ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রাজনীতিতে সামনে আরও খেলা আছে

পীর হাবিবুর রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০২১
রাজনীতিতে সামনে আরও খেলা আছে

পর্দার আড়ালে রাজনীতিতে নানা গুঞ্জন, হিসাব-নিকাশ চলছে। বিএনপির দন্ডিত চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ শরীর নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন- এমনটা নিশ্চিত জেনে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টি নতুন করে নিজেদের পথ নির্ধারণ করছে।

অর্থাৎ বিএনপির সরকারবিরোধী রাজনৈতিক ময়দানের জায়গাটি নিজেরা দখলে নিতে চাইছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের পরিষ্কার বলেছেন, তারা আর মহাজোটে নেই। পার্টির কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদসহ নেতারা এখন এক হয়ে গেছেন। জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু সরকারবিরোধী সমালোচনায় বক্তৃতা-বিবৃতিতে মুখর। নেতারা তৃণমূল নেতা ও সমন্বয়কারীদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে তাদের অবস্থান খোলাসা করেছেন। এমপিদের সঙ্গেও নেতাদের বৈঠক হয়েছে কয়েক দফা। বলা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত ইতিহাস এবং অবস্থান বাদে সরকারের যে কোনো কর্মকান্ডের সমালোচনা তারা করতে পারবেন।

জাতীয় পার্টি মনে করে, বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ বিভ্রান্ত না হলে, ভুল না করলে সংসদে এখন তাদের আসন সংখ্যা আরও বেশি থাকত। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচনে তারা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চান। শক্তিশালী অবস্থান নিতে চান।

জাতীয় পার্টির নেতারা মনে করেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশের বাইরে চলে গেলে লন্ডনে নির্বাসিত দন্ডিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সেখান থেকে যতই দল চালাতে যান না কেন, এখানে নেতা-কর্মীরা আরও মানসিকভাবে দুর্বল হবেন। বিগত নির্বাচনে যেমন তারা ক্যারিশমা দেখাতে পারেননি তেমনি আগামীতে ফল আরও বিপর্যয়কর হবে। বিএনপি টানা ১৩ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় এবং মামলার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়ায় নেতা-কর্মীরা সংগঠন গোছাতে পারেননি। মাঠের বিএনপি যেমন দুর্বল তেমনি দলের নীতিনির্ধারকরাও অসহায়। এ অবস্থায় জাতীয় পার্টির সামনে সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে। জাতীয় পার্টির এ অভিলাষযাত্রার নেপথ্যে কোনো শক্তি বা সরকারের সমর্থন আছে কিনা তা জানা যায়নি। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ এককভাবেই সরকার গঠন করেছে। এখানে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসন দেওয়া হলেও ১৪ দলের শরিকদেরও সরকারে ঠাঁই দেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে ১৪ দলের প্রার্থীরা নৌকা নিয়ে জোটগত নির্বাচন করবেন, নাকি আলাদাভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থনে সংসদে আসবেন এটা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে ১৪ দলীয়ভাবেই আসার সম্ভাবনা বেশি।
পর্যবেক্ষকরা বলে আসছেন বিগত জাতীয় নির্বাচনে একদিকে শেখ হাসিনার দেশজুড়ে উন্নয়নের মহা-কর্মযজ্ঞ, অন্যদিকে সাংগঠনিক তৎপরতায় সরগরম আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপি ভোটের ময়দানে ছিল একদম দুর্বল, অগোছাল ও গণবিচ্ছিন্ন। নেতা-কর্মীরা অনেকেই ছিলেন মামলাজালে আটকা। এমনি অবস্থায় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আরেকদিকে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে রেখে নির্বাচনের যে লড়াই তা ভোটারদের মাঝে প্রভাব ফেলা দূরে থাক রাজনীতিতে সার্কাস তৈরি করেছিল। প্রশাসন অতি উৎসাহী ভূমিকা না নিয়ে নির্বাচন কমিশন যদি গ্রহণযোগ্য বিতর্কমুক্ত নির্বাচনও দিত তাহলে বিএনপি ৪০টির বেশি আসন পেত না। এতে বিরোধী দল নিয়ে সংসদ প্রাণবন্ত থাকত। তবে সেখানে অন্য কোনো হিসাব কাজ করেছে কিনা তা গভীরভাবে এখন অনেকেই চিন্তা করছেন। দিনে দিনে বিএনপিকে যেখানে নেওয়া হচ্ছে, যে শক্তিক্ষয় ঘটানো হয়েছে তাতে অনেকের ধারণা, বিএনপির রাজনীতি প্রায় নিঃশেষ করে দেওয়ার পরিস্থিতিই তৈরি হচ্ছে।

বিএনপির অভ্যন্তরেও নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ, হতাশা চরমে। নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, দলকে ঢেলে সাজানো এবং কর্মপরিকল্পনা তৈরিতে তাদের মতামত উপেক্ষিত হচ্ছে। লন্ডন সদর দফতর থেকে যে বিতর্কিত বক্তব্য আসে তা নিয়ে কঠিন দুঃসময়েও এখানে বিএনপি নেতৃত্বকে হোঁচট খেতে হয়। তাই বলে আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তি বা প্ল্যাটফরম বলে দীর্ঘদিন রাজনীতির ময়দানে দাপুটে অবস্থান বহাল রাখা বিএনপিকে কি আদৌ দিনে দিনে নিঃশেষ করা সম্ভব? এমন প্রশ্ন নিয়ে পর্যবেক্ষক মহলে রয়েছে বিতর্ক। অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টির জায়গা দখল বা উঠে আসার চেয়ে ভঙ্গুর বিএনপির অবস্থান বহাল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ দলটির জনপ্রিয়তা আছে। এ ক্ষেত্রে অনেকে মনে করেন, বিএনপির জনপ্রিয়তার উৎস গণতান্ত্রিক আন্দোলনে উঠে আসা নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি যেখানে অসুস্থ শরীর নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন আর তার উত্তরসূরি তারেক রহমান দন্ডিত এবং বহুল বিতর্কে বিতর্কিত হয়ে লন্ডনে নির্বাসিত সেখানে বিএনপিকে নতুন করে ঘুরে দাঁড় করানোর নেতৃত্ব কই। সরকারও যে মামলা-মোকদ্দমা থেকে নেতা-কর্মীদের সহজে ছাড় দেবে বা আন্দোলন নিয়ে মাঠে গড়াতে সুযোগদান করবে সে আলামত দেখা যাচ্ছে না। সংসদে বিএনপি সদস্যদের কথা বলতে যেখানে কোনো বাধাই দেওয়া হচ্ছে না, চাইলেই সময় দেওয়া হচ্ছে তেমনি মাঠে নামতে গেলেই পুলিশের অ্যাকশন। এর মধ্যে দলে দলাদলি, কমিটি বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্য যেমন রয়েছে তেমনি ব্যর্থ নির্বাচন কমিশনের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও তৈরি করেছে চরম প্রতিকূল পরিবেশ। বিএনপি শেষ পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা যৌক্তিক কিনা তা নিয়েও আলোচনা হবে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জনের বড় ধরনের খেসারত দলটিকে দিতে হয়েছে।  বিএনপিকে নিঃশেষ করার প্রক্রিয়া সেনাশাসক এরশাদ আমলেই সৃষ্টি হয়েছিল। সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের ট্র্যাজিক হত্যাকান্ডের পর বিচারপতি সাত্তার সরকার আমলে চরম ব্যর্থতা, কোন্দল, আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসেন সেনাশাসক এরশাদ। মার্শাল ল জারি হয়। সে সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫-দলীয় জোটের পাশাপাশি অসীম ধৈর্য নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া সাতদলীয় জোটের নেতৃত্ব দিতে রাজপথে নামেন। বিএনপির বড় বড় নেতা-মন্ত্রীরা এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। বিএনপি ভেঙেচুরে চুরমার হলেও তারুণ্যের শক্তি ছাত্রদলের ওপর ভর করেই খালেদা জিয়া সেদিন গণতন্ত্রের নেত্রী হন।

’৯০ সালে এরশাদের পতনের পর ’৯১ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা যেখানে আদর্শিক দলের পোড় খাওয়া নেতাদের মনোনয়ন দেন সেখানে নেতৃত্বহীন বিএনপি ব্যবসায়ী আর সামরিক শাসকদের আজ্ঞাবহ সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে দেন ধানের শীষ। এরশাদের জাতীয় পার্টিকে কোনো ছাড় না দেওয়ার নীতি, অসংগঠিত আটদল, বাইরে থাকা পাঁচদলীয় বামজোট- সব মিলিয়ে নির্বাচনী ফলাফল ছিল হিসাবের বাইরে। যেখানে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত ক্ষমতায় আসার কথা, সেখানে জামায়াতের সমর্থনে ক্ষমতায় এলো বিএনপি। রাজনীতিতে তার অবস্থান আওয়ামী লীগবিরোধী মত হিসেবে শক্তিশালী হলো। আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের শক্তি হয়েই থাকল আর বিএনপি আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তির ঠিকানা। পরের ইতিহাস সবার জানা।

’৮৪ সালের উপজেলা নির্বাচন তুমুল আন্দোলনের মুখে বাতিল করতে হলেও ’৮৫ সালে সেটি সেনাশাসক এরশাদ করতে সফল হন। সেই সময়ের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদ আমাকে একবার বলেছিলেন, এরশাদের সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান জেনারেল চিশতি এক বৈঠকে ভীষণ দাপুটে কথাবার্তা বলছিলেন। সামাদ আজাদ অনেকের সঙ্গে বসে চুপচাপ শুনছিলেন, চিশতি বিএনপিকে শেষ করে দেওয়ার ফিরিস্তি দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে সামাদ আজাদ বললেন, জেনারেল সাহেব রাজনীতির বেলা অনেক হলো। অনেককাল, অনেক কিছুই দেখেছি। যত যাই বলুন, আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তি বেগম সাহেবার (খালেদা জিয়ার) আঁচলেই বাঁধা থাকবে। সে সময় বলা হতো চিশতি প্রবেশ করলে মন্ত্রীরাই নন, তাদের চেয়ারও দাঁড়িয়ে যেত। এতটাই দাপুটে ছিলেন। আওয়ামী লীগ রক্তাক্ত আগস্টের পর কঠিন বৈরী দুঃসময় নিপীড়ন ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে যেভাবে ২১ বছর রাজনীতিতে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে সেখানে বিএনপি ১৩ বছরে কিছুই দেখাতে পারেনি। ক্ষমতার বাইরে কদিন পারবে তাও বড় প্রশ্ন। বড় প্রশ্ন তার নেতৃত্বহীনতা। যাক, এখন বিএনপির পরিণতি সামনে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা দেখার বিষয়। আর এতটা ক্ষয়ে যাওয়া জাতীয় পার্টি কীভাবে বিএনপির জায়গা সংসদে দখল করে আসে তাও ভাবার বিষয়। তবে রাজনীতিতে সামনে যে আরও খেলা বাকি তার আলামত দেখা যাচ্ছে। জন্ম থেকে যে বিএনপি ইতিহাসের মীমাংসিত সত্যকে অস্বীকার করেছে, ইতিহাস বিকৃতি করেছে সেই বিএনপি আজ ৭ মার্চ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আওয়ামী লীগ অভিনন্দন জানিয়েছে। একেই বলে সত্য কখনো চাপা দিয়ে রাখা যায় না। বিএনপি ইতিহাসের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছে। এটা ইতিবাচক, এই সময়ে।

২. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশের জনগণকে আরেকটি আনন্দ সংবাদ দিয়েছেন। ছোটবোন শেখ রেহানা তাকে এ বিরল কৃতিত্বের খবর দিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি সংবাদ সম্মেলন করেন। শেখ রেহানা তখন তার পাশে ছিলেন। মঞ্চের একপাশে ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং আরেক পাশে ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল)। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করেছে। জাতিসংঘ এ সুপারিশ করেছে। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের এক যুগে ধাপে ধাপে নানা প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে যে অর্জন এনেছেন  দেশের জন্য এ এক বিরল কৃতিত্ব। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ এখন মর্যাদাশালী সম্মানিত দেশ। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মার্কিন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার একদিন বৈরী মনোভাব নিয়ে যে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন, জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা তা অসার প্রমাণ করে দেশকে উন্নয়ন-অগ্রগতির মহাসড়কে নিয়ে পশ্চিমাদের কাছে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন। আজ স্বপ্ন তার হাতের মুঠোয়। দেশের রাজনীতি হরতাল-অবরোধ-সহিংসতা মুক্ত, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে সাহসী সাফল্যের মুকুট পরে শেখ হাসিনা এ অর্জন করেছেন। শেখ হাসিনার পাশে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী থেকে নিম্ন ও মাঝারি আয়ের ব্যবসায়ীরাও সমর্থন দিয়েছেন। পর্যবেক্ষকদের অনেকে বলছেন, কেবল দক্ষিণ এশিয়ায়ই দেশকে উঁচু করেননি। করোনার মহাবিপর্যয়কালে পশ্চিমা দুনিয়ার অর্থনীতিও যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে সেখানে শেখ হাসিনা দেশের অর্থনীতির হাল শক্তভাবে ধরেই করোনার চ্যালেঞ্জেও সাফল্য এনেছেন। সংবাদ সম্মেলনে একসময় এক যুগের বেনিফিশিয়ারিরা তৈলাক্ত ভাষণ দিয়ে আমেজ নষ্ট করতেন। সমালোচনার মুখে অনেকে মুখে লাগাম টেনেছেন। কিন্তু সবাই কি আর পারে? স্বার্থে লাভে-লোভে প্রশ্ন বাদ দিয়ে তারা তাদের মতো বয়ান দেন। তাই বলে পেশাদাররা বসে থাকেন না। তারা প্রশ্ন করেন। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন পছন্দ করেন। যারা প্রশ্ন করেছেন আলজাজিরা থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে প্রশ্নের জবাবও দিয়েছেন। মিডিয়াবান্ধব শেখ হাসিনা প্রশ্ন ছুড়লেই দ্রুত জবাব দেন। কিন্তু এক যুগে এমন আদম জন্ম নিয়েছেন গণমাধ্যমে যে নিজেদের আখের গোছাতে সংবাদ সম্মেলনে অভিনব ভাষণ চালু করেছেন। এ নিয়ে তাদের গ্লানি বা লজ্জা নাই থাকল।

যাক, সবাই জানেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নকশা বারবার আঁকা হচ্ছে। বাংলাদেশকে উন্নয়নের যেখানে নিয়ে গেছেন তা নিয়ে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তান নামের শত্রুরাষ্ট্রই নয়, বন্ধুরাষ্ট্র ভারতেও আর্তনাদ চলছে। তাদের সরকারকে তুলাধোনা করছে বিরোধী দল থেকে গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটি। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উন্নয়নের যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা অনেকের কাছে ঈর্ষার কারণ হতে পারে, অপরাধ হতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিশাল গৌরবের।

৩. সম্প্রতি কাশিমপুর কারাগারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক মুশতাকের মৃত্যুর পর একটা মৃদু ঝড় বয়ে গেছে। ১০ মাস আটক থাকার পর মৃত্যুর কারণ তদন্ত করে দেখা হবে বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বাম ছাত্র সংগঠন আর ছাত্র অধিকার পরিষদের মশাল আন্দোলনে পুলিশের আক্রমণ হয়েছে। দুই পক্ষ যার যার বক্তব্য দিয়েছে। মানুষ যা দেখার দেখেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে নিরাপত্তা আইন থাকবে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। শুরু থেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বিতর্ক আছে। পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি আছে। এমনকি এর অপপ্রয়োগ বা অপব্যবহার যাতে না হয় সে কথাও বলা হয়েছে। আইনমন্ত্রী পুনর্বিবেচনার কথা বিভিন্ন সময় বললেও তা আর বিবেচিত হয়নি। তবে সংবিধান যেখানে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে, বাক ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে সেখানে এমন আইনের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই বলেছি। সম্পাদক পরিষদ আইনের কালো ধারাগুলো বাতিলের সুপারিশ করেছিল, তা হয়নি। ’৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ২১ বছর আওয়ামী লীগকে নিপীড়ন ভোগ করতে হয়েছে। বিএনপি জমানায় বিরোধী দলের প্রতিবাদের মুখে সন্ত্রাসবিরোধীসহ পাস করা নিবর্তনমূলক আইনে এখন তাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে গেলে হবে না, গণমাধ্যমের গলা চেপে ধরবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? বিদেশে পাড়ি দিয়ে ঘেউ ঘেউ করা জামায়াতি অর্থে লালিতরা ইউটিউব চ্যানেলে কীভাবে নোংরামি মিথ্যাচার করেছে তাদের বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফেসবুক ইউটিউব থেকে যে কোনো বিকৃত মিথ্যাচারের ডিজিটাল সন্ত্রাস মুছে ফেলা যাচ্ছে না। মুশতাকের সহযোগী কিশোর অসুস্থ। জামিন নেই। আটবার জামিন চেয়েও মুশতাকের জামিন মেলেনি। এদের সঙ্গে জড়িত অনেককে পুলিশ অব্যাহতি দিল কীভাবে? অনেকের জামিন মিলল কীভাবে?

মুশতাকের আটক, কারাভোগ ও মৃত্যু কি সরকারের ইমেজ বাড়িয়েছে? নাকি আঁচড় বসিয়েছে? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ পর্যন্ত যারা সারা দেশে নাজেহাল হয়েছেন তাদের মধ্যে মাঠের সংবাদকর্মী কতজন? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাঠকের প্রতিক্রিয়া কোন দিকে ঝুঁকছে এটা কি সরকারের ডিজিটাল মন্ত্রী-কর্তারা দেখছেন? সবাই তো আর অন্ধ জামায়াত-বিএনপি নয়! কথায় আছে অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না।

এ রাষ্ট্র রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জন্ম নিয়েছে। রাষ্ট্র কি কোনো দায় এড়াতে পারে? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে দেশের জন্ম সেটি তো মানবিক রাষ্ট্র হবে। জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের চুক্তিনামা সংবিধান। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন আইন কি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় থাকতে পারে? সরকারসহ সবাইকে ভাবতে হবে।

৪. আজকের লেখা শেষ করতে চাই গভীর বেদনার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে। দেশের অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজার নিয়ে তার যে সাহসী ভূমিকা তা স্মরণীয়। একজন দেশপ্রেমিক সাহসী অর্থনীতিবিদের এই মৃত্যুর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। লেখক-সাংবাদিক-কলামিস্ট-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের মৃত্যুও আমাদের ব্যথিত এবং শোকার্ত করেছে। এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। সুনামগঞ্জের প্রিয় অগ্রজ বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক-গবেষক, রাজনীতিক, সমাজ আলোকিত করা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরুর অকালমৃত্যু শহরকে শোকস্তব্ধ করেছে। মনে পড়ে ’৮৪ সালে রেহান উদ্দিন আহমেদ রেজুর নেতৃত্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠার সময় খসরু ভাইয়ের কাছ থেকে তার সাপ্তাহিক সুরমার আইডি কার্ড নিয়েছিলাম। দেশে দিন দিন ভালো মানুষ কমে যাচ্ছে। আল্লাহ তাদের জান্নাত দিন।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০২১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।