এ মহামারি কালে সবার উৎকণ্ঠা, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্টসাধ্য। তার ওপরে কেউ যদি গর্ভবতী হয়, তাহলে তো দ্বিগুণ চিন্তা।
স্বাভাবিক অবস্থাতেই পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে স্বামীকে বলতে শুনতাম; ও এখন বড্ড জ্বালাচ্ছে... কিছুই বুঝতে চায় না। অল্পতেই কাঁদে! কোভিড দিনে ঘরবন্দী অবস্থা, অনাগত সন্তান, ডেলিভারি, কোভিড আক্রান্ত হওয়ার ভয় সব মিলিয়ে গর্ভবতীর মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই কঠিন। তাই এ সময়ে হবু মায়েদের টেনশন মুক্ত থাকার জন্য কিছু পন্থা অবলম্বন করার পরামর্শ দেওয়া যায়।
১. করোনা সম্পর্কিত সংবাদ এড়িয়ে চলুন
যদিওবা গর্ভবতীর জানতে হবে, এ সময়ে তার স্বাস্থ্যসেবায় কী কী পরিবর্তন এসেছে সেবাকেন্দ্রে। কিন্তু সারাক্ষণ মোবাইল, ফেসবুক, টিভি নিউজ শুনতে থাকলে, একটা সময় মনের ওপর চাপ পড়বেই। তাই শুধু ততটুকু জানার চেষ্টা করতে হবে যতটুকু তার দরকার। বাকি সময়টা এসব থেকে দূরে থাকতে হবে। খবর নেওয়ার আদৌ দরকার পড়লে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে নিতে হবে (যা-তা সোর্স থেকে নয়)। এমন অনেক নিউজ পোর্টাল আছে যেখানে দিনকে রাত বানায়, জীবিতকে মৃত করে ফেলে। যতটুকু সম্ভব সোশ্যাল মিডিয়া পরিহার করতে হবে। কেউ চাইলে প্রতিদিন নিয়ম করে শুধু সকালবেলায় সঠিক পোর্টাল থেকে খবর নিতে পারে। হতে পারে তা নির্ভরযোগ্য পত্রিকা কিংবা টিভি নিউজ। দিনের বাকি এইসব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে। রাতে ঘুমানোর এক ঘণ্টা আগে থেকে খবর দেখা সম্পূর্ণ বন্ধ। যদি কোনো খবর মিস করছেন বলে টেনশনে থাকার সম্ভাবনা থাকে তাহলে স্বামী বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য মারফত জেনে নিবেন।
২. আজকের জন্য বাঁচুন
কাল কী হবে? কেন এমন হলো? এখন কী হবে? এসব চিন্তা আসাটাই স্বাভাবিক। প্রতিটি মানুষ চায় তার জীবনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে। তাই ভবিষ্যতে কী হতে পারে তার উত্তর জানার চেষ্টা করা বা ধারনা করা নিজের মনকে স্বস্তি দেওয়ার বা নিরাপদ বোধ করানোর একটা প্রক্রিয়া মাত্র। কিন্তু সব সময় কালকের চিন্তায় মগ্ন থাকলে আজকের অনেক কিছু জীবন থেকে মিস হয়ে যায়। প্রতিনিয়ত মনের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া হাজারটা প্রশ্নের এক্ষুনি উত্তর পাওয়া তো সম্ভব না। তাই এই মুহূর্তে যা আপনার নিয়ন্ত্রণে আছে, তার বাইরে কিছুতেই যাওয়া যাবে না। মন ভালো করার সেইসব যাদুর কাঠিকে নিজের খুব কাছে রাখতে হবে। সারাদিনের অল্প অল্প প্রচেষ্টায় দিন ভালভাবে কাটানো সম্ভব।
ধরুন, কেউ চা বানাবে। তখন দেখুক গরম হওয়ার পর পানিটা কীভাবে ফোটে, চা পাতি দেওয়ার পর সাদা পানিতে কীভাবে রঙ মেশে, পানি ফোটার সময় কিভাবে শব্দ হয়, গন্ধহীন পানিতে যখন চা-পাতা পড়ে তখন কেমন সুবাস ছড়ায়, দুধ দেওয়ার পর কালো চা কিভাবে খাকি রঙ ধারন করে। আপনি যে কাজটা করছেন, সে কাজের প্রতিটি খুঁটিনাটি, প্রতিটি মুহূর্তকে আপনার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করুন। তবেই পৃথিবীর সব সমস্যার টেনশন, ঝক্কি থেকে নিজের মনকে সরিয়ে রাখতে পারবেন।
আরো যা করা যায়
মনকে কাবু করতে না পারলে, ঐ সময় শ্বাস-প্রশ্বাস খেয়াল করুন। কীভাবে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, কীভাবে ফেলছেন লক্ষ্য করুন। পরে একটা নির্দিষ্ট গতিতে ধীরে ধীরে শ্বাস নিন ও ফেলুন। অনেক ইউটিউব ভিডিও আছে, সাহায্য নিতে পারেন সেখান থেকেও। এছাড়া গ্রাউন্ডিং ব্যায়াম করতে পারেন। এটা হলো উড়ুউড়ু মনকে টেনে এনে এক জায়গায় জড়ো করার পন্থা। গ্রাউন্ডিং ব্যায়াম কীভাবে করতে হবে ইউটিউব থেকে দেখে নিন।
৩. বন্ধু বা পরিবারকে ফোন করা
মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা চাপা ব্যথা বা কথা যদি মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারা যায় তাহলে মনটা অনেকটা হালকা হয়ে যায়। মনের চাপ দূর হয়। গোপন কষ্ট, ব্যথা এমন একজনকে বলে হালকা হয়ে নিন যাকে আপনি পুরোপুরি বিশ্বাস করেন। হতে পারে সে বন্ধু, আত্মীয় বা কলিগ। বিশ্বস্ত এরকম কাউকে পাশে পেলে, মনের এ উচাটন অবস্থায় একা নন আপনি। প্রেগন্যান্সিতে এমন কারো খুব প্রয়োজন মেয়েদের।
৪. নিজের প্রতি সদয় হোন
অনেক গর্ভবতী নিজেকে দোষী ভাবেন এই ভেবে যে, তার চারপাশের সবার হাজার চেষ্টায় কেন তার মন ভাল হচ্ছে না। কেন সে সবার চেষ্টা সত্ত্বেও মন ভালো রাখতে পারছে না। গর্ভবতীর মনে রাখতে হবে, করোনা দিনে দুশ্চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। এ সময়ে এইরকম দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি মিলবে না এটাই মনকে বোঝাতে হবে। খারাপ চিন্তার ওপর ফোকাস না করে রিলাক্স হওয়ার উপায়ের ওপর ফোকাস রাখতে হবে। তার জন্যে শিথিলায়ন ভালো পদ্ধতি। শিথিলায়নের জন্য শ্বাসের যে ব্যায়াম তা শিখে নেওয়া যায় ইউটিউব দেখে। প্রতিদিন প্র্যাকটিস করতে করতে অল্প দিনেই সফলভাবে আয়ত্বে আনা যায় কৌশল।
করণীয় কী?
-একটিভ থাকা।
- কফি বাদ দেওয়া।
- ধুমপান থেকে বিরত থাকা।
-স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। জাংকফুড পরিহার করা।
- দিনে ১০-১২ গ্লাস পানি খাওয়া।
- নিয়ম মতো ঘুমানো। রাত না জাগা।
-নিজেকে সংযত ও ঠাণ্ডা রাখার জন্য আরও উপায় আছে। নিজেকে শীতল করার টুল কিট (tool kit) তৈরি করা। এই tool kit টা আবার কী? এটা এমন একটা জাদুর বাক্স যা কেউ উদ্বেগ অনুভব করলে হাতের নাগালে খুঁজে পাবে। এই বাক্সে থাকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় (দেখা, শোনা, স্বাদ, স্পর্শ, গন্ধ)। পছন্দের কিছু উপকরণ নিজেই বানিয়ে ফেলতে পারেন।
মূল ব্যাপার হলো, নিজের অশান্ত মনের সুরাহা নিজেকেই করতে হবে। যা দেখলে, ছুঁলে, গন্ধ নিলে মনের অশান্ত অবস্থা শান্ত হবে, সেই ব্যাপারগুলোর একটা ফর্দ বানিয়ে চোখের সামনে রাখতে হবে। ভালোলাগার জিনিসগুলো যেন হাতের নাগালের মধ্যেই থাকে।
উপকরণ হতে পারে
ক) দেখা:
-প্রিয় কারো ছবি।
-প্রকৃতির ছবি, ভ্রমণের পুরনো অ্যালবাম।
-প্রিয় কোনো মুভি বা ঘরের সদস্যদের নিয়ে ভিডিও।
খ) শোনা:
-প্রিয় গানগুলো শোনা।
-চারপাশের হট্টগোল থেকে বাঁচার জন্য হেডফোন।
-মেডিটেশন মিউজিক।
গ) স্বাদ:
- হাতের কাছে প্রিয় শুকনো খাবারের বাক্স।
- হারবাল চা, গ্রিন টি, গরম চকলেট মিল্ক ইত্যাদি।
ঘ) স্পর্শ:
- স্পন্জের বল।
- পাখির পালক, ময়ুরের পেখম
- চুলের ব্রাশ।
- পছন্দের নরম কাঁথা।
ঙ) গন্ধ:
- সুগন্ধি মোমবাতি।
- সুগন্ধি তেল (essential oil)।
- পারফিউম।
এইসব উপকরণকে দৃষ্টি সীমায় রাখতে হবে যাতে মন অশান্ত হলে এইসব স্বাদ-স্পর্শ-গন্ধ কিছুটা হলেও মনে ফুরফুরে অনুভূতি দেয়।
৫. নিজেকে ডিসট্রাক্ট করা
যখন চিন্তারা গোলক ধাঁধায় আটকে যায়, মনকে নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে, তখন নিজেকে ঐ চিন্তা থেকে সরানোর জন্য অন্য কোনো কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। পত্রিকা পড়া, গল্পের বই পড়া, শব্দ জট খোলা, ছবি আঁকা, সময় নিয়ে গোসল করা, মুভি দেখা, হাসির গল্প পড়া বা হাসির কোনো প্রোগ্রাম দেখা। এই সবকিছু উথাল-পাতাল মনকে কিছুটা হলেও সুস্থির করতে পারে। অর্থাৎ সেটাই করা উচিত যা মনকে আনন্দ দেয়।
৬. মনে রাখতে হবে- এ খারাপ সময় কেটে যাবে
কখন এ মহামারি শেষ হবে এটা নিয়ে নানাজনের নানা মত। কখন শেষ হবে সে চিন্তা করার দায়ভার গর্ভবতীর ওপর বর্তায়নি। তার জন্য পৃথিবীর অনেক লোক একসাথে হয়ে কাজ করছে। প্রেগন্যান্ট মহিলার শুধু মনে রাখতে হবে, এ মহামারি কোনো না কোনো দিন শেষ হবে! তাই আজকের দিনটায় কী করবেন সে চিন্তাটাই শুধু করা উচিত, সেভাবে প্ল্যান করেই দিনটাকে কাজে লাগাবেন।
৭. প্রয়োজনে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা
যদি প্রায় সময়েই গর্ভবতীর মন খারাপ থাকে বা প্যানিক অ্যাটাক হয় তাহলে সাহায্য চাইতে হবে উপযুক্ত পরামর্শ দাতার কাছে। হতে পারে সে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ বা পরামর্শক।
৮. নতুন কোনো শখ
গান, কবিতা, গিটার, নতুন ভাষা শিখতে পারেন কিংবা বা পুরোনো কিছু জং ধরা হবিকে নতুন করে ঘষে মেজে নতুন করে নিতে পারেন। অনেকেই নিজ হাতে তৈরি করে নিতে পারেন বাবুর কাঁথা, কম্বল, জামা।
৯. অনলাইন সাপোর্ট গ্রুপ
এখন হবু মায়েদের জন্য অনেক অনলাইন সাপোর্ট গ্রুপ আছে। তথ্য উপাত্তের আদান প্রদান করা যায় তাদের সঙ্গে। এছাড়া অনলাইন কাউন্সিলিংয়ের সাহায্যও নেওয়া যায়। আমাদের দেশেই আছে। যারা মানসিক চাপে ভুগছে প্রাথমিকভাবে সাহায্য নেওয়া যায় তাদের কাছ থেকে।
এ সময়ে আমাদের সবাইকে ভালো থাকতে হবে। সবাই মিলে ভালো থাকার আর অন্যকে ভালো রাখার চেষ্টা করতে হবে। গর্ভবতীর নিজের মনের জোর ও চেষ্টা তার অনাগত সন্তানের জন্য সুন্দর আগামীর ভোর নিয়ে আসবে।
‘রেডিওটা বন্ধ করো।
যা শোনার সবই শুনেছ। নিস্তব্ধতাই সবচেয়ে সহিষ্ণু।
পত্রিকাটা ভাঁজ করে পাশে রেখে দাও।
আসার আগেই ওটা পুরনো হয়ে গেছে।
সার্চ, শেয়ার আর লাইকের নামে বুড়ো আঙুল দেখাতে দেখাতে তুমি নিজেই যেন
চোখে সর্ষে ফুল দেখতে শুরু করো না।
শেষমেশ পর্দাটাকে একেবারে কালো করে দাও।
আমিও তোমার মতোই ভীত, হারাতে চাই না এমন
প্রত্যেকের জন্য আমি উদ্বিগ্ন।
আমিও অন্য কিছুর জন্য পয়সা সরিয়ে রেখেছিলাম:
অনেক দূরের সফর, কোনো ভাঙা হৃদয়ের জন্য একটুখানি মলম,
সহজে চালু করা যায় এমন একখানা গাড়ি।
সামনের দরজাটা বন্ধ করে দাও।
বাগানে এসো, রোদটাকে চেখে দেখো। ’
-ইঙ্গমার হাইৎজ
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গাইনি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ