‘আমেরিকা ফিরে এসেছে? হতে পারে নিজের পাঁকে ফিরে এসেছে। বাইডেনের ফাঁপা বাগাড়ম্বর যে ভীষণ হাস্যকর বলে আজ প্রমাণিত...’ এই কথাগুলো আমার নয়, বলেছেন টম ফৌডি যিনি একজন ব্রিটিশ লেখক এবং রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক গবেষক, যার মৌলিক গবেষণার বিষয় পূর্ব এশিয়া।
বাইডেনের স্লোগান ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’ এবং ট্রাম্পের স্লোগান ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ গড়ে উঠেছে নিরাপত্তাহীনতা এবং স্মৃতিকাতরতার ওপর ভর করে এবং এমন একটা অন্ধ বিশ্বাস থেকে, যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি সময়ে ফিরে আসতে পারে যখন দেশটি ছিলো দৃঢ়চেতা ও শক্তিশালী। আর উভয়েই বিস্মৃত হয়েছে যে দেশটি দীর্ঘদিন ধরে এক পতনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
যখন জো বাইডেন এ বছরের জানুয়ারি মাসে অভিষিক্ত হলেন, তখন আমেরিকার সব প্রধান প্রধান ধারার সংবাদ মাধ্যম আক্ষরিক অর্থে আমেরিকার সকল সমস্যাকে ঝাড়ু দিয়ে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে ফেলতে সর্বাত্মকভাবে প্রয়াস নিয়েছিলো। বিজয়ীর উচ্ছ্বাস নিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন, ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’ মানে ‘আমেরিকা ফিরে এসেছে’ এবং সেই স্লোগানটি সবত্রই অনুরণিত হচ্ছিলো। বিগত কয়েক বছরের দুঃস্বপ্নের সকল অভিজ্ঞতা ভুলে থাকা এবং আমেরিকার জীবনে যা কিছু ভুল হয়েছে তার সব কিছুর দায় প্রাক্তন প্রসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা সহজ হলেও, বাস্তব ততোধিক কঠিন বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
যেভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলের পরিসমাপ্তি ঘটলো, যেমন শেষ সপ্তাহের ক্যাপিটলের হামলা, তাতে মনে হয়েছিলো বাইডেনের ঘোষণা যেন এক বাস্তব সত্য। মনে হয়েছিলো যেন বাইডেন নিরাপদ সময় পার করবে এবং বাইডেনের হাত ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিকভাবে তার হৃত সম্মান ফিরে পাবে। সারা পৃথিবীতে এই আশা জাগানো হয়েছিলো যে বাইডেন বহুপাক্ষিক বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করবেন, মিত্রদের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করবেন, সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবেন এবং সবকিছুই আবার উজ্জল ও আশাব্যঞ্জক হয়ে উঠবে।
বাইডেন কর্তৃক দৃশ্যমানভাবে ওবামা প্রশাসনের অপেক্ষাকৃত জটিল ও মিশ্র উত্তরাধিকার এড়িয়ে চলাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারমাধ্যম ও বিশ্লেষকেরা বিশ্বাস করেছিলেন বলে মনে হয়েছিল, যে হয়তো কিছু ভুলভ্রান্তি হতে পারে এবং প্রথম কয়েকমাসে তাদের এই অনুমান সত্য বলে মেনেও নিয়েছিলেন। বাইডেনের উদ্যোগে আসলে এমন এক প্রয়াস তাদের কাছে ধরা পড়েছিলো যেন তিনি নতুন করে ঐক্যের আলো প্রজ্জ্বলিত করতে যাচ্ছেন যা ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ চেতনাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন শুরুতেই একেবারে পরিপক্ক ‘কোয়াড সামিট’, ‘জিনজিয়াংকে ঘিরে চীনা কর্মকর্তাদের উপর সমন্বিত বিধিনিষেধ আরোপ’, জি-৭ সম্মেলন এবং তার নিজস্ব ধারার ‘কোয়ালিশন পলিটিক্স’-এর মতো প্রত্যেকটি ইস্যুতে নিজের অবস্থানকে জোরালোভাবে তুলে ধরা এবং নিজের শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের এক মদোন্মত্ততার অনুকূল সময় পেয়েছিলেন। এটা বিশ্বাস করা ছিলো এতো সহজ যে তিনি এবং তার পরিবার যেন এক বিজয়ের মন্ত্র পেয়ে গেছেন যা শেষ পর্যন্ত বেইজিংকে একঘরে করে দিবে, তাই না?
যাহোক, একটা প্রচলিত প্রবাদ, ‘রাজনীতিতে এক সপ্তাহ দীর্ঘ সময়’- আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে রাজনৈতিক বিশ্বে কিছুই নির্বিঘ্নে বা আমরা যেভাবে ধারণা করি ঠিক সেভাবে চলে না। আকস্মিক অনেক কিছুই ঘটে যায় বা মোড় ঘুরে যায় যা একেবারেই অদৃশ্য কোন সূত্র ধরে জন্ম নেয় এবং যা সব পূর্বানুমানকে বদলে দেয়, মুহূর্তের ভেতরে এমনকি পলক ফেলার আগেই পূর্বপ্রতিষ্ঠিত সব ধারণা ও বিবেচনাকে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। এই ফাঁদ বা গুপ্ত বিপদ অহরহ রাজনীতিবিদদের আশা আকাঙ্ক্ষা, পরিকল্পনা এবং এমনকি তাদের পেশাগত জীবনকে ধ্বংস করে দেয়।
আপনি হয়তো বলতে পারেন, ‘ততদিন এই লোকটি ক্ষমতায় ছিলো, যতদিন না অমুকটা ঘটেছিলো এবং এমন কথা বাইডেনের বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে আর কখনো হয়তো বেশি প্রজোয্য হবে না। ’ ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’ এই মন্ত্র জপতে জপতে সবকিছুই বিজয়ীর বেশে সুসম্পন্ন করার পরে, আফগানিস্তানে চরম ব্যর্থতা নির্মমভাবে তার সকল প্রত্যাশা চূর্ণ করে দিয়েছে এবং মাত্র এক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তার সকল লম্ফঝম্ফ তাসের ঘর বা বালির বাধের মতোই ঠুনকো।
হঠাৎ করেই বাইডেনকে আর বিশ্বাসযোগ্য, অভিজ্ঞ এবং সক্ষম কোন নেতার মতো দেখাচ্ছে না, যিনি এক তুড়িতেই তার সহযোগীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন এবং সারা বিশ্বে আমেরিকার নেতৃত্বের ভূমিকাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেন-কিন্তু এর কারণ হলো তিনি কখনো তেমনটা ছিলেন না। এ কথা সত্যি যে তিনি দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ একজন কূটনীতিবিদ। কিন্তু তিনি বাস্তবতাকে ব্যবহার করে যাদুকরী কিছু করার ক্ষমতা ধারণ করেন না এবং তিনি কৌশলগত দিক থেকে চমক দেখানোর ক্ষমতা ধারণ করা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেন। এমনটা ওবামার প্রতিরক্ষা সচিব বলেছিলেন, বাইডেন ‘বিগত চার দশক ধরে প্রায় প্রত্যেকটি বৃহৎ পররাষ্ট্র নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক ইস্যুতে ভুল ছিলেন। ’
তার প্রথম কয়েক মাসের গল্প ছিলো ফাঁপা, উদারনৈতিকতা-কেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ, মাত্রাতিরিক্ত সরলতা নির্ভর, যা আমেরিকার দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোর সমাধানে মোটেও কার্যকর নয়।
ট্রাম্প প্রশাসনের সময়কালটা এমনিতেই ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হওয়া, সত্যিকারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দ্বিধা দ্বন্দ্বের দিক থেকে এক ক্ষোভ-বিক্ষোভের কাল; বাইডেনের প্রথম সাত মাস দূরদৃষ্টিহীনতা নিয়ে অতিবাহিত হয়েছে, আর এর সাথে ছিলো ভিত্তিহীন ও অস্থিতিশীল সন্তুষ্টির এক বোধ নিয়ে, যা ছিলো একটা অপেক্ষমান দুর্ঘটনা। এটা পর্যায়ক্রমে তার সত্যিকার অর্থে প্রথম পরীক্ষায় ব্যর্থতা। আর এর প্রথম বুদ্বুদটি যাচ্ছেতাইভাবে ফেটে যাওয়ার ঘটনা, ট্রাম্প প্রশাসন পরবর্তী আনন্দোচ্ছ্বাসকে ঝেটিয়ে বিদায় করার এবং আমেরিকার দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা উন্মোচনের ঘটনা। আমেরিকা কি ফিরে এলো? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ফিরে এসেছে, তবে তা আবর্জনার ভাগাড়ে।
এটা আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আমেরিকার পতনের অপেক্ষাকৃত দীর্ঘায়ত, বৃহত্তর ছবি দেখতে। বিগত দুই দশকে কতগুলো ঘটনার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক কর্তৃত্ব এবং আত্মবিশ্বাস ক্রমাগতভাবে নষ্ট হয়ে গেছে, যেগুলোর অন্তর্ভূক্ত ইরাক যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, ট্রাম্পের খেয়ালি প্রেসিডেন্ট শাসন, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভেদ, কোভিড-১৯-এর কারণে দেশটির তছনছ অবস্থা (যার কারণে এখনও প্রতিদিনই ২০০০ জনের মৃত্যু ঘটছে) এবং এখন করতে হচ্ছে আফগানিস্তান থেকে ধ্বংসাত্মক পিছুহটা।
ওয়াশিংটনের কিছু কিছু আশাবাদী মানুষ বিশ্বাস করে যে আফগানিস্তান থেকে পিছুহটা-যতোটা যাচ্ছেতাই ধরণের হলো-চীনের দিকে দৃষ্টি ফেরানোর সুযোগ করে দিবে। এটা হয়তো তত্ত্বে থাকতে পারে, কিন্তু যে ধ্বংসাত্মক উপায়ে সেখানে শেষ হয়েছে তা পদ্ধতিটার জন্য একটা ধাক্কা, যা এর দীর্ঘদিনের সর্পিল পতনের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোগ করলো। বাইডেন ঠিক তাই করেছে, যা একটি দীর্ঘকালীন এবং হতাশাজনক পশ্চাদপসরণ, যাকে অবশ্যই নৈতিক পরাজয় হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে ভূ-রাজনৈতিকভাবে যুক্তিগ্রাহভাবে সবচেয়ে বিচক্ষণ পদক্ষেপ।
এসব ঘটনাপ্রবাহই আমেরিকার পদমর্যাদাগত উপলব্ধি, পরিচয় ও আস্থায় ততোটা পযর্ন্ত ধ্বস নামাতে ভূমিকা রেখেছে, যেখান থেকে পুনর্জাগরণের ঘোষণা ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’ ও ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ এসব স্লোগানকে মিথ্যে বলে প্রমাণিত করে। এসব ফাঁকা আওয়াজ তুলে ধরে পরিচয়ের এক নিরাপত্তাহীনতা এবং পদমর্যাদার এক অনিশ্চয়তা যা চীনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এবং রোমান্টিক বিশ্বাসকে উন্মোচিত করে যে বিষয়গুলো গর্বিত অতীতের স্মৃতিচারণমূলক মনে হয় যখন আমেরিকা আস্থাশীল, শক্তিশালী ও বিকাশমান ছিল।
গত সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ তাই বাইডেনের ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’ এই স্লোগানকে ফাঁকা ও সারবত্তাহীন বলে উন্মোচিত করে দিয়েছে। বাইডেনই হয়তোবা রাজনৈতিকভাবে আমেরিকার শেষ প্রেসিডেন্ট নন কিন্তু চলমান কাহিনী যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলবে, তা ঘরোয়াভাবে এক চরম আঘাত, যখন বাইরের মিত্ররা নতুন ব্যবস্থাপকের মনোবল বাড়াতে সাহস না যুগিয়ে বরং পিছিয়ে দিবে, যেমনটা তারা প্রথম কয়েক মাসে উৎসাহভরে চেষ্টা করেছে।
মনে করে দেখুন মার্চের সেই কোয়াড সামিট যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত চীনের বিপরীতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জন্য এক বিলিয়নের বেশি ভ্যাক্সিনের অঙ্গীকার করেছিলো। কিন্তু বাস্তবে সেই অঙ্গীকার পূরণ করা হয়নি, এমনকি কাছাকাছিও নয়। এবার ফিরে তাকান চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ এর বিপরীতে ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’ প্রকল্পের কথা এবং মুহূর্তেই উপলব্ধি করতে পারবেন যে এটা একটা অর্থহীন ছাইভস্ম ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠেনি। এরপর আসুন তালিবানদের ক্ষমতা দখল প্রসঙ্গে। যেইমাত্র তালিবানরা আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করলো, বাইডেন ৬০টি দেশকে ঘোষণা করতে জোরালো আহ্বান জানালেন যেন তারা দাবী করেন যে তালিবান জনগণকে যদি তারা চায় তাহলে তাদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার অধিকার দেওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে এর মানে কি দাঁড়ায়? কিছুই না।
এই পর্যায় থেকে সামনের দিকে অগ্রসর হলে বাইডেনের বিদেশ নীতি ‘বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া নয়’ এভাবেই চলতে থাকলো, অন্তত যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, কিন্ত উপরের দিকে উঠার যাত্রায় যখনই তিনি জনগণ, প্রচার মাধ্যম এবং ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়া তার বিরুদ্ধবাদীদেরকে সামনে পান, তিনি দেখাতে চান যে তিনি ভেঙ্গে পড়া কোন মানুষ নন। কিন্তু বাস্তবে এটা তার এবং আমেরিকার জনগণের জন্য নৈতিকতার এক ধরণের পরাজয়। আর এমন ভেঙ্গে পড়ার সময়ে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরালো হচ্ছে। হায়, মধুচন্দ্রিমার দিন শেষ হয়ে গেছে এবং আমেরিকা আর ফিরবে না!
যাহোক এসবই গেলো একজন বৃটিশ বিশ্লেষকের ভাষ্য। এবার দেখা যাক বেইজিং কী বলছে? সামরিক হস্তক্ষেপ যে আর কাজে লাগে না, আফগানিস্তান তার এক জলন্ত প্রমাণ, এই সত্যকে উপলব্ধি করার আহ্বান জানিয়ে, বেইজিং ওয়াশিংটনকে কটাক্ষ করে বলছে, ‘তারা কবে আর শিখবে?’
বেইজিং দাবি করেছে যেহেতু আফগানিস্তানের ঘটনা সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে সামরিক হস্তক্ষেপ কোন কাজে লাগে না, তাই ওয়াশিংটন যুদ্ধে ব্যবহৃত ব্যাপক অর্থ ভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করলে আরো ভালো ফল পেতো।
গত ২০ আগস্ট শুক্রবার চীনের পররাষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র হুয়া চুনিং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির আরেক সমালোচনায় বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অভ্যাস তারা তাদের নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী অন্য দেশকে রূপ দিতে চেষ্টা করে। ’
আমেরিকার একজন প্রফেসরের কথা উল্লেখ করে হুয়া আরো বলেন যে, কোরিয়ান যুদ্ধের পর থেকে উন্নয়নশীল দেশসমূহে পরিচালিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল সামরিক হস্তক্ষেপ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তিনি এটাও দাবি করেন যে প্রতিবারই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীরতর সংকটে নিমজ্জিত এবং ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়েছে। ’
এযাবৎকালে ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, ইরাক, সিরিয়া এবং লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের এক তালিকা উপস্থাপন করে তিনি দাবি করেন যে, ‘এখন আফগানিস্তানের নামটাও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে আর সবখানেই তারা ব্যর্থ হয়েছে। ’
হুয়া আমেরিকার কৌশল প্রণয়নকারীদেরকে কৌশল প্রণয়নের মৌলিক নীতি সম্পর্কে প্রশ্ন করে বলেন যে, আফগানিস্তানে মৌলিক স্থাপনা খাতে ও দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যয় করা হয়েছে মাত্র শতকরা দুই ভাগ অর্থ, যা সত্যিকার অর্থে জনগণের উপকারে লাগবে। ’
তিনি আরো বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলে অন্যান্য দেশকে সাথে নিয়ে বিশুদ্ধ পানীয় জল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, হাসপাতাল নির্মাণ, কৃষিক্ষেত্র এবং অন্যান্য জনকল্যাণমুখী প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করতে পারতো, যাতে আফগানিস্তানের জনগণ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে পারে। ’
একটি চীনা প্রবাদের উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন যে, আমেরিকা যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করার মাধ্যমে শিক্ষা পেয়েছে, কিন্তু প্রশ্ন রাখেন, ‘কবে তারা সত্যিকার অর্থে শিখবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ভ্রান্ত নীতি থেকে বেরিয়ে আসা যা সর্বক্ষেত্রেই দাম্ভিকতাপূর্ণ ও বেপরোয়া। ’ আর তিনি এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে, ওয়াশিংটনের জন্য আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে যদি তারা তাইওয়ানের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার নীতি অব্যাহত রাখে।
‘একবার তাইওয়ান প্রণালীতে যুদ্ধ ছড়িয়ে গেলে, অতি অল্প সময়ের মধ্যে দ্বীপগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী তখন সেখানে কোন কাজে লাগবে না’, চীনের রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে প্রকাশিত পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস-এ ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া, তাইওয়ানের ডিপিপি’র জন্য এক শিক্ষা’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
বেইজিং ইতোমধ্যে তার সদিচ্ছার কথা জানিয়ে দিয়েছে, তারা তালেবানকে সহযোগিতা করবে কারণ তারা এর আগে যখন ক্ষমতা দখল করেছিলো তার তুলনায় বর্তমানে অপেক্ষাকৃত ‘সংযত ও মানবিক’।
অপরদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জার্মানির আঙ্গেলা মেরকেলের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনকালে বলেন, সারা বিশ্বকে এখন আফগানিস্তানের চলমান বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে এবং পুরো রাষ্ট্রটা যাতে ভেঙে না পড়ে, সে ব্যাপারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। জার্মানির চ্যান্সেলরের রাশিয়ায় আগমন উপলক্ষে সাংবাদিকদের কাছে বিবৃতি প্রদান কালে তিনি এই বক্তব্য তুলে ধরেন।
পুতিন বলেন, ‘তালেবানরা এখন রাজধানীসহ গোটা দেশ নিয়ন্ত্রণ করছে, এটাই বাস্তবতা। তার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হবে। ’
তিনি আহ্বান জানান, এখন সারা বিশ্বকে সক্রিয় প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে যাতে, শরণার্থীর ছদ্মবেশে সন্ত্রাসীরা আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি তালিবানরা ঘোষণা করেছে যে তারা সামরিক হামলা বন্ধ করে দেবে, ইতোমধ্যে তারা সারা দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে, এবং নিরস্ত্র জনগণ ও বিদেশি কুটনীতিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের অঙ্গীকার করেছে। আমি আশা করি তারা তাদের অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়ন করবে। ’
প্রেসিডেন্ট পুতিন জার্মানির চ্যান্সেলরের সাথে আফগানিস্তান প্রসঙ্গে মত বিনিময় করতে গিয়ে, একটি দেশের ওপর বিদেশি নৈতিকতা এবং কারো মডেলের গণতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারেও পশ্চিমা দেশগুলোকে অভিযুক্ত করেন।
এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আঙ্গেলা মেরকেল পুতিনকে বলেন, এই বিষয়টা তালেবানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময় রাশিয়ার পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। সূত্র: রাপ্টলি টিভি (আরটি), মস্কো, রাশিয়া।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ।
ইমেইল: [email protected]