচাচাই ছিল তার অভিধা। সরকার ও জনগণের মধ্যে ভাবনার সেতুবন্ধন রচনা করেছিলেন গেদুচাচা, তারই বিখ্যাত গেদুচাচার খোলা চিঠির মধ্য দিয়ে। একটা কথা আছে, ‘ফেইলিওর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস’- জাতি সেটি হারাল।
গেদুচাচা খ্যাত খোন্দকার মোজাম্মেল হক বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতকে আলোকিত করা বাতিঘর। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক দেশপ্রেমিক অসি ও মসিযোদ্ধা এই মহীয়ান স্মরণে বরণীয় হয়ে থাকবেন চিরদিন।
লেখক: সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা
[email protected]