১১ ফেব্রুয়ারি শনিবার ঘুম থেকে উঠে সবাই দেখেছে দুধসাদা ঘরেরবাহির। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, তবুও শিশুরা স্নো-বল বানিয়েছে।
মিডিয়ায় যেভাবে এসেছে: দুটো সতেরো বছরের কিশোর হাঁটছিলো, চেশায়ারের হাইড টাউন সেন্টারের পাশ দিয়ে। হঠাৎ করেই একটি টেইক ওয়ে থেকে বেরিয়ে আসে সাত-আট জনের ১৬ থেকে বিশ বছরের কিশোর-তরুণের একটি গ্যাংগ। পেটাতে থাকলো প্রিন্স নামের ছেলেটাকে। থেঁতলে দিলো তার মুখ। মুখ-চোখ ফুলে উঠলো ছেলেটার। তার মুখচ্ছবি পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার হয়েছে। রেডিও ফাইভ লাইভে তার মার কান্না শুনেছি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়ও তাকে নিয়ে আছে প্রচার-প্রচারণা।
সারা ব্রিটেনের মিডিয়ায় এ-এক সরব প্রচার। স্থানীয় বহুল প্রচারিত দৈনিক ইভনিং নিউজ থেকে শুরু করে ডেইলি মেইল, মিরর, স্কাই টিভি, রেডিও ফাইভ লাইভ ব্যাপারটাকে ব্যাপক প্রচারনায় নিয়ে নিছে। বার বার উচ্চারিত হচ্ছে এই সাট-আটজনের গ্রুপটির কথা, কারণ গ্রুপটি ছিলো এশিয়ান। আমরা জানি এই এলাকায় প্রায় পাঁচ হাজার বাঙালির আবাস। অতএব এই তরুণের দলের সবাই বাঙালি। পুলিশ তাদের দুজনকে আটক করেছে এরই মধ্যে। এই এলাকায় বাস না করলেও দীর্ঘ আট বছর থেকে এই কমিউনিটির পেরেন্টস-ছাত্র-ছাত্রী কিংবা অনেক তরুণদের জানি। এই জানা তরুণদেরই দু’জন তারা। রাত সাড়ে দশটায় তরুণরা বিশেষত সতেরো-আঠারো বছর বয়সীরা নাইট আউটে বের হয়। তাদের থাকে একটা ইগো। উল্লাস করা কিংবা উছৃঙ্খল হবার একটা উগ্রতা। হয়ত এই উগ্রতাই পেয়ে বসেছিলো তাদের। তাইতো স্নো-বল (বরফ-বল) নিক্ষেপই হয়ে যায় তাদের উছৃঙ্খলতার একটা প্রধান কাজ। এর আগে সাদা একটি গ্রুপের সাথে এ নিয়ে বল নিক্ষেপ-পাল্টা নিক্ষেপ চলে এবং একসময় তা কিশোর-তরুণদের মধ্যে যা হবার, তাই হয়ে যায়। একটা দুঃখজনকক পরিণতি ঘটে, স্নো-বল তখন আর বরফে সীমাবদ্ধ থাকে না, হয়ে ওঠে রক্ত ঝরানোর হাতিয়ারও।
গোটা বাঙালি কমিউনিটিতেই এ নিয়ে আছে একটা বড় ধরনের অস্বস্তি। পুলিশ এ এলাকাটি টহলের মাঝে নিয়েছে। যদিও তরুণদের কেউ কেউ আবার স্বেচ্ছাগ্রেফতারও হয়েছে। কারণ মিডিয়া এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটাকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে গেছে, যা থেকে দেশব্যাপী তারা এটাকে বর্ণবাদী আক্রমণ হিসেবেই উপস্থাপন করছে। এমন অবস্থানে নামিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে, মনে হচ্ছে এ যেন বাঙালিদের দ্বারা সৃষ্ট বর্ণবাদী সন্ত্রাস সৃষ্টির শহর। খুব স্বাভাবিকভাবেই কিছু কিছু এলাকায় বাঙালিদের ব্যাপক বসতির কারণে এই এলাকাকে তারা নিজের মতো করে নিয়েছে। অন্তত পঞ্চাশ বছর থেকে এই এলাকায় বাঙালিদের বসবাস। চল্লিশ বছর আগেই এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশি মানুষের অ্যাসোসিয়েশন। তা-ও বিশাল নিজস্ব বিল্ডিং। এখানে আছে আকর্ষণীয় স্থাপত্যের সুন্দর মসজিদ। সব মিলিয়ে হাইডে আছে একটা শক্ত বাঙালি কমিউনিটি।
আমরা স্বীকার করি, এই কমিউনিটিতেই কিছূ তরুণ ঝুঁকছে নেশায়। শুনেছি, নেশাজাত দ্রব্যাদীর বেচা-কেনাও আছে তাদের মাঝে। কিন্তু ছয় হাজার বাঙালি মানুষের হাইড শহরে তা হয়ত ত্রিশ জনের বেশি হবে না। কিন্তু যেহেতু এখানে বাঙালি কমিউনিটি খুব জোড়ালো, খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই বাঙালিদের অবস্থান এখানে হেলা-ফেলার নয়। স্থানীয় কাউন্সিলের সাথে এই কমিউনিটির আছে একটা সুন্দর যোগাযোগ, আছে ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সাথেও সুন্দর সহাবস্থান। সেকারনেই হয়ত এই ঘঠনাটি নিয়ে যখন সারা ব্রিটেনের মিডিয়ায় চলছে বর্ণবাদী ছোঁয়া দেওয়ার পাঁয়তারা, সেসময় কাউন্সিল লিডার, ডেপুটি লিডারসহ স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচিত প্রতিনিধি বাঙালিদের অ্যাসোসিয়েশনে এসে এ কমিউনিটির প্রশংসা করেছেন। নর্থ-ওয়েস্টে বসবাসরত বাঙালিরা শুধু নন, মানবিক বোধ সম্পন্ন প্রতিটি মানুষ শনিবারের এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে।
হাইডের বাঙালি কমিউনিটিও এ নিয়ে আছে চরম অস্বস্তিতে। তারা এদের শাস্তি দাবি করেছে, পুলিশকে সহায়তাও করছে। আর সেই সাথেই এই কমিউনিটির কথা হলো ব্যাপারটাকে যেভাবে রং দেওয়া হয়েছে, তাতে কমিউনিটির বিভক্তি বাড়বে। সেই কথাটাই বলে গেলেন কাউন্সিলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও। তারাও একবাক্যে স্বীকার করেছেন, এরকম দুঃখজনক ঘটনা ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে কখনো কখনো ঘটেই যায়। এবং এরা আইনের আওতায়ও আসে। সেকারণেই আমরা মনে করছি দুষ্কৃতকারীরা অবশ্যই আইনের আওতায় আসবে এর বিচারও হবে। কিন্তু এটাকে কোনভাবেই বর্ণবাদী আক্রমণ বলা যায় না।
২)
হাইডের এ ঘটনার পর ব্রিটেনের চরম প্রতিক্রিয়াশীল বর্ণবাদী গোষ্ঠিষ ইডিএল (ইংলিশ ডিফেন্স লিগ) একটা মওকা পেয়েছে। তারা এ ঘটনাকে ইস্যু হিসেবে নিতে চাইছে এবং আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি হাইডে মার্চ করার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের ফেইসবুক থেকে এমনিতেই সবসময় উচ্চারিত হয় বর্ণবাদী উচ্চারণ। এবারে তারা হাইডকে কেন্দ্র করে আরও একটি অঘটন ঘটাতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক। স্থানীয় প্রশাসন এটা করতে হয়ত দেবে না। পুলিশ প্রশাসন এটাকে প্রতিহত করবে শক্ত হাতে। এভাবেই তারা ঘোষণা দিয়েছে। তা না হলে এখানে ঘটে যাবে বিশৃংখলা। কারণ হাইডেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া এবং উঠতি তরুণরা একটা বড় শক্তি। সুতরাং স্থানীয় প্রশাসনকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে, যা ইতিমধ্যে নিচ্ছেও তারা।
এ কমিউনিটিরই এক নারী সেদিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, তার ছেলের উপর বর্বরতার কথা। ২০১০ সালে এখন তার বিশ্ববিদ্যালযে পড়–য়া ছেলেটা আসছিলো ম্যানচেস্টার থেকে বাস যাত্রী হয়ে। হঠাৎ করে কিছু না বোঝার আগেই আট-নয় জনের একটা সাদা কিশোর-তরুণের গ্রুপ তার উপর আক্রমণ করে পাকি আর বর্ণবাদী গালিগালাজ করে বাস থেকে নেমে যায়। সেই কিশোরটিও হাসপাতালে গেছে। অনেক দিন বিছানায় ছিলো। সেটা মিডিয়ায়ও যায় নি, পুলিশ কিন্তু আজও এর সমাধান করতে পারেনি, এমনকি কাউকে গ্রেফতার করতেও পারে নি। এ ঘটনার পর ওই মা তার ছেলেসহ এখন পুলিশে যোগাযোগ করছেন। বললেন আমরা যে আক্রমণকে বর্ণবাদী আক্রমণ হিসেবে ধরিনি, অথচ আজকের একই ধরনের ইস্যুকে কেনইবা বর্ণবাদী আক্রমণ হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষ প্রশ্ন করতে পারে, কিছু উশৃংখল তরুণের হানাহানিকে কেনইবা বর্ণবাদী আক্রমণ হিসেবে দেখা হবে। এর মাধ্যমে হেয় করা হচ্ছে গোটা বাঙালি কমিউনিটিকে ব্রিটিশ সমাজব্যবস্থায়। দুপক্ষের উশৃংখল যুবকগুলো এই দেশের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠছে। সেকারণে যে কেউই অপরাধ করলে আমরা অপরাধীকে কেনইবা বিশেষ কমিউনিটির অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করবো। অপরাধী অপরাধীই, এভাবেই দাঁড় করাতে হবে বিচারের কাঠগড়ায়। আর যদি তা না হয়, তাহলে মাত্র দু‘মাস আগে এই ম্যানচেস্টারেই ঘঠেছে আরেকটি হত্যাকান্ড। ভারতীয় একটা স্টুডেন্ট গ্রুপের উপর অতর্কিতে গুলি করে সাত-আট জনের একটি ব্রিটিশ তরুণ গ্রুপ। ভারতীয় এক মেধাবী ছাত্র নিহত হয় ঐ রাতে। তা ছিলো গত ক্রিসমাস ডে‘র পরের রাত। এটাকেতো এশিয়ানরা বর্ণবাদী হত্যা হিসেবে গণমাধ্যমে দেখে নি। কিংবা তারা প্রচার-প্রচারণাও চালায়নি বর্ণবাদী হত্যা হিসেবে, যদিও এটাকে অনেকেই মনে করছেন বর্ণবাদী আক্রমন।
ব্রিটিশ পুলিশের প্রতিনিধি ব্রিটেন সরকারের পক্ষ হয়েই ভারতে গিয়ে ছাত্রটির অভিভাবকের সাথে বিষয়টির একটি নিষ্পত্তিতে গিয়েছে। অন্যদিকে অপরাধীতো গ্রেফতারও হয়েছে। কিংবা আজ থেকে বছর দুয়েক আগে যখন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ছয় বছরের ব্রিটিশ শিশুকে পাকিস্তানেই কিডন্যাপ করা হয়েছিলো, সেখানে ম্যানচেস্টার পুলিশের সাহসী এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপে ছেলেটিকেও তারা মুক্ত করতে পেরেছিলো। পরে ফ্রান্সে তারা অপহরণকারী চক্রদের আটকও করতে পেরেছিলো। এসব খবর আমাদের আশান্বিত করে, ব্রিটিশ সরকার কিংবা প্রশাসনের প্রতি আমাদের আস্থা আরও সুদৃঢ় হয়। কারণ দেশি-বিদেশি যেই হোক, প্রত্যেকটি মানুষেরই নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এবং সে দায়িত্বই পালন করেছে ব্রিটিশ সরকার।
বাঙালি কমিউনিটি এখানে বেড়ে উঠছে। ওল্ডহ্যাম-ম্যানচেস্টার-হাইডে আছে বাঙালিদের শক্ত অবস্থান। ইডিএল যেখানেই গেছে, প্রশাসন এদের প্রতিরোধ করেছে। গত বছর যখন ইডিএল টাওয়ার হ্যামলেটস-এ মার্চ করতে চেয়েছিলো,তখন টাওয়ার হ্যামলেটস এর নির্বাহী মেয়র এবং বাঙালি বংশোদ্ভূত এমপি তার দলবল নিয়ে জনগণের পাশে ছিলেন। মানুষ নির্ভরতা পেয়েছিলো। কোন অঘটন ঘটতে দেননি তারা। হাইডেও একাজটি করতে পারেন নর্থ-ওয়েস্টের বাঙালি জনগোষ্ঠির নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং কমিউনিটি নেতারা। হাইডের মানুষের জন্যই শুধু নয়, বাঙালি কমিউনিটিকে সুসংহত করতে সবাইকে এক হতে হবে। গোষ্ঠীকেন্দ্রিক দলাদলি পরিত্যাগ করে কমিউনিটির দুঃসময়ে এক কাতারে মিলিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ইডিএল-এর সাথে কোনও প্রকার হানাহানির পর্যায়ে যাতে না যায় আমাদের মানুষ, সে পরিবেশ ধরে রাখতে ওল্ডহ্যাম-ম্যানচেস্টারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও এগিয়ে আসতে হবে,পাশে দাঁড়াতে হবে এই কমিউনিটির। আসতে হবে নর্থ-ওয়েস্টের বিশেষত এই তিন শহরের কমিউনিটি নেতৃবৃন্দদের। আমাদের বিশ্বাস, নেতৃবৃন্দের সুদৃঢ় অবস্থান স্থানীয় প্রশাসন কিংবা পুলিশ প্রশাসনকেও আরও শক্তি জোগাবে। ইডিএল পরাভূত হবে।
ফারুক যোশী: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
বাংলাদেশ সময় ১০৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১২