ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

তারুণ্য, বেকারত্ব ও বাংলাদেশ

তাসমিম সুলতানা, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০২১
তারুণ্য, বেকারত্ব ও বাংলাদেশ

অপার সম্ভাবনার এ দেশ। এখানে জন্ম নিয়েছেন অনেক জ্ঞানী-গুণী।

তারা দেশের সঙ্গে বিশ্বকেও করে গেছেন সমৃদ্ধ। এখনও এ মাটির সন্তানেরা পৃথিবীর দেশে দেশে অনেক দায়িত্বপূর্ণ কাজ, যুগান্তকারী গবেষণায় ব্যস্ত। কিন্তু সেই দেশের তরুণ প্রজন্মের খবর কী?

কিছু অংশ বাদ দিলে দেশের তরুণ সমাজের একটা বড় অংশই আজ নানাভাবে সংকটে নিমজ্জিত। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জায়গায় তরুণরা পাচ্ছে না যথাযোগ্য মর্যাদা, কাজ ও মেধার যথার্থ সম্মান।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। এ দেশের কর্মসংস্থানেও তারুণ্যের ভূমিকা রয়েছে অসামান্য। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, তরুণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভারতে ৩৫ কোটি ৬০ লাখ, চীনে ২৬ কোটি ৯০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬ কোটি ৭০ লাখ, যুক্তরাষ্ট্র ৬ কোটি ৫০ লাখ, পাকিস্তানে ৫ কোটি ৯০ লাখ এবং বাংলাদেশে রয়েছে ৪ কোটি ৭৬ লাখ। এই তরুণরাই বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছে। ইতিহাস সৃষ্টি থেকে প্রতিটি স্তরে সেই তরুণ যুবকরাই জোগান দিয়েছিল।
 
আজও বাংলাদেশের সব অভূতপূর্ব সৃষ্টিগুলোর জন্মই দেন তরুণরা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশ গঠনেও তরুণদের ছিল ইতিবাচক ভূমিকা। কিন্তু বর্তমান তরুণ সমাজের বড় অংশই বেকার, অনিশ্চিত জীবনের পথে। যার কারণে অনেক তরুণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথেও হাঁটেন।

আজ তরুণদের বড় একটি অংশ এ দেশের প্রতি মমত্ববোধ হারিয়ে ফেলেছে। যে কারণে আগের মতো স্বেচ্ছাশ্রম আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তারুণ্য খুবই কম দেখা যায়। তারুণ্যের এই পশ্চাৎপদতার জন্য অনেকটা আমাদের দেশের অপরাজনীতিই দায়ী। তরুণদের রাজনীতি বিমুখতাও এ দেশের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে।

তরুণদের ওপর চালানো এক জনমত জরিপে দেখা যায়, প্রচলিত এই রাজনীতিকে আমাদের দেশের প্রায় ৬০ ভাগ তরুণ ছেলেমেয়ে পছন্দ করেন না। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির নগ্ন রূপকেই তারা দায়ী করেন। তাদের কাছে রাজনীতির সংজ্ঞাটাই হলো ক্ষমতার ভাগাভাগি আর সুবিধাবাদ কেন্দ্রিক দলীয় চর্চা। তারা প্রচলিত রাজনীতিকে এ দেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক বলে উত্থাপন করেন।

তরুণদের একটি অংশ রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের প্রভাবে জড়িয়ে পড়ছে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের সঙ্গে। হলি আর্টিজানসহ বিভিন্ন ঘটনা আমাদের মাঝে এক ভংকর আতঙ্ক এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করে দিয়েছে। বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িকতাকে ধ্বংস করার আরেকটি চক্রান্ত হলো এই জঙ্গিবাদী আগ্রাসন। কিন্তু এসবের পরিত্রাণ তেমন মেলেনি। তরুণ প্রজন্মকে এই আগ্রাসন থেকে রক্ষা করবে কে? কীভাবে এরা এই আগ্রাসন থেকে মুক্তি পাবে, সেটা আমাদের সবার জানা বিষয়। এবার শুধু রাষ্ট্রকে এটা নিয়ে ভাবতে হবে।

বাংলাদেশে একসময় সবচেয়ে মেধাবী তরুণ ছেলেমেয়েরাই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতেন। সবচেয়ে মেধাবীরা সমাজে নানা ধরনের স্বেচ্ছাশ্রমের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতেন। একইভাবে সমাজও তাদের এই কাজের স্বীকৃতি দান করত। যে কারণে মেধাবীদের জায়গা সমাজের সর্বস্তরে ছিল। গান, কবিতা, আবৃত্তি, নাচ, খেলাধুলা, সাহিত্য আড্ডা, ছাত্ররাজনীতি সব কিছুতে তাদের ছিল প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের সব ক্ষেত্রে চরম দৈন্যতা লক্ষণীয়। না আছে খেলার মাঠ, না আছে পৃষ্ঠপোষক, না আছে সাহিত্য-আড্ডা, না সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলন।  

প্রগতিশীল রাজনীতিও আগের মতো শক্তিশালী নয়। যে কারণে সমাজের সব ক্ষেত্রেই জেঁকে বসেছে সুবিধাবাদ, ভোগবাদ আর আত্মকেন্দ্রিকতা। আর এর সব কিছুকেই বাংলাদেশের তারুণ্য ধারণ করছেন। অন্যদিকে রাষ্ট্র ও সরকার তরুণদের সঠিক মূল্যায়ন করছে না। যার কারণে তারা চলে যাচ্ছেন দেশের বাইরে।

আজকের তরুণরা দেশকে নিয়ে অনেক চিন্তা করছেন। প্রতিনিয়ত দেশের খবরা-খরব জানতে চেষ্টা করেন তারা। কিন্তু প্রশাসন, রাষ্ট্র তরুণদের নিয়ে কতটা ভাবে? বর্তমান তরুণ প্রজন্ম কাজে বিশ্বাস করে, কথায় নয়। আজ আমাদের দেশে গড় তরুণ বেকারের সংখ্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অধিক। এই বেকার তরুণদের চিন্তাচেতনা আর বুদ্ধি যদি কাজে লাগাতে পারে রাষ্ট্র, তবে বাংলাদেশ পরিণত হবে সোনার বাংলায়। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে তরুণ সমাজের বিকল্প নেই।

আজকের তরুণরাই আগামী দিনে দেশ পরিচালনা এবং বড় বড় কাজের নেতৃত্ব দেবে। এখন থেকে যদি তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়, তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আরো সুন্দর হবে। তাই দেশ গঠনে তরুণদের চাওয়াকে যেমন গুরুত্ব দিতে হবে, ঠিক তেমনি তাদের পর্যাপ্ত সুযোগও দিতে হবে। আজ দেশে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার তরুণ যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যাদের চাইলে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারে সরকার। এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে তরুণ সমাজকে।
 
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তরুণরা যত বেশি  পড়ালেখা করছে, তাদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আঞ্চলিক কর্মসংস্থান নিয়ে এক প্রতিবেদনেও এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এ অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দেশে তরুণদের বিশেষত শিক্ষিত তরুণদের এক বৃহদাংশ বেকার জীবনযাপন করছে এবং সেটা বেড়েই চলছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ বলছে, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ দুই বছরে মাত্র ছয় লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে অথচ এই সময়ে প্রতি বছর দেশের কর্ম বাজারে প্রবেশ করেছে প্রায় ২৭ লাখ মানুষ। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ লাখ। অথচ ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর চাকরি বা কাজ পেয়েছে ১৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষ।  

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ এর হিসাব বলছে, দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব অনুযায়ী, দেশে শ্রমশক্তির মোট পরিমাণ ৫ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজ করছে ৫ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার জন। এর অর্থ বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ ৮০ হাজার।

বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুইজনে একজনের নাম বেকারের খাতায় অন্তর্ভূক্ত।  

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছে, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। আইএলওর হিসাবটিকেই পর্যবেক্ষকেরা বাংলাদেশের প্রকৃত বেকারের সংখ্যা বলে মনে করেন।

উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যতটা আগ্রহী, কারিগরি বা কর্মদক্ষতা বাড়ানোর শিক্ষা নিতে তরুণরা ততটা আগ্রহী নন। দ্বিতীয়ত, খুব কম ক্ষেত্রেই কাউকে উদ্যোক্তা হতে দেখা যায়। সবাই চাকরির প্রত্যাশা করেন, কেউ চাকরি সৃষ্টির কথা ভাবেন না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে চাকরির আশায় দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করা এখন সাধারণ বিষয়। সরকারের উচিত বছর বছর নতুন প্রতিষ্ঠান না করে সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করে দক্ষ জনসম্পদ ও উদ্যোক্তা তৈরিতে জোরালো ভূমিকা রাখা।

২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এক পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে, বাংলাদেশে শতকরা ৪৭ ভাগ গ্র্যাজুয়েট হয় বেকার, না হয় তিনি যে কর্মে নিযুক্ত এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। প্রতি বছর বাংলাদেশে ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ চাকরি বা কাজের বাজারে প্রবেশ করছেন। এই বিশালসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষের মাত্র সাত শতাংশ কাজ পাবেন। এর অর্থ হচ্ছে, দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বেকারের তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন।  

দরিদ্র সমাজে চারিত্রিক ও মানসিক; জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি করতে হলে সত্যিকারের শিক্ষা নিতে হবে। দৃষ্টি করতে হবে প্রসারিত। ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে বিশ্বের বিশালতায় উন্মুক্ত করতে হবে নিজেদের। আর আনন্দ মনে তরুণরা এগিয়ে গেলে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

পরিচিতি: লেখক ও সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।