ব্রিটিশ আমলে আমার বাবা ইন্টারমিডিয়েট পাস করে মাত্র ২৬ টাকা বেতনে শিক্ষকতার মহান পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন। সে আমলে ইচ্ছে করলে তিনি অনেক ভালো চাকরি বাগিয়ে নিতে পারতেন।
অথচ একজন শিক্ষকের পুত্র হয়েও শিক্ষকদের অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে আমাকে আজ কলম ধরতে হচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, দুর্নীতির আখড়া হয়ে ওঠা বিভিন্ন সংস্থার সাথে পাল্লা দিয়ে শিক্ষাঙ্গনও আজ নির্লজ্জভাবে এগিয়ে চলেছে। শিক্ষক সম্প্রদায় বা শিক্ষাঙ্গন যখন দুর্নীতির বেড়াজালে হাবুডুবু খায় তখন সে দেশে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। এ দীনতা কাটিয়ে না ওঠা পর্যন্ত জাতির আর রক্ষা নেই।
সাম্প্রতিককালে শিক্ষাঙ্গনে অনিয়ম, শিক্ষকদের অনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ও নানা অনাচার এখন মুখরোচক গল্পের উপাদান হয়ে উঠছে। ছাত্রীর প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া, ছাত্রীদের কু-প্রস্তাব দেওয়া, ছাত্রী ধর্ষণ বা পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত হওয়া, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রীদের প্রতি শিক্ষদের যৌন হয়রানিমূলক আচরণ থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই যা করতে কিছু এক শ্রেণীর শিক্ষকের রুচিতে বা বিবেকে বাধে। এসবের ফলে কলঙ্কিত হচ্ছে গোটা শিক্ষকসমাজের ভাবমূর্তি আর বদনাম হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনের।
আজকাল পাইভেট টিচিং ও কোচিং-এর নাম করে কিংবা ভর্তির সময় কৃত্রিম জটিলতা সৃষ্টি করে অভিভাবকের কাছ থেকে ডোনেশনের কথা বলে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অন্যায় ও অবৈধ কালচার শুরু হয়েছে। ব্যাপারটা আজকাল ওপেন সিক্রেট। অনিয়ম থেকে বাদ যায়নি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এবং এক সময়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে দুনিয়াজোড়া খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ো। কিছুদিন আগে ঢাবির “গ” ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে হয়ে হয়ে গেল রীতিমতো নাটক। ব্যাপারটা আদালত পর্যন্ত গড়াল। সর্বোপরি বিষয়টি নিয়ে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলো তা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গোটা জাতির জন্যই লজ্জার কলংকের।
এইতো সেদিন মিরপুরের মনিপুর স্কুলে ডোনেশনের নামে টু পাইস কামানোর রহস্য উন্মোচন করতে গেলে মিডিয়াকর্মীদের উপর সরকার দলীয় দাপুটে সাংসদ কামাল মজুমদার সহ শিক্ষকরা যেভাবে পেটোয়া বাহিনীর মতো চড়াও হলেন তাতে সবাই হতবাক।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাম্প্রতিক সময়ে এরকম কতো শত অনাচার, অনিয়ম, অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই তালিকায় এবার নাম লেখাল ঢাকা সিটি কলেজ সম্প্রতি বিবিএতে ভর্তির জন্য চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পাওয়া বহু মেধাবী শিক্ষার্থীকে ভর্তি না করে। নৈতিকতা বিবেক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কলেজ কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে---এই অভিযোগ অনেকের। বিশেষত অনেক অভিভাবক ও ভুক্তভোগীর জানিয়েছেন তাদের অসহায়ত্ব ও ক্ষোভের কথা।
গত ১৫ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে প্রতিষ্ঠানটিতে বিবিএতে ভর্তির লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের জন্য ১৭ জানুয়ারি ২০১২ ডাকা হয়। সেখান থেকে বাছাইপর্বের মাধ্যমে মোট ৪০০ শিক্ষার্থীকে মেধা তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করা হয়। ১৯/০১ ও ২১/০১/২০১২ অর্থাৎ এ দুদিন ভর্তির চূড়ান্ত তারিখ বলে তাদের নোটিশ দিয়ে জানানো হয়।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, মেধাতালিকায় স্থান করে নেয়া কম করে হলেও ৪০/৫০ জন শিক্ষার্থী ২১/০১/২০১২ তারিখে ভর্তি হওয়ার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে গেলেও ভর্তি না হতে পেরে বিরস মুখে বাড়ি ফিরেছে। কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ১৯/০১ তারিখেই রক্ষিত ৪০০ আসনে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে গেছে। তাদের মতে, ওইদিন যারা ভর্তি হতে কলেজ ক্যাম্পাসে এসেছে তাদেরকেই একটি স্লিপ (টোকেন) দেয়া হয়েছে। এই টোকেনের মাধ্যমে তারা ব্যাংকিং লেনদেন সেরে ভর্তি কার্যক্রম সেরে নিতে পারে। অথচ টোকেন সংগ্রহ করতে যারা পারেনি তাঁরা মেধা তালিকায় টিকেও ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়, বিষয়টি এরকম: ভর্তির জন্য দুদিন ধার্য করা হয়েছে। অথচ বাস্তবতা হলো, ১৯/০১ বৃহস্পতিবার যারা টোকেন সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা পরবর্তী দুদিন ২০/০১, ২১/০১ অর্থাৎ শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। এর মানে তাদের পক্ষে ২১/০১/১২ শনিবার ভর্তি হওয়াও সম্ভব নয়। সুতরাং এসব মেধাবী শিক্ষার্থীর স্থলে যদু-মধু-রাম-শ্যাম যে কাউকে ভর্তি করতে কর্তৃপক্ষের সামনে আর কোনো বাধা বা অসুবিধে নেই।
বাহ চমৎকার! ভর্তির তারিখ চূড়ান্তকরণে কর্তৃপক্ষের এই আচরণ বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায় তা হল, যে কোনও কলেজ বা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য মাত্র দুদিন মোটেও যথেষ্ট সময় নয়। যেহেতু শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং ভর্তি কার্যক্রমের সাথে ব্যংকিং লেনদেনের একটি সম্পর্ক আছে সেহেতু ২১/০১ অর্থাৎ শনিবারকে গণ্য না করাই সমীচীন। সে হিসেবে দুদিন নয়, ভর্তির জন্য ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ দেয়া হয়েছে মাত্র একদিন। তাছাড়া টোকেন সংগ্রহ করে ব্যাংকিং লেনদেন সারার ব্যাপারেও নোটিশে কোনও কিছু উল্লেখ নেই। কিংবা মৌখিকভাবে খোলাসা করে কাউকে কিছু জানানো হয়নি এ ব্যাপারে। তাই ছাত্রছাত্রীরা ক্যাশ লেনদেনের মাধ্যমেই ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারবে বলে ধারণা করেছিলো। কিন্তু শিক্ষকদের নেতিবাচক কথাবার্তায় ভর্তিবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের বুঝতে মোটেও অসুবিধে হয়নি যে, তাদেরকে বাদ দিয়ে মেধাতালিকার ধারে কাছেও যারা আসেনি তাদের প্রতি ফন্দিবাজ কতৃপক্ষের দরদের পেছনে আছে উৎকোচ আদায়ের এক অভিনব ধূর্ত এক কৌশল।
বঞ্চিত শিক্ষার্থী ও অভিবাবকবৃন্দের ক্ষোভ মেশানো প্রশ্ন- ২১/০১/১২ তারিখ ভর্তির নির্ধারিত শেষ দিন হওয়া সত্ত্বেও কেন তাদেরকে ওইদিন ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়নি? তাদের জন্য ওই নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে কোন বিবেচনায় অনির্বাচিতদের ভর্তির সুযোগ দেওয়া হলো? আর এভাবেই যদি নির্বিচারে ভর্তির ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন করা হবে তবে কেন লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা তালিকা প্রণয়নের নাটক সাজানো হল? ভর্তির আবেদনপত্রের ফি হিসেবে ২৬০ টাকা আদায়ের মাধ্যমে কেন অসহায় ছাত্রছাত্রীদের সাথে এভাবে প্রতারণা করে তাদের মানসিক ও আর্থিকভাবে হয়রানি করা হলো?
ভর্তিবঞ্চিতদের একজন আমার বোন। প্রবাসী অভিভাবক হিসেবে আয়ারল্যান্ড থেকে দু’তিনবার ফোন করেও কলেজের অধ্যক্ষ শাজাহান খানের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলার মুযোগ পাইনি। আমার বোনকে তিনি বলেছেন, যারা আগে এসেছে তাদেরকেই ভর্তি করা হয়েছে। অনেকটা যেন “আগে এলে আগে পাবে” ভিত্তিতেই ভর্তির কাজটা তাঁরা সম্পন্ন করেছেন। অধ্যক্ষের এ কথা শুনে মনে হয় “ভর্তি পরীক্ষা”, “মেধা তালিকা প্রণয়ন” এ বিষয় গুলোর আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা কেবলই যেন “উৎসব” পালনের জন্য।
উপসংহারে বলতেই হয়, সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ বিবিএ ভর্তি নিয়ে যে নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছে তা সরলমতি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি একান্তই অন্যায়, অবিচার ও অবিবেচনাপ্রসূত। আমরা আশা করবো, বাদ পরে যাওয়া এসব মেধতালিকা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দান করার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ তাঁর ন্যূনতম মানবিক বিবেচনা দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা ও সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হবেন। অন্যথায় এ অন্যায়ের প্রতিবাদে যদি শিক্ষার্থীরা নিকট হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয় তাতেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
[email protected]