ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মৃত্যুমাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন প্রাণ

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৯ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০২১
মৃত্যুমাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন প্রাণ

“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি, চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। ”
                            - জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব-এঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে ১১১ বৎসর পূর্বে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ রচিত পঙক্তিমালার সাহায্যে নিবন্ধের শিরোনাম সাজাতে হলো।

সত্যিই তাঁর মৃত্যুমাঝে ঢাকা পড়েছে এক অন্তহীন প্রাণ। জীবনভর বেগম মুজিব যেভাবে আত্মস্বার্থ বিসর্জন করে নিজ জীবনকে পরার্থে উৎসর্গ করে গেছেন তা এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অসাধারণ দিকদর্শী চিন্তাচেতনার ফলে বাঙালী জাতি যে কতবার উপকৃত হয়েছে তা আমরা উপলব্ধি করি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরল ইসলামের ‘নারী’ কবিতা তাই আজ আমাদের স্মৃতিতে বারবার ভেসে আসে।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৩০ সনের ৮ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম রেণু। শৈশবেই তিনি পিতৃহারা হন। মাত্র তিন বছর বয়সে পিতা শেখ জহুরুল হক পরলোক গমন করেন। মাতৃসান্নিধ্যও তাঁর জীবনে স্থায়ী হয়নি। শিক্ষাজীবন শুরু হয় গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে। কিন্তু তা দীর্ঘায়িত হয়নি। কৈশোর অতিক্রমের পূর্বেই তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায় সূচনা হয়। তৎকালীন প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্রনেতা, বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নিবেদিত প্রাণ তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তিনি শৈশবেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। লক্ষণীয়, যে বয়সে বাংলার মেয়েরা পুতুল খেলে, দাদা-দাদি, নানা নানি ও বয়স্কদের কাছ থেকে রূপকথা, পুঁথিপাঠ, বিবিধ লোককাহিনি শোনে, সে বয়সে সবার অজান্তেই বিধাতা রেণুকে ভিন্নভাবে বিকশিত করতে চেয়েছেন। তিনি লাভ করেছেন একান্নবর্তী পরিবারের গার্হস্থ্য দায়িত্ব। এ-শিক্ষা কেউ তাঁকে দেয়নি। সংসারধর্ম সম্পাদন, পরিবারের সকলের প্রতি দায়িত্ব পালনের দীক্ষা তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অর্জন করেছেন। সহজাত বৃত্তি ও প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা ক্রমান্বয়ে তাঁকে পূর্ণতা দিয়েছে। আমরা বলেছি, বঙ্গমাতার ডাক নাম ছিল রেণু। পুষ্পরেণুর সৌরভ যেভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে অনুরূপভাবেই তিনি তাঁর স্নেহ, আদর-যত্ন, ভালোবাসা ও মমতা দিয়ে সবাইকে আপন করে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ও বঙ্গমাতার দুইকন্যা- শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তিন পুত্র- শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধানম-ির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা এবং তাঁদের পুত্রদের আর কখনো দেখব না।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্রে কতিপয় আদর্শচ্যুত ও স্বজাতিদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক সেনাসদস্য বঙ্গবন্ধু পরিবারের সকলকে হত্যা করেছে। ব্যতিক্রম কেবল বঙ্গবন্ধু কন্যা, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানা। প্রবাসে থাকার কারণে নরপশুরা তাদের নাগাল পায়নি। বিশ্ব-ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনা কারবালার হত্যাকাণ্ড। কিন্তু সীমারের অনুসারীদেরও কিঞ্চিৎ মানবিক বোধ ছিল। নারী ও শিশু হত্যার অপরাধ থেকে তারা বিরত ছিল। কিন্তু পনেরোই আগস্টের নরপিশাচদের তা ছিল না। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র দীর্ঘকাল এই কুচক্রী ও কুলাঙ্গারদের লালন করেছে, বিদেশি দূতাবাসে চাকরি ও পদোন্নতি দিয়ে তোষণ করেছে। পঁচাত্তর পরবর্তী রাষ্ট্রপরিচালকদের স্বৈরাচারী আচরণ ছিল বীভৎস ও চরম অমানবিক।

মানব ইতিহাসের কোথাও এর তুলনা খুঁজে পাওয়া যায় না। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্যই জন্ম হয়েছে রাষ্ট্রের, অপরাধী শাস্তি না পেলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে। একটি হত্যার বিচার না হলে বহু হত্যা সংঘটিত হয়। এ অবস্থায় সাধারণ ও শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিষহ। কিন্তু এও আমরা জানি যে, মানুষের শুভ বোধও কল্যাণী সত্তাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। অমাবস্যা যত অন্ধকার হোক না কেন, সে-আঁধার এক সময় কেটে যায়। ইতিহাসের আস্তাকুড়ে কালে কালে নিক্ষিপ্ত হয়েছে স্বৈরশাসকেরা, জাতীয় ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ বিবর্জিত শাসকগোষ্ঠী। মীর জাফর- মোশতাকেরা চিরদিন বিশ্বাসঘাতকের ঘৃণ্য পরিচয়ের আবর্জনাস্তূপে নিক্ষিপ্ত হয়।

আমাদের ইতিহাসও সে-কথা বলে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, ঘনিষ্ঠজনদের হত্যাকারীরা ভেবেছিল হত্যাকা-ের মাধ্যমে সবকিছু নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সে-দুরাশা সফল হয়নি, হবেও না কোনদিন। বাঙালির জাগরণ ও অগ্রযাত্রাকে কখনও প্রতিহত করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই জয় হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতি হয়েছে সংগঠিত ও অধিকতর সুসংহত। সংবিধানে কালো অধ্যায় ‘বব’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীদের বিচারের মাধ্যমে দ-াদেশ কার্যকর হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারকার্য চলমান আছে ও কতিপয় শীর্ষ অপরাধীদের শাস্তি ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতিতে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের গভীর অবদান অনস্বীকার্য। বিদুৎ চমকের মতো তা বিভিন্ন সময় অভিব্যক্ত হয়েছে। তাঁর এ পরিচয় প্রথম লক্ষ করা যায় ১৯৪৬ সনে কলকাতার দাঙ্গার সময়। সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী স্মৃতিচারণে লিখেছেন, এ দাঙ্গায় বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন বিপন্ন করে ডা. বিধানচন্দ্র রায়, অভিনেতা ছবি বিশ্বাসসহ বহু হিন্দু-মুসলমানদের জীবন রক্ষা করেছিলেন। কলকাতায় দাঙ্গা থেমে গেলেও নতুন করে শুরু হয় বিহারে, নোয়াখালীতে।  

বিহারের কয়েক লক্ষ উদ্বাস্তুকে বাংলায় পুনর্বাসনের দায়িত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। তাঁর ইচ্ছা ছিল সম্ভাবনাদীপ্ত নেতা শেখ মুজিব যেন সে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি জানতেন বেগম মুজিবের শরীর ভালো নয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৪৪ সনে তাদের একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু সে বাঁচেনি। এ আঘাত নিদারুণ। বেগম মুজিব শারীরিক ও মানসিকভাবে দারুণ ভেঙে পড়েন। এ অবস্থায় মুজিবের উচিত তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করা। কিন্তু বেগম মুজিবের বিবেচনা স্পষ্ট, ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে তিনি দেশের ও মানুষের কল্যাণকে বড়ো করে দেখেছেন। পত্র মারফত তিনি স্বামীকে সে কথাই জানিয়ে দিয়েছেন। এ চিঠির কথা শুনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘Mujib, she is a very precious gift to you from God. Don’t neglect her please’ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ছিলেন। তাঁর মুক্তির দাবিতে উত্তাল সারা দেশ। আইয়ুব খানের মসনদ টলটলায়মান। রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তিনি গোল টেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। প্রস্তাব করা হয়, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্ত হয়ে এ বৈঠকে উপস্থিত হতে পারেন। পূর্ববাংলার অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী তা সমর্থনও করলেন। কিন্তু বেগম মুজিব তা চাননি। তাঁর সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পর্কে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন:

“আমার মনে পড়ে একদিনের কথা। যখন উচ্চ পর্যায়ের সব নেতারা আব্বাকে প্যারোলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বন্দিখানায় হাজির। এয়ারপোর্টে পিআইএ প্লেন তৈরি। তখন আমার মা অত্যন্ত শক্ত সিদ্ধান্ত নিলেন। খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে মা আমাকে পাঠালেন আব্বাকে একটা সংবাদ দিয়ে আসতে। আমি সেই সংবাদ নিয়ে হাজির হই। ভেতরে আমাদের অনেক নেতা থাকলেও আমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় গেটের বাইরে আব্বার সঙ্গে দেখা করার জন্য। অনেক চেষ্টার পর কয়েক মিনিটের জন্য আমি দেখা পাই এবং মার কথাটা আব্বাকে জানাই। ” এর পরের ঘটনা আরো দুঃখজনক।

আব্বা ৩৪ জন আসামিসহ বন্দি মুক্তি ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ছাড়া প্যারোলে যেতে রাজি হলেন না দেখে নেতারা বেশ খেপে গেলেন। তারা অনেকে ৩২ নং বাড়িতে এলেন, মাকে অনেক ভয় দেখালেন। আব্বাকে মেরে ফেলবে, মা বিধবা হবে, আমরা পিতৃহারা হব এই ধরনের কথা শোনাতেও ছাড়েনি। মার একই কথা, ৩৪ জন বন্দিকে রেখে এবং মামলা প্রত্যাহার না করলে প্যারোলে আব্বা যাবেন না, বাংলার মানুষও তা চায় না। আমার মায়ের একই কথা বাংলার মানুষের যে দাবি সে দাবির বাইরে আব্বা যাবে না। বিধবা হলে মা হবেন। পিতৃহারা হলে তার সন্তানরা হবে কিন্তু তাতে অন্য কার কি হবে? শুধু মাকে নয়, কোন নেতা সেদিন আমাকেও দু’কথা শোনাতে ছাড়েনি। আমি সহ্য করতে না পেরে সেই দুই নেতাকে কিছু কথা শোনাই এবং মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ি। আমার মা অত্যন্ত দেশপ্রেমিক ছিলেন, দেশের জন্য জীবনের যে কোন ত্যাগ স্বীকারে সদাপ্রস্তুত এবং দৃঢ় মনোবল নিয়ে আমাকে শুধু বললেন, ‘ধৈর্য ধর, আল্লাহর রহমতে তোর আব্বার কিছু হবে না। তিনি মুক্তি পাবেন। এটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ’ বিপদে ধৈর্য হারা হতে হয় না। আমার মায়ের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছিলো। জয় হয়েছিল তাঁর ধৈর্য, সাহস আর আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাসের। ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং আব্বাকেসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিয়ে বাধ্য হয়। ২৪ মার্চ আইয়ুব খানের পতন হয়। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অসীম ক্ষমতা ছিল আমার মায়ের। ”

অধুনালুপ্ত পত্রিকা ‘পয়গাম’-এর ২৩শে ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ তারিখের সংখ্যায় ‘একটি অন্তরঙ্গ মুহূর্ত’ শিরোনামে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল তা নিম্নরূপ:

“ঢাকা, শনিবার, ২২শে ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯- বেগম শেখ মুজিবুর রহমান প্রিয়তম স্বামীর জন্য কিছু খাদ্য লইয়া ক্যান্টনমেন্ট গমনের জন্য যখন প্রস্তুত হইতেছিলেন, তখন প্রায় একটার সময় শেখ মুজিবকে সঙ্গে লইয়া একটি মিলিটারি জিপ তাঁহার ধানমণ্ডিস্থ বাসভবনে আসিয়া থামে। স্বামীকে মিলিটারি জিপ হইতে অবতরণ করিতে দেখিয়া স্ত্রী বিস্ময়ে হতবাক হইয়া তাঁহার দিকে দৌড়াইয়া যান। তিনি স্বামীকে প্রথম কথা জিজ্ঞেস করেন যে, মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে কি-না? শেখ মুজিব তখন সহাস্যে স্ত্রীকে বলেন, ‘হ্যাঁ, মামলা প্রত্যাহার করা হইয়াছে এবং সকলেই মুক্তিলাভ করিয়াছেন। ’ বেগম মুজিব স্বামীকে সর্বপ্রথম ঠান্ডা শরবত পান করিতে দেন।

শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯) রাত্রি সাড়ে নয়টার সময় ক্যান্টনমেন্টে যখন স্বামীকে দেখিতে যান, তখন তিনি (শেখ সাহেব) ডাল রান্না করিতেছিলেন। ”

ঐ দিনের অর্থাৎ ২৩শে ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ তারিখের অধুনালুপ্ত দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় নিম্নোক্ত সংবাদ পরিবেশিত হয়:

ঢাকা, শনিবার ২২শে ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯- দুপুর একটার দিকে বেগম মুজিবুর রহমান কিছু খাবার নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। এমন সময় বাড়ির দরজার সামনে এসে আচমকা দাঁড়ালো একটি জিপ। বেগম মুজিবুর রহমান সচকিতচিত্তে বেরিয়ে এলেন, দেখলেন একটা সামরিক জিপ, কয়েকজন সামরিক অফিসার আর তাদের মাঝে তাঁর স্বামী শেখ মুজিবুর রহমান। এডভোকেট জনাব জুলমত আলীও রয়েছেন জীপে।

এপিপি-র খবরে প্রকাশ, বেগম মুজিব সব দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েন। তিনি প্রথমেই জানতে চান, মামলা তুলে নেওয়া হয়েছে কি-না। তাকে জানানো হয়, মামলা প্রত্যাহার এবং সব অভিযুক্তকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

শেখ সাহেবের পরনে বোতাম আঁটা কোট, মুখে পাইপ।

বেগম মুজিব তাঁর স্বামীকে ঠা-া শরবত খেতে দেন। তিনি জানান যে তাঁর স্বামী কিছুটা অসুস্থ বোধ করছেন।

শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯) রাতেও বেগম মুজিব সাড়ে ন’টায় স্বামীকে একনজর দেখার জন্য গিয়েছিলেন ক্যান্টমেন্টে। তিনি গিয়ে দেখলেন স্বামী ডাল পাকাচ্ছেন।

দুটো সংবাদভাষ্য পাঠ করলেই আমরা অনুভব করি বেগম মুজিব আপসহীনতার প্রতিজ্ঞায় কত সুদৃঢ় ও অনমনীয় ছিলেন। কন্যা শেখ হাসিনা সে-কথাই বিবৃত করেছেন। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না থেকেও রাজনীতির সত্যজ্ঞানে তিনি যে কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন, রাজনীতির জটিল সমীকরণ সমাধানে কতটা উচ্চতর নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতেন ও আত্মস্বার্থ ত্যাগে তিনি কতটা বলিষ্ঠ ছিলেন তা আমরা আজ উপলব্ধি করি।

বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অবদান মূল্যায়ন করতে গেলে তা দুটি পর্বে বিভক্ত করে দেখতে হবে। প্রথম পর্বের পরিধি ১৯৪৪ থেকে ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারী পর্যন্ত। এ পরিসরেই টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেছেন বাঙালি জাতির অসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক। তাঁকে বিবিধ ঘাত-প্রতিঘাত যেমন সহ্য করতে হয়েছে, তেমনি জনগণকে সংলগ্ন করে ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে বিজয়ী হয়ে উঠতে হয়েছে। এক্ষেত্রে এই মহীয়সী নারীর পরিচর্যা, শুশ্রুষা, ভালোবাসা, নির্দেশনা শুধু তাঁকে শক্তি জোগায়নি, তাঁর আত্মবিশ্বাসকে করেছে সুদৃঢ়।

বেগম মুজিব শত বিপদে যেমন থাকতেন নিরুদ্বেগ ও শান্ত তেমনি প্রবল আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মাঝেও থাকতেন একেবারেই ধীরস্থির ও প্রশান্ত। রবীন্দ্রনাথের ‘শান্ত তোমার ছন্দ’ বেগম মুজিবের বৈশিষ্ট্যের সাথে সুপ্রযুক্ত।

অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা পত্রিকার ৯ জানুয়ারী ১৯৭২ তারিখের সংখ্যায় পরিবেশিত সংবাদে বলা হয় লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধু ৮ই জানুয়ারী ১৯৭২ সন্ধ্যায় ঢাকায় বেগম মুজিবসহ পরিবারের সদস্যদের সাথে ২৫শে মার্চ ১৯৭১- এর পর প্রথম কথা বলেন। প্রথমেই বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করেন, “তোমরা সবাই বেঁচে আছো তো?”

‘ফোন ধরেছিলেন বেগম মুজিবুর রহমান। কিন্তু ফোনে কথা বলতে পারেন নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বরটাই শুনতে পেরেছেন তিনি। আজকে জাতির এই শুভ মুহূর্তে বেগম মুজিব কিছু বলবেন কি-না জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বললেন, শেখ সাহেব না আসা পর্যন্ত তিনি কিছুই বলবেন না’।

এনা পরিবেশিত খবরে বলা হয়, বেগম মুজিব তাঁর বাসভবনে সাংবাদিকদের জানান যে, লন্ডন থেকে টেলিফোন আসার পর তিনি আবেগে এতই অভিভূত হয়ে পড়েন যে, তিনি প্রথমবার কথাই বলতে পারছিলেন না। তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয়বার কল আসলো। শেখ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কেমন আছি। আমি বললাম, আমিরা ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’ বেগম মুজিব এর বেশি কিছু আর বলতে পারলেন না। তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালকে ডেকে দিলেন।

অধুনালুপ্ত পূর্বদেশ পত্রিকার ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ তারিখের সংখ্যায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা পরিবেশিত ভাষ্যে বলা হয়, কয়েকজন সাংবাদিক আজ (৯ই জানুয়ারী ১৯৭২) বঙ্গজননীর রাজধানীর ধানমণ্ডিস্থ বাসভবনে তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন। তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর আশু আগমন উপলক্ষে ফার্স্ট লেডির প্রতিক্রিয়া জানতে চান।

হাস্যোজ্জ্বল মুখে বঙ্গজননী বলেন, ‘আমি একজন গৃহিণী, একটা বিরাট সংসারের দায়িত্ব আমার পালন করতে হয়। ’ তিনি কৌতুকভরে বলেন যে, বঙ্গবন্ধু সবসময় রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এমতাবস্থায় তিনি নিজেও রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে বিরাট সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ থাকবে না।

এটা আমাদের সকলের জানা যে বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ কারাবাসকালে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুর বৃহত্তম পরিবার অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মীসহ দেশের সাধারণ মানুষের বিভিন্ন চাহিদা পূরণে তিনি সারাজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। যেকোন প্রয়োজনে বেগম মুজিবের কাছে সহজেই যাওয়া যায় এটিই ছিল সাধারণ মানুষের বিশ্বসের জায়গা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বর্বর পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক নিপীড়িত- নিগৃহীত মহিলাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তিনি তাঁর নিজ বাড়িতেই প্রথম কাজ শুরু করেন। দেশের দুস্থ সকল জনগোষ্ঠীর ভরসার স্থান ছিল বেগম মুজিবের বাসস্থান।

দ্বিতীয় পর্বে অর্থাৎ, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু নিয়োজিত হয়েছিলেন দেশগঠনে। তাঁর স্বপ্ন ছিল এ দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। তাঁর এ অভিযাত্রায়ও একান্ত সঙ্গী ও প্রেরণা ছিলেন বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধু দেশগঠনের কাজ সমাপ্ত করতে পারেননি।

পাকিস্তানি পরাজিত শক্তি ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্রে তিনি সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হন। বেগম মুজিবও স্বামী, সন্তানদের সঙ্গে শহিদ হয়েছেন। নীলিমা ইব্রাহিম বলেছেন তিনি ‘সহমরণে’ গিয়েছেন। এ অভিধা তাঁর জন্য সুপ্রযোজ্য। দীর্ঘ ৪২ বছর স্বামীর সংসারে তিনি কাটিয়েছেন। স্বামী রাজনৈতিক কারণে কারারুদ্ধ থাকাকালেও স্বামীর কল্যাণ ও মুক্তি কামনায় তাঁর প্রতিটি প্রহর অতিবাহিত হয়েছে। সেই স্বামীকে ছাড়া তিনি কিভাবে বাঁচবেন? আমরা তাঁকে মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের প্রমীলার সঙ্গেও তুলনা করতে পারি। স্বামীর মৃত্যুতে স্বেচ্ছায় সহমরণকে প্রমীলা আলিঙ্গন করেছেন। তখন দিনের সূর্য অস্তমিত হচ্ছে। মেঘনাদ ও প্রমীলার চিতার আগুন অনুকূল বাতাসে আরও জ্বলে উঠেছে। প্রিয় পুত্র ও পুত্রবধূর অকাল মৃত্যুতে রাবণের দু-চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়েছে। তাদের চিতার দিকে তাকিয়ে একটি কথাই তখন তিনি উচ্চারণ করেছেন: ‘বিসর্জিল প্রতিমা যেন দশমী দিবসে। ’

১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ের সংবাদে বাংলার সর্বত্রই সেদিন অনুরূপ অশ্রু বিসর্জিত হয়েছিল। বেদনায় ও ক্ষোভে অনেকেই স্বগতোক্তির মতো হলেও উচ্চারণ করেছিলেন: ‘নারী হত্যা, শিশু হত্যার অপরাধে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা। ’ ইতিহাস মানুষের সৃষ্টি। ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করে মানুষ। তাই কোনো আত্মশ্লাঘা যেন আমাদের স্পর্শ না করে। আমরা যেন সত্য ও বাস্তবকে সবার উপরে তুলে ধরতে কুণ্ঠিত না হই। আমার বিশ্বাস, এদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর যথার্থ মূল্যায়নের সঙ্গে তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবেরও প্রকৃত মূল্যায়ন হবে। তিনি তাঁর সমহিমায় ইতিহাসে অধিষ্ঠিত থাকবেন চিরদিন।

পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৪ বৎসরের শাসনামলে ১২ বৎসরের অধিককাল বঙ্গবন্ধু কারাগারের অভ্যন্তরে ছিলেন। আর এই সময়ে বেগম মুজিব শুধু পরিবারের দায়িত্ব পালন করেননি, বৃহত্তর পরিবার অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দেখাশুনা, আর্থিক সহযোগিতা করা, তাদেরকে শক্তি ও সাহস জোগানো সব কাজই তিনি করেছেন নিজ দায়িত্বে।

এসব করতে গিয়ে বাড়ির আসবাবপত্র, ফ্রিজসহ বিভিন্ন জিনিস নীরবে বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে পার্টির খরচ যুগিয়েছেন। কোনো নেতা-কর্মী না খেয়ে যেতে পারতেন না বেগম মুজিবের বাড়ি থেকে। নেপথ্যে নিভৃতে নির্লোভ নিরহংকারী এই মহিয়সী মহিলা মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত যেভাবে সকলকে মায়ের স্নেহ ও ভালবাসায় আগলে রেখে ছিলেন তা একটি ইংরেজি প্রবাদকেই মনে করিয়ে দেয়: Mother is a verb, not a noun. মা শব্দটি ক্রিয়া, বিশেষ্য নয়, বেগম মুজিব প্রকৃতপক্ষেই সারাটি জীবন নিঃস্বার্থে পরের জন্যই কাজ করে গেছেন। দূরদর্শী, স্থিতধি, ধৈর্যশীলা অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের তুলনা বেগম মুজিব নিজেই।

বঙ্গবন্ধুর জীবনের জীবন্ত ডায়েরি ছিলেন বেগম মুজিব। একজন ভাল মা যে সহস্র শিক্ষকের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তা বেগম মুজিবকে দেখেই উপলব্ধি করা যেতো। তাইতো তিনি বঙ্গমাতা, বঙ্গজননী। বেগম মুজিবকে আমরা প্রত্যক্ষ করি রবীন্দ্রনাথের ১৯৩৬ সনে প্রদত্ত উক্তিতে : নতুন সভ্যতা গড়বার কাজে মেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছে, প্রস্তুত হচ্ছে তারা পৃথিবীর সর্বত্রই। তাদের মুখের উপর থেকেই যে কেবল ঘোমটা খসল তা নয়, যে-ঘোমটার আবরণে তারা অধিকাংশ জগতের আড়ালে পড়ে গিয়েছিল সেই মনের ঘোমটাও তাদের খসছে। যে মানবসমাজে তারা জন্মেছে সেই সমাজ আজ সকল দিকেই সকল বিভাগেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠল তাদের দৃষ্টির সম্মুখে। এখন অন্ধসংস্কারের কারখানায় গড়া পুতুলগুলো নিয়ে খেলা করা আর তাদের সাজবে না। তাদের স্বাভাবিক জীবন প্রণালী, বুদ্ধি, কেবল ঘরের লোককে নয়, সকল লোককে রক্ষার জন্যে কায়মনে প্রবৃত্ত হবে।

এটি আজ সর্বজনবিদিত যে দীর্ঘ কারাবাস জীবনে বেগম মুজিব কিভাবে পৌনঃপৌনিক প্রচেষ্টা চালিয়ে কারাগারে কাগজ-কলম পৌঁছে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বার বার অনুরোধ করে রোজনামচা লেখার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন, সহায়তা করেছিলেন, তার ফলেই আমরা পেয়েছি বঙ্গবন্ধু রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়া চীন’। এই গ্রন্থত্রয়ের জন্য বেগম মুজিব আমাদের নিকট চিরদিন প্রণম্য হয়ে থাকবেন। এ বিরল অবদানের মাধ্যমে বঙ্গমাতা শেখ বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব বাংলাদেশের ইতিহাসে অনপনেয় স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

বেগম মুজিবের ছবির দিকে তাকালে যে স্নিগ্ধ প্রসন্নতা ও সততার দীপ্তি প্রকাশ পায়, যে শান্ত-সৌম্য চেহারা ফুটে ওঠে তাতে জীবনেরই স্পর্শ পাওয়া যায়। বেগম মুজিব আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন চিরদিন তাঁর সহজ-সরল, নির্লোভ, নিরহঙ্কারী ও নির্বিবাদী জীবনযাপনের জন্য। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পঙক্তিমালা উদ্ধৃত করে বেগম মুজিবের প্রতি আবারও শ্রদ্ধা নিবেদন করিঃ

“জগতে যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান,
মাতা, ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
                                সেদিন সুদূর নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাইবে নারীরও জয়। ”

লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চেয়ারম্যান, পরিচালনা বোর্ড, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।