আলোর কথা বলে প্রথম আলো নিজেই যে এতোটা ‘ঘাঁটিয়া’ অন্ধকারে বসবাস করছে তা আগে জানা ছিলো না। বাংলানিউজে প্রকাশিত প্রথম আলো বিষয়ক ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলো পড়ে তা সম্যক উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম।
ছোট বেলায় রচনা পড়তে গিয়ে শিখেছিলাম, সংবাদপত্র সমাজ বদলের হাতিয়ার। কিন্তু আজকাল হলুদ সাংবাদিকতার পাশাপাশি কিছু কিছু সংবাদপত্রের অসচ্ছতা, অনিয়ম, স্বার্থান্বেষী মনোভাব ও সর্বোপরি নিজের মতো করে যত্রতত্র এর অপপ্রয়োগ প্রভৃতি বিষয় দেখে এ কথা বলতেই হয়, সংবাদপত্র যেন এখন আর সমাজ বদলের হাতিয়ার নয়; অনেকটা ব্যক্তিন্নোয়ন বা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে সমৃদ্ধি লাভ করছে। বাংলানিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলোর সত্যতা স্বীকার করে নিলে এ কথা সহজেই বলা যায়, প্রথম আলোই এর সাম্প্রতিক সময়ের এক বিরাট উদাহরণ।
প্রথম আলো নিজে সমাজ বদলের গান গেয়ে বেড়ালেও মূলত সে বদল রেখাপাত করছে তার স্বীয় ভাগ্যন্নোয়নে কেবল। কিন্তু তার ভক্ত পাঠক যারা আছেন তারাতো এমনটি কখনো কামনা করেননি। আলো ছড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে যার আত্মপ্রকাশ, প্রতিদিন প্রভাতে ঘন সবুজের চির সৌন্দর্যের সমারোহে যার আবির্ভাবের কথা, হেমন্তের হলুদ বর্ণকে কাটিয়ে শীতার্ত বনে বসন্তের সজীবতা ফিরিয়ে আনা যার অঙ্গীকার ছিল সে কিনা আজ চারপাশ নিজেই দহন করে চলছে গ্রীষ্মের বারুদ জ্বালিয়ে!
জানি চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ থেকে পঙ্কিলতা বা কলঙ্ক স্পশর্হীনভাবে একটি কাগজ বের করা মোটেও সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। সে আশাও আমি করি না। কিন্তু তাই বলে একটি পত্রিকাকে ধারালো অস্ত্র ভেবে তা দিয়ে স্বীয় সম্পাদক থেকে শুরু করে সন্তানসন্ততি, জামাতা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন এমনকি অধিনস্থ কর্মচারী বা তাদেরও স্বজন বিভিন্ন ঘৃণ্য ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত হয়ে যে হীন মনমানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে তা সচেতন ব্যক্তি মাত্রই ঘৃণার উদ্রেক করে।
গতকাল (সোমবার) পর্যন্ত বাংলানিউজে প্রথম আলো বিষয়ক যে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তা আমি আলোচনার স্বার্থে পাঠককূলের সামনে তুলে ধরছি। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বিভিন্ন শিরোনামে বাংলানিউজে প্রথম আলো যেভাবে উঠে এসেছে তা হল- ওয়ান ইলেভেনের গুণগান গেয়ে যারা মোসাহেবি করেছে তাদের মধ্যে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিঊর রহমান অন্যতম। ১/১১এর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নিন্দিত সমালোচিত এ ব্যক্তিটির তখনকার ভুমিকা নিয়ে বাংলানিউজ প্রথমে ‘সহিহ মতিউরনামা’ ও ‘ওয়ান ইলেভেন ও কুশীলবরা’ নামে দু’টো প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তত্ত্বাবধায়ক আমলে দু’নেত্রীকে বাদ দেয়ার যে ম্যাকানিজম শুরু হয়েছিলো তাকে সমর্থন করে প্রথম আলো ‘সংস্কার করে নির্বাচন করতে হবে’ বলে যে মন্তব্য প্রতিবেদনের জন্ম দিয়েছিলো তাও বাংলানিউজের পাতায় শোভিত হয়েছে সুন্দরভাবে। ওয়ান ইলেভেনের গণতন্ত্র বিরোধী ভূমিকার জন্য বর্তমান সরকারের আমলে এক মিটিংএ প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান শরমিন্দা হয়ে দুঃখ প্রকাশ ও ভুল স্বীকার করলে বাংলা নিউজে শিরোনাম হয় এভাবে, “১/১১’র ঘষেটি বেগমের ভুল স্বীকার”। ঠিক একই দিনে ১/১১’র পঞ্চম বার্ষিকীর মূল্যায়ন নিয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সংবাদপত্রগুলো সরব থাকলেও প্রথম আলো রহস্যজনকভাবে নিরব ভূমিকা পালন করে। আর সে পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা নিউজ রিপোর্ট করে ‘প্রথম আলোর নীতি’ এ শিরোনামে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে জড়িয়ে প্রথম আলোর সংবাদ মিথ্যা ও অমূলক শিরোনামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ও খিলক্ষেতের একটি জমি সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে প্রথম আলোর ধারাবাহিক মিথ্যা খবর পরিবেশনের ফলে ‘প্রথম আলোর লাগাতার মিথ্যাচার’ নামে সংবাদ বাংলানিউজ প্রকাশ করে।
গোল টেবিল বৈঠকের নামে সিনিয়র সাংবাদিকদেরকে লেখালেখির মাধ্যমে সরকারকে চাপে রাখার জন্য মতিউর যে পরামর্শ দান করে তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলানিউজ যে রিপোর্ট করে তা হল ‘সরকারকে প্রেসারে রাখতে চায় প্রথম আলো’। মিশুক মনিরের দুর্ঘটনা কবলিত মৃত্যুতে জনমনে যে অসন্তোষ দানা বেঁধেছিল সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোর জন্য একজন স্বনামখ্যাত কলামিস্টকে দিয়ে যে অসৎ খেলা খেলেছিল তা জানাতে গিয়ে বাংলানিউজ ‘প্রথম আলোর আন্না হাজারে প্রকল্প’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
‘আমার মায়ের কান্নাও গলাতে পারেনি পাষণ্ড মতিউরকে’ শিরোনামে বাংলানিউজে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় কত হীনম্মন্যতার অধিকারী প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর। তত্ত্বাবধায়কের আমলে প্রথম আলাতে মুদ্রিত কার্টুনে মহানবীকে (সা.) ব্যঙ্গ করা হয়। এ ঘটনায় জনমনে যে অসন্তোষের হাওয়া লেগেছিল তা থেকে মুক্তি পেতে মতিউর তওবা-তাসিরের মাধ্যমে ক্ষমা ভিক্ষা চায় এবং কার্টুনিস্ট আরিফের প্রতি ন্যূনতম মানবতাবোধ না দেখিয়ে অন্যায়ভাবে তাকে প্রথম আলো থেকে বের করে দেয় এবং কৃতকর্মের ফল হিসেবে তাকে জেলে যেতে হয়। তখন তার মা মতিউরের কাছে সহযোগিতার জন্য গেলে কোনো রকম সহানুভুতি-ই তিনি দেখাননি। বর্তমানে নরওয়ে প্রবাসী আরিফ বাংলানিউজকে এক সাক্ষাৎকারে উপরোক্ত মন্তব্যটি করেন।
বিভিন্ন দেশিবিদেশি মানবহিতৈষী লোকদের কল্যাণে প্রথম আলো ট্রাস্ট নামে যে কল্যাণ ট্রাস্ট গড়ে উঠেছে তাও দুর্নীতিমুক্ত নয়। এর আলোকেই বাংলানিউজ ‘প্রথম আলো ট্রাস্টঃ অর্থ আছে, নেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা’ শিরোনামে একটি সংবাদ পরিবেশন করে।
প্রথম আলোর দাপট খাটিয়ে সম্পাদকের ছেলে শাশা বিভিন্ন দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার পাশাপাশি সর্ব:স্বান্ত করেছে অনেক ব্যবসায়ীকে। প্রথম আলোর থাবার কাছে জীবনের সমস্ত অর্জন হারিয়ে কোন এক ব্যাবসায়ী হয়েছেন বাকহীন। তাইতো বাংলানিউজ সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছে, ‘পুত্রকেই বদলাতে পারছে না মতিউর’। শুধু তাই নয়, মতিউর রহমানের অর্ধ শিক্ষিত জামাতাও (মেয়ের জামাই) বাড়িভাড়া আদায়ে অন্যায্য আচরণ বা অবৈধভাবে অন্যের জমি দখলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রথম আলোর প্রভাব খাটানোর ঘটনা বাংলানিউজের অনুসন্ধানী দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারেনি।
একজন ব্যবসায়ীকে ভুল চিকিৎসার মাধ্যমে মেরে ফেলার পর ‘চোরের মার বড় গলা’ জাতীয় কণ্ঠে ডাক্তার ফাতেমা মৃত ব্যক্তির স্বজনদের হুমকি ধামকি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি। এক পর্যায়ে তাদের তিনি প্রথম আলোর একজন উপসম্পাদকের বোনের গর্বে গর্বিত হয়ে বলেছেন, ‘সাংবাদিকরা আমার কী করবে? আমি আনিসুল হকের বোন, প্রথম আলো আমার পক্ষে। ’ যার প্রেক্ষাপটে বাংলানিউজ গত ২৮/০১/১২ তারিখে ‘ডা. ফাতেমার দাপটঃ প্রথম আলো আমার পক্ষে’ শিরোনামে একটি সংবাদ পরিবেশন করে।
কপিরাইট আইনের প্রতি তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে প্রথম আলো পূর্বে অন্যজন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন তথ্যাদি অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু চিঠি নিজেদের প্রকাশনার মাধ্যমে ছাপিয়ে ব্যবসা করার জন্য যে অন্যায় পথ অবলম্বন করেছে তার আলোকে বাংলানিউজ প্রথম আলোকে ‘মিডিয়া মাফিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন ছাপে। মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি বিষয়কে নিয়ে ব্যবসা করতেও ওদের বিবেক কেঁপে ওঠেনি।
এখন আমার প্রশ্ন- প্রথম আলো বা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ যে অন্যায় ও অনৈতিক ক্রিয়াকলাপ করে যাচ্ছে তা বাংলানিউজ অকপটে ক্রমাগত জনসমক্ষে তুলে ধরছে। এ ব্যপারে প্রথম আলোর কোন প্রতিক্রিয়া বা বাংলানিউজের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখি না। এ নিরবতার রহস্য কি? তবে কি ধরে নেব, নিরবতাই সম্মতির লক্ষণ? বাংলানিউজ যা প্রকাশ করছে তা সবই সত্যি! আর যদি তাই হয়, তাহলে কেবল বাংলানিউজকে কেন একা এ ব্যাপারে অগ্রণী ভুমিকা পালন করতে হচ্ছে? অন্যান্য সংবাদপত্রের ভুমিকা কোথায়? সুশীল সমাজসহ বুদ্ধজীবী বলে খ্যাত একটি ঘরানার অতীব জ্ঞানী ব্যক্তিরা মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন কোন বিবেচনায়?
ওদের কথা না হয় বাদই দিলাম। অবিচার, অনিয়ম, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ থেকে শুরু করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত যে প্রতিষ্ঠানটি তার বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সরকারকে দেখা যাচ্ছে না। প্রথম আলোর প্রতি সরকারের দুর্বলতা কোথায়! নাকি প্রথম আলোর হাত অনেক অনেক লম্বা যে হাতের কাছে সরকার নিজেও অসহায়!
লেখকঃ আয়ারল্যান্ড প্রবাসী
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, ৩১ জানুয়ারি, ২০১২