ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সাগর, রুনি আর আমাদের ভাগ্যাকাশ!

রহমান মাসুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১২
সাগর, রুনি আর আমাদের ভাগ্যাকাশ!

ঢাকা: ২০০৬ সাল। মেঘ তখন রুনি আপার পেটে।

আর কিছুদিন পরই পৃথিবীতে আসবে নতুন শিশু। কিন্তু সন্তানসম্ভবা বলে ঘরে ঠাঁই নেননি পেশাদার সাংবাদিক মা।

এদিকে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ধীরে ধীরে অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন তখন দেশের সকল সংবাদের উৎস। এটিএন বাংলা থেকে বিট কভার করতে নিয়মিত কমিশনে আসেন শেখ নজরুল ইসলাম। আমরাও প্রতিদিন সকাল সকাল কমিশনে গিয়ে পৌছাই সংবাদের খোঁজে। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সে সময়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এমএ আজিজের পদত্যাগের দাবিতে দেশ অচল করার হুমকি দিচ্ছিল। অন্যদিকে আজিজ কমিশনে থাকার নানা ফন্দীফিকিরে ব্যস্ত।

একদিন হঠাৎ করেই আজিজ সাহেব তার ব্যক্তিগত সহকারীর মাধ্যমে সাংবাদিকদের খবর দিলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কথা বলবেন। আমরা সবাই সকালেই ইসিতে হাজির। সেদিন অন্য সবার সঙ্গে এটিএন থেকে হাজির হলেন মেহেরুন রুনিও। সঙ্গে শরীরের মধ্যে বাড়তে থাকা মেঘও। (নজরুল ভাই কি সেদিন ছুটিতে ছিলেন!) বেলা দুইটায় সিইসির সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার কথা দেড় কোটি ভূয়া ভোটার তালিকা নিয়ে। বিরোধী দলের দাবির মুখে পদত্যাগ করবেন কি না- এসব নিয়ে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। ডিসেম্বরের শেষ দিকের এ সময়ে বেলা সাড়ে চারটায় সিইসি আজিজের ব্যক্তিগত সহকারী মোস্তফা ফারুক সাংবাদিকদের জানালেন- কথা বলবেন না সিইসি।

ইসিতে উপস্থিত জনা ৫০ সাংবাদিক ও ফটো সাংবাদিক ক্ষোভে ফেটে পড়লেন সিইসির এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্তে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন আজিজকে কথা বলতেই হবে, সাংবাদিক ডেকে আনার জন্য।

বেলা সাড়ে ৫টা। আমরা ইসি ভবনের পূর্ব ব্লকের নিচের সিঁড়ির মুখে অপেক্ষা করতে থাকলাম। সাড়ে ৬টায় সিইসি আজিজ নামলেন পেটোয়া পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে কমান্ডো স্টাইলে। আমি বয়সে ছোট হওয়ায় সকলের সামনে একেবারে সিঁড়ির মুখে। উপর ও নীচ থেকে পুলিশ শটগানের বাট দিয়ে সাংবাদিকদের ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে শুরু করলো।

সঙ্গে সঙ্গে দানা বাঁধলো বিশাল হট্টগোল। সিঁড়িতে উঠে গেলাম আমি। ২ হাত প্রসারিত করে দাঁড়ালাম এবং বন্ধ করে দিলাম আজিজের নামার রাস্তা।

পেছন থেকে শুরু হলো পুলিশের ধ্বস্তাধ্বস্তি। ধপ করে পড়ে গেলেন কেউ। আরো একজন। আমার পেছনে আশিস সৈকত, সাখাওয়াত লিটন, হোসাইন জাকির, মুজতোবা চৌধুরী, রাশেদ ভাই, আলমগীর স্বপন, বিপ্লব রহমান, আশীস কুমার দে, মাহফুজ স্বপন, হাসান শাফিঈ, জসীম উদ্দীন, রহমান ভাই, মাহামুদ ভাই, ওহিদুল, গাজী শাহনেওয়াজ, খাদেমুল ইসলাম হৃদয়, কাজী হাফিজ, আজাহার, সিরাজুল ইসলামসহ সকল সহকর্মী।

আজিজ দাঁড়ালেন। সাংবাদিকদের প্রতিরোধের মুখে কথা বললেন। আমাদের সংবাদ সংগ্রহ শেষ হলে পেছনের শব্দের কথা জানতে পারলাম। সন্তানসম্ভবা মেহেরুন রুনিকে ফেলে দিয়েছে পেটোয়া পুলিশ। আর একটি শব্দের উৎস ছিলেন হারুন আল রশীদ। রুনিকে ততক্ষণ এটিএনের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে।

এরপর মেঘ পৃথিবীতে এলো। সাগর ভাই চাকরি নিয়ে চলে গেলেন জার্মানীতে। কিছুদিন পর বোধ হয় রুনিও গেলেন। আবার তারা ফিরেও এলেন। থাকবেন দেশে। সাগর জয়েন করল মাছরাঙায়। রুনি আবার এটিএনে।

মাস দুয়েক আগে জিজ্ঞেস করলাম রুনি আপা মনে আছে সেই আছাড় খাওয়ার দিনের কথা? হেসে দিয়ে বললেন, তোর মনে আছে?

কথা হচ্ছিল শীতের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে পিঠা খাওয়া নিয়ে। আফসোস করলেন রুনি আপা। বললেন-এসব আর হয়ে ওঠে না, গ্রামের বাড়ি না থাকাতে। জানতে চাইলাম কেনো? উনি বললেন- গ্রামের বাড়ি তো সেই পঞ্চগড়ে। বাবা আগে নিয়ে যেতেন। এখন আর যাওয়া হয় না। বললাম চলেন- একদিন আমার গ্রামের বাড়ি। শুনে হাসেন। শূন্যের দিকে তাকান।

সেই হাসিতে কি ছিল নাগরিক জীবনের কোন যন্ত্রনা বোধ! বুঝতে পারিনি। এরপর মাঝে দু’একদিন এসেছেন ইসিতে। হেসে বলতেন, আমিতো নিয়মিত আসি না, কি হবে কমিশনে, বলো তো। আমরা বয়সে ছোটরা শুনে হাসতাম।

মাঝে দেখা হলো একদিন। কিন্তু কোথায়? প্রেসক্লাব অথবা ডিআরইউতে। দেখেই সেই হাসি।

আজও আমার কাছে সেই স্মৃতি জ্বলজ্বলমান। বিকেলে যখন সবাই ডিআরইউতে সাগর ও রুনির ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখছিলেন। আমি দেখিনি। আমি দেখতে চাইনি। নষ্ট করতে চাইনি মনে স্থান নেওয়া সেই হাসি।

নিখিল সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারালেন, মওলানা দীনেস চলে গেলেন। এই চলে যাওয়াও আজ আমার কাছে কিছুটা স্বভাবিক মনে হলো। অন্তত নিজের শোবার ঘরে খুন হওয়ার চেয়ে।

আজ যে বসে বসে সদ্য খুন হওয়া সহকর্মীর স্মৃতিচারণ করছি। কাজ শেষে ভালোভাবে বাসায় ফিরতে পারব তো? আগামীকাল আমার প্রিয় সহকর্মীরা কি আমায় জীবিত দেখতে পাবেন? আমি আবার লিখতে পারবো তো প্রিয় কবিতার পঙক্তি! নাকি খুন হবো রাস্তায় বা প্রিয় শোবার ঘরে।

কে দেবে এই প্রিয় দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি! ডিআরইউতে কতোজনকে কাঁদতে দেখলাম। আমার ও তো চোখ ভিজে উঠছিল! আগামীকাল কি আমাকে নিয়েও এমন বিষাদের অবতারণা হবে!

বাংলাদেশ সময়: ২১১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।