মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ করোনার মতো ভয়াবহ অভিশাপের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। এমন এক শান্তিপূর্ণ সময়ে ‘আমরা বঙ্গবন্ধুর বিরোধী নই, আমরা সরকারবিরোধী নই’ বলে অসহ্য রকমের ঔদ্ধত্য আর উগ্র জঙ্গি ও হেফাজত আর কিছু মোল্লাতন্ত্রের ধর্মান্ধ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি বেয়াদবির সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
এখানে সব ধর্মের নাগরিক তাদের ধর্মচর্চা থেকে সমনাগরিক অধিকার ভোগের অধিকার রাখে। এখানে ইসলামী জলসা, ওয়াজ মাহফিল যেমন হয় তেমনি হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও তাদের পূজা-পার্বণ মহোৎসব করেন। এখানে জুমার নামাজে যেমন মুসল্লির ঢল নামে তেমনি বাংলা নববর্ষে সকাল থেকে মুসলমানসহ সব ধর্মের মানুষের স্রোতে ভাসে দেশ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ মাথা তুলে দাঁড়ায়। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস ছাড়াও জাতীয় শোক দিবসেও কম মানুষের স্রোত নামেনি। এমন অবস্থায় উগ্র ধর্ম ব্যবসায়ী বাবুনগরী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ছিঁড়ে নামিয়ে ফেলবেন। মামুনুল হক ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবেন বলে যে উগ্র হুঙ্কার দিয়েছেন তা বরদাস্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণ করবেন না। মুখের লাগাম টেনে ধরুন।
ধর্ম ব্যবসায়ীরা ’৭১ থেকে পরাজিত। পাক হানাদার বাহিনী যেমন নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি তেমনি তাদের দোসরদেরও নয়। আলেম-ওলামাদের মানুষ সম্মান করলেও যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির পক্ষে ওকালতি, বয়ান, জঙ্গি মিছিল চলবে না। মনে পড়ে মামুনুল হক শাপলা চত্বরে কী বলেছিলেন? আর দিনভর তা-বের পর রাত নামতেই কীভাবে গুটিয়ে পালিয়েছেন। এ দেশে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা উগ্র নাস্তিকদেরও স্থান নেই। এ দেশে শ্রেণিশত্রু খতমের নামে সর্বহারাদের গোপন অস্ত্রের রাজনীতি, উগ্রপন্থি অন্ধকার বিপ্লবীদের কবর রচিত হয়েছে। এখানে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর জামায়াত ও তাদের সঙ্গীরা অর্থ পেশি ও অস্ত্র শক্তির সঙ্গে বাইরের সমর্থনেও দাঁড়াতে পারেনি জনরোষের বিরুদ্ধে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে জাতি বিজয় এনেছে দীর্ঘ সংগ্রাম আর বহু রক্তে, সেই মহান নায়কের ভাস্কর্য হবে আকাশছোঁয়া। মামুনুল হকরা বাড়াবাড়ি করলে পরিণতি ভালো হবে না। রাষ্ট্র ও জনগণ বসে থাকবে না। মোল্লাতন্ত্রের উগ্রতার কাছে বিজয়ী জাতি মাথা নত করবে না। এদের পেছনে যারা ভয়ঙ্কর খেলা খেলছে বুঝছে না। এ আগুনে নিজেরাও পুড়বেন। মূর্তি আর ভাস্কর্য এক নয়। মূর্তি বা পৌত্তলিকতা মন্দিরে মন্দিরে থাকে। সেখানে তাদের ধর্মের অনুসারীরা আচার অনুষ্ঠান করেন। পশ্চিমা দুনিয়ায় খ্রিস্টানদের প্রাধান্য থাকলেও বিশাল সুরম্য মসজিদ মন্দির শোভা পায়। ভাস্কর্যতে বীরদের সঙ্গে শিল্পেরও স্থান পায়। বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যায়ই বলেছিলেন সব ধর্মের মানুষ তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে। তার মানে ধর্মের অপব্যাখ্যা ধর্মের নামে সমাজে অশান্তি উগ্রতা নয়। ধর্ম ব্যক্তিগত জীবনে। রাজনৈতিক জীবনের নয়।
যারা আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণকে ব্যঙ্গ করে মূর্তি নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না বলে ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছেন তা মুক্তিযুদ্ধ সংবিধান আইন পরিপন্থী। আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কঠোর হোন। মামুনুল হকের যে ভিডিও দেখেছি প্রতিটা ঔদ্ধত্য মিথ্যা অহংকারে অভিশপ্ত। ইসলামের শেষ নবী আল্লাহর রসুল হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর ঠোঁট নাড়ানোর বর্ণনা দেখাচ্ছেন। এটি মহানবীর প্রতি ধৃষ্টতা, অবমাননা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত। এটা বেয়াদবি। এসব ধর্মের নামে উগ্রবাদী শক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যদিকে দেশের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার বহন করা সব মত-পথের মানুষকে জনগণকে নিয়ে রুখতে হবে। গণজাগরণ ঘটাতে হবে। যে ঐক্যে সামরিক শাসনের অবসান ঘটেছে। যে ঐক্যে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তিকে রুখে দেওয়া হয়েছে, যে শক্তিতে একাত্তরে বিজয় এসেছে, মানবতাবিরোধী শক্তির ফাঁসি হয়েছে, সেই শক্তির ঐক্য আজ অনিবার্য।
রোহিঙ্গা নিয়ে অস্থির অশান্ত পরিস্থিতি জন্ম নিলে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি ভাস্কর্যের বিরোধিতার নামে তালেবানি মোল্লাতন্ত্রের উত্থান ও আগুন জ্বালালে কেবল প্রিয় স্বদেশই রক্তাক্ত হবে না, অশান্ত হবে না, আশপাশের দেশেও আগুনের তাপ লাগবে। আফগানিস্তানের তালেবানিরা একটি দেশের সর্বনাশই করেনি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রকেও কলঙ্কিত করেছে। যে উগ্র মোল্লাতন্ত্র একদিন ইসলাম চলে যাচ্ছে বলে ’৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হয়ে এ দেশে মুসলমানদের গণহত্যা করেছে, গণধর্ষণ করেছে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেনে নিতে পারেনি। তাদের পরিণতিও অভিশপ্ত। তাদের সহচর ও উত্তরসূরিরাই আজ জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য হবে না বলে ধর্মের নামে উগ্র আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে অশান্ত অস্থির পরিবেশ তৈরির ভয়ংকর খেলা খেলছে।
বর্ষীয়ান নেতা আমির হোসেন আমু মুখ খুলেছেন ১৪ দলের হয়ে। ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, তার মতো। মাহবুব-উল আলম হানিফ, হাছান মাহমুদ কড়া বর্তা দিয়েছেন। এক ছাত্রলীগ নামতেই মামুনুল হকের কণ্ঠ নীরব হয়ে এসেছে। শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জে গোলাম আযমকে হারাম করেছিলেন। সারা দেশে রাজনৈতিক শক্তি নেমে গেলে, প্রশাসনিক শক্তি অ্যাকশনে গেলে এদের খুঁজেও পাওয়া যাবে না। এদের পেছনের শক্তিও নাই হয়ে যাবে। এদের বিষদাঁত ভেঙে দিতে দমন করতেই হবে।
এ শক্তি কখনো মাদ্রাসা মসজিদে শিশুদের অমানবিক নির্যাতন, বলাৎকার ধর্ষণের ঘটনায় আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠলেও প্রতিবাদ করে না। ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে না। মাদ্রাসার ভিতর সংঘটিত বর্বরতার কথা বলে না। ধর্ষকের ফাঁসি চায় না। হেলিকপ্টার, জৌলুসের জীবন, মোটা অঙ্কের নজরানায় ভোগবাদী জীবনে, ধর্মের রাজনীতির বিষ ছড়ায়।
শেখ হাসিনা আলেমদের সম্মান করেন, মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নে ভূমিকা রাখেন। তাই বলে তিনি একাত্তরের দানব শক্তি ও তাদের আদর্শের ভাবধারায় সংগঠিত তালেবানি জঙ্গিদের মাথা তুলতে দেবেন না। এরা ভয়ংকর বিষধর কালনাগ। দেশ-ইসলামের শত্রু। মুসল্লিদের দুশমন।
মামুনুল হক এক বক্তৃতায় বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুুরী মানিক, ড. জাফর ইকবাল ও শাহরিয়ার কবিরকে জঘণ্য ভাষায় আক্রমণ করেছেন। কেউ সত্যিকারের আলেম হলে তার ভাষায় মানুষকে জাদুর মতো টানেন। যুক্তি-তর্কে ইসলামের প্রচার করেন। আজ আলেম দেখা যায় না। বিদেশি অন্ধকার শক্তির প্রেসক্রিপশনে মামুনুল হকদের কণ্ঠে চরম হিংস্র উগ্রতা দেখা যায়। পাকিস্তানের আজ এখানে দুই ধর্মান্ধ রাজনৈতিক সন্তান। জামায়াত ও হেফাজত।
বাংলাদেশে কবি দাউদ হায়দারকে নিজ দেশ ছাড়তে হয়েছিল মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য। তসলিমা নাসরিন ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত করায় তাকে নির্বাসিত-জীবন যাপন করতে হচ্ছে। যাবজ্জীবন কারাদন্ডের চেয়ে এটা যন্ত্রণার, অপমানের। শাস্তি তাকে কতকাল ভোগ করতে হবে কেউ জানে না। তারা মানুষ হত্যা করেনি। হত্যার হুমকি দেয়নি। কিন্তু আইন হাতে তুলে নিয়ে যারা তার মাথার দাম ৫০ হাজার টাকা ঘোষণা করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আজ মামুনুল হকরা যে ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে, তার সঙ্গে বাবুনগরীসহ যারা বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের আবেগ অনুভূতি চেতনায় আঘাত করছেন। রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করছেন। এরা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে এখনো কেন দেশ ছাড়বে না? কেন জেলের ভাত খাবে না।
এ দেশে থাকতে হলে মুক্তিযুদ্ধকে মাথার মুকুট হৃদয়ের আবেগ অনুভূতিজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে লালন করেই থাকতে হবে। দল যেটি করার করুন। এখানে আপস নেই। বঙ্গবন্ধুর আকাশছোঁয়া ভাস্কর্যই নয়, জাতীয় বীরদের ভাস্কর্যও হবে। এবং মানতে হবে এটা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাংলাদেশ, তালেবানি মোল্লা ওমরের নয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বীর মুজিবের বাংলাদেশ। ওমর ভাস্কর্য ভাঙার পর পরিণতি কী হয়েছিল? বিশ্বসন্ত্রাসী লাদেনের লাশ কোন সাগরে শেষ?
বিশ্বের সর্বত্র বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য রয়েছে। রেনেসাঁ এবং আধুনিককালে এর প্রসার হয়েছে ব্যাপকভাবে। তবে আজও দেশে দেশে ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে নিপুণ সৃষ্টিশীলতায়। এর মাধ্যমে ফুটে উঠছে নিজ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার। খোদ সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, মিসর, ইরান, ইরাকসহ প্রায় সব মুসলিম দেশে ভাস্কর্য রয়েছে। ইরানে আছে একটি বিশাল স্বাধীনতা স্তম্ভ, যার নাম ‘আজাদি’। এ স্থাপত্যটির ডিজাইনার হোসেন আমানত একজন মুসলমান। কবি ফেরদৌসি, ওমর খৈয়াম, পারস্যের নেপোলিয়ন বলে খ্যাত নাদির শাহর মতো খ্যাতিমান ব্যক্তিদের ভাস্কর্য রয়েছে ইরানে। মাশহাদ নগরীতে ভাস্কর্যসংবলিত নাদির শাহর সমাধিসৌধটি পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়।
ইরানের রাজধানী তেহরানে দুই বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয় সমকালীন ভাস্কর্য প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা। ইরানের মাজানদারান প্রদেশে প্রতি বছর আয়োজন করা হয় বালির তৈরি ভাস্কর্য প্রদর্শনীর। এটি একটি উৎসব, যার নাম স্যান্ড স্কাল্পচার ফেস্টিভ্যাল। পিরামিডের জন্য দুনিয়াজোড়া খ্যাতি মিসরের। বিরাটত্বের দিক থেকে বিখ্যাত হলো জোসার বা স্টেপ (সোপান) পিরামিড ও গিজা পিরামিড। পাথরের তৈরি স্ফিংসের ভাস্কর্য গির্জা পিরামিড সারা দুনিয়ার পর্যটকদের অতি প্রিয়। শুধু ইসলামপূর্বই নয়, অনেক অনেককাল আগের তথা খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগের এসব ভাস্কর্য মিসরের মুসলমানরা ধ্বংস করেনি। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে মাহমুদ মোখতারের বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘ইজিপ্টস রেনেসাঁ’।
ইরাকেও আছে অনেক ভাস্কর্য। বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে ডানার ভাস্কর্যটি সবার নজর কাড়ে। বাগদাদের পাশে আল-মনসুর শহরে আছে মনসুরের একটি বিশাল ভাস্কর্য। আছে অনেক সাধারণ সৈনিকের ভাস্কর্য। সাদ্দাম হোসেনের বিশাল আকারের ভাস্কর্যটি মার্কিন আগ্রাসনের পর ভেঙে ফেলে সাদ্দামের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, যারা মার্কিন বাহিনীর মদদপুষ্ট। এটা ভাঙা হয় রাজনৈতিক কারণে, ধর্মীয় কারণে নয়। তাই বলে ভাস্কর্যহীন হয়নি ইরাক। প্রচুর ঐতিহাসিক ও দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্যের মালিক দেশটি। রাজধানী বাগদাদে বেশ কিছু বিখ্যাত ভাস্কর্য রয়েছে। সেগুলো হলো ইন্টারন্যাশনাল জোনে হাম্মুরাবির ভাস্কর্য। অ্যাম্বুরাবিদের বিখ্যাত ষষ্ঠ রাজা হাম্মুরাবির খ্রিস্টপূর্ব ১৭৯২ অব্দে ব্যাবিলনের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ১৭৫০ অব্দ পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন। হাম্মুরাবি কোডের জন্য খ্যাতিমান এ রাজা। আরব্য উপন্যাসের রহস্যে এখনো রহস্যময় বাগদাদ শহরের আবু নুয়াস স্ট্রিটে শাহেরজাদি পার্কে রয়েছে আরব্য উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শাহেরজাদি এবং রাজা শাহরিয়ারের ভাস্কর্য। বিশ্বজুড়ে আলীবাবার মর্জিনাকে চেনে না এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। এ বুদ্ধিমতী বাঁদি মর্জিনার বুদ্ধিতে কুপোকাত হয়েছিল ৪০ চোর। সেই মর্জিনার ভাস্কর্যের দেখা মিলবে বাগদাদে আলীবাবা স্কয়ারে আলীবাবা ফাউন্টেনে।
প্রচণ্ড রক্ষণশীল মুসলিম দেশ সৌদি আরবের বাণিজ্যিক রাজধানী জেদ্দা নগরীতে আছে উটের দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য। জেদ্দার উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে নগরীতে মুষ্টিবদ্ধ হাত, হাংরি হর্স, মানব চোখ, মরুর বুকে উটের ভাস্কর্য। আফগানিস্তানের জঙ্গিরাও হাত দেয়নি অষ্টম শতকের সমরনায়ক আবু মুসলিম খোরাসানির ভাস্কর্যের গায়ে। গজনিতে এখনো স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে সেই ভাস্কর্য। মুসলিম দার্শনিক ও পন্ডিত ইবনে সিনার নাম কে না জানে। তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবেতে ইবনে সিনার একটি বিশাল ভাস্কর্য আছে। মুসলিমপ্রধান ওই দেশের কোনো নাগরিক তো ভাস্কর্যটির গায়ে আঁচড়ও দেন না।
ইউরোপ ও এশিয়ার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত বলে তুরস্কের ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিবর্তনে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব পড়েছে। এককালের সারা মুসলিম জাহানের খলিফার দেশ সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সারা তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রেসিডেন্ট কামাল আতাতুর্কের রয়েছে অগণিত ভাস্কর্য। একেকটি দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্যে একেক রকমভাবে আতাতুর্ক এবং তুরস্কের ইতিহাস, ঐতিহ্য বিবৃত হয়েছে।
ক্ষমতায় এখন এরদোয়ানের ইসলামী দল। যে রাজনীতি জামায়াত অনুসরণ করে। সেই এরদোয়ানও কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্যে হাত দেওয়ার সাহস পাননি। বিদেশের পর্যটকরাও সেখানে যান। এ দেশে যারা ভাস্কর্যবিরোধী তাদের গ্লানি লজ্জা হিংস্রতা মুক্তিযুদ্ধ ও তার মহানায়ক এবং বীরেরা। এরা তালেবানি মোল্লা ওমরের মতো অন্ধ, অনুসারী।
কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য ছাড়াও তুরস্কের উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো, মর্মর সাগর তীরে পোতাশ্রয়ে অপূর্ব মর্মর ভাস্কর্য, আঙ্কারায় ইনডিপেনডেন্স টাওয়ারের পাদদেশে তুরস্কের জাতীয় সংস্কৃতির ধারক তিন নারী ভাস্কর্য ও আন্তালিয়ায় এডুকেশন অ্যাকটিভিস্ট তুরকান সায়লানের ভাস্কর্য। সবচেয়ে বেশি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়া। সে দেশেরই উত্তর সুলাবেসি দ্বীপের খ্রিস্টান অধ্যুষিত শহর মানাদোতে রয়েছে যিশুখ্রিস্টের এমন একটি ভাস্কর্য, যেটি এশিয়ায় সবচেয়ে উঁচু। ৩২ মিটার উঁচু একটি পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ৩০ মিটার উঁচু ভাস্কর্যটি। এ ভাস্কর্য নিয়ে গা-জ্বালা নেই ইন্দোনেশীয় মুসলমানদের।
পাকিস্তানে রয়েছে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভাস্কর্য; রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য শিল্প। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনের সামনে ষ-মূর্তি, লাহোরে বাদশাহি মসজিদের পাশে মেরি মাতার ভাস্কর্য, পাঞ্জাবের জং শহরের রাস্তায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়সওয়ারের ভাস্কর্য, লাহোরে ন্যাশনাল কলেজ অব আর্টস প্রাঙ্গণের নানা ভাস্কর্য তো আছেই।
মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর্য হলো- ওয়াশিংটন মনুমেন্টের আদলে গড়া ন্যাশনাল মনুমেন্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ বীরদের স্মরণে ১৫ মিটারের এ ভাস্কর্যটি উন্মুক্ত করা হয় ১৯৬৩ সালে। প্রতীকীভাবে সাতজন বীরের প্রতিমূর্তির মাধ্যমে বিশ্বস্ততা, আত্মত্যাগ আর বন্ধুত্বের বিষয়টি এ ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে। মালয়েশিয়ার ভাস্কর্য শিল্প সনাতন ও আধুনিক ধারার এক স্বতন্ত্র মেলবন্ধন। মালয়েশিয়ার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো- বাতু কেভসের বিখ্যাত মুরুগান, কুচিং হলিডে ইন হোটেলের সামনে মার্জার এবং কনফুসিয়াসের ভাস্কর্য। দামেস্কের সিটিতলায় মহাবীর সুলতান সালাদিনের ভাস্কর্য শোভা পায়।
ইরানের পথে পথে যেমন মনীষীদের তেমনি মুসলিমপ্রধান শীর্ষ দেশ ইন্দোনেশিয়ার বালির মূল সড়কের পাশে সরস্বতীর ভাস্কর্য পর্যটক টানে। এখানে পুজো হলে মূর্তি বলা যেত। হয়নি, তাই শিল্প। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বুর্জ আল খলিফার বিপরীতে রয়েছে আরব যুগলের ভাস্কর্য।
কোন মুসলিম দেশে নেই ভাস্কর্য? ইরানের ধর্মীয় নেতা খোমেনির একাধিক ভাস্কর্য রয়েছে। এখানে একদিন যারা স্লোগান তুলেছিল ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ তাদের প্রেতাত্মা এখন মাঠে নেমেছে। তারা অদৃশ্য শক্তির উসকানিতে মোল্লা ওমরের তালেবানি বিপ্লবের মহড়া দিচ্ছে। এদের মরণদশা হবে। এদের রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ। জাতি আর সহ্য করতে রাজি নয়। ওদের গায়ে ফোসকা পড়ে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ। তাই এর বিরুদ্ধে। এ মোল্লাতন্ত্রকে কঠোর হাতে দমন করা না গেলে এ দেশে পর্যটক কোনো দিন আসবে না। বীরত্বের ইতিহাস ও দেশজুড়ে শিল্প শোভা পাবে না। এদের এখনই দমন দরকার।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন