মাসখানেক আগে হবে। অস্ট্রেলিয়াতে ক্রিকেট খেলা চলাকালীন এক মদ্যপ দর্শক অতি বাড়াবাড়ি করলে পুলিশের সংগে ধস্তাধস্তি হয়।
মদ্যপ ব্যক্তি কোন গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিল না কিংবা সেই ধরনের মানুষের আত্নীয় ছিল কিনা সেটা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। সে মদ্যপ হলেও একজন সাধারণ মানুষ এবং অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। সেটাই তার বড় পরিচয়। এই সামান্য (আমাদের দেশের বিবেচনায়) পুলিশি অপরাধের বিচারের জন্য আদালতকে স্বতঃপ্রণোদিত হতে হয়নি। আইনের নিজস্ব গতিতেই সেটা হয়েছে।
মদ্যপান করে এ ধরনের আচরণ ফ্রাইডে নাইটে কিংবা অন্য যে কোন সময় মাঝে মাঝেই হয়ে থাকে। এবিষয়ে একবার একজন সাদা অস্ট্রেলিয়ানকে প্রশ্ন করেছিলাম। আচ্ছা মদ্যপান করে এখানে কিছু মদ্যপ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটায়। পুলিশ এতো সহনশীল কেন? আমার প্রশ্ন শুনে মনে হলো সে চমকে উঠেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝিয়ে বলল, একজন মদ্যপের অপরাধ দেখার জন্য আইন আদালত আছে। সেখানে তাদের সোপর্দ করার জন্য পুলিশ বাহিনি আছে। সকলেই যে যার দায়িত্বে অবিচল এবং নিষ্ঠাবান থাকলে অপরাধীর সাজা হবার কারণে অন্যরা সেখান থেকে শিক্ষা নেবে। কিন্তু রাষ্ট্রের কোনও অঙ্গ, বিশেষ করে অস্ত্রধারী কোন প্রতিষ্ঠান যদি বেপরোয়া ক্ষমতা পেয়ে যায়, ভেবেছো তার ধ্বংসলীলা কি হতে পারে? একটা যুদ্ধ পরিস্থিতির চেয়েও ভীতিকর হতে পারে। তাই তাদের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ দরকার। পুলিশ আইনের কারণেই এতোটা সহনশীল। তাছাড়া পুলিশের উপরে এখানে রাজনৈতিক হস্তেক্ষেপও নেই। তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে।
বাংলাদেশে পুলিশ কর্তৃক জনমনে ত্রাস সৃষ্টির ইতিহাস কিংবা অপরাধ সংগঠনের ইতিহাস নতুন কিছু নয়। প্রতিনিয়ত দেশের মানুষ রক্ষককে ভক্ষকের ভূমিকায় দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। পুলিশ কর্তৃক ছোটখাট অঘটন তাই কোনো ঘটনাই না। কাদেরের মতো থানার ভিতরে পুলিশ অফিসারের চাপাতির কোপ না খেলে সেটা ঘটনা হয় না। কাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হলে কি হতো সেটা অবশ্য জানি না। তবে এরই ভিতর গত সপ্তাহে আদালত আবারও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কয়েকজন পুলিশকে তলব করেছে। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের নাতিকে পেটানোর ঘটনায় অভিযুক্ত তারা।
পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে এই আদেশে খুশি হলেও সেই সাথে মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রাষ্ট্রের কাছে সব মানুষ কি সমান? প্রতিদিনই রাস্তাঘাটে পুলিশের অত্যাচারে হয় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, নয়তো নির্যাতিত হচ্ছে? রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তা পেতে কি তবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তির আত্নীয় হতে হবে আমাদের? যদি সে রকম কেউ আত্মীয়তা সম্পর্কের না থাকে তবে কি পুলিশি নির্যাতন হজম করতে হবে নিরবে? উদ্বেগটা শুধু আমার নয়। অনলাইনে পাঠক প্রতিক্রিয়ায় দেখলাম একই প্রতিধ্বনি।
কেউ কেউ বলেছে, রাষ্ট্রর কাছে সকল নাগরিকের সমান হওয়া উচিত। তাজউদ্দিন আহমেদের নাতি হবার কারণে যদি ওদের প্রত্যাহার করা হয় তবে সারা দেশে প্রতিদিন অসংখ্য নির্যাতনের জন্য গোটা সরকারকেই তো প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত। অন্য আরেকজন চমৎকার বিশ্লেষণ দিয়েছে এভাবে, পুলিশ বা যে কেউ অন্যায় বা অপরাধ করলে আইনের আওতায় আসবে সেটাই সভ্য রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। দেশে সুশাসন থাকলে এমনটা স্বাভাবিকভাবেই ঘটার কথা। কিন্তু সেটাতো হচ্ছেই না, উল্টো নাগরিকদের প্রতি দুই ধরনের আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। মাত্র কিছুদিন আগে বিরোধী দলের আন্দোলন চলাকালীন পাঁচ নাগরিকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো তাদের পক্ষে সাফাই গেয়ে হত্যাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। উক্ত পাঠক মন্তব্য করেছেন, এর থেকেই বোঝা যায়, আইন আসলে দেশের সবার জন্য সমান নয়। আইন শুধু প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাসীনদের জন্য।
সীমান্তে মানুষ হত্যা, সাধারণ নাগরিকের উপরে পুলিশের অব্যাহত সন্ত্রাস সৃষ্টি এবং এই উভয় ক্ষেত্রেই পুরো জাতি যখন সন্ত্রস্ত ; তখনো সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বিবৃতি দিয়ে সেটাকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করা।
এই ধরনের পক্ষপাতমূলক ব্যবহার কোনওভাবেই কাম্য নয়। এর দ্বারা পুলিশের নির্যাতন না থেমে প্রকৃতি পাল্টে আরো ভয়ংকর রুপ নিয়ে জনভীতি বাড়াতে পারে। পুলিশ হয়তো এই ধারণা পাবে যে, কাদেরের মতো ছাত্র মারা যাবে না, সাংবাদিক বেশি পেটানো যাবে না, কারো আত্নীয় স্বজন সেলিব্রেটি, বা বিখ্যাত বা প্রভাবশালী বা সরকারী দলের কেউ হলে তাকে পেটানো যাবে না। কিন্তু আবুল কাবুল কিংবা রহিমন করিমনদের একটু আধটু ক্ষমতা দেখালে বিপদ নেই। এর মাধ্যমে সমাজে আইন কর্তৃক একটি এলিট নাগরিক শ্রেণী তৈরি হচ্ছে, যেটা সামন্তবাদী কনসেপ্ট।
আদালত কর্তৃক এই ধরনের শ্রেণী বিভাজিত পদক্ষেপ সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। এটা সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বড় বাধা। বৈষম্যপর্ণ এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাধারণ নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দেবে কে? রাষ্ট্রের এই বৈষম্যমূলক আচরণ দেখে নাগরিক সমাজে প্রশ্ন উঠতে পারে, আসলে আমার রাষ্ট্র কোনটা? নাকি আমি রাষ্ট্রের ভিতরে রাষ্ট্রহীন নাগরিক?
এতোটা হতাশাজনক খবরের পরেও যার উপরে পুলিশের অত্যাচারের শিকার ছেলেটির মা, তাজউদ্দিন আহমেদের মেয়ে, সিমিন হোসেন রিমির কন্ঠে শুনলাম জনগণের কথার প্রতিধ্বনি। তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হবে, সেটাও পুলিশকে ভালোভাবে শেখানো উচিত।
অত্যন্ত সুনাগরিকের মতো মন্তব্য। তিনি পিতার পরিচয়কে ব্যবহার করে বাড়তি আইনি সুবিধা নিতে চাননি। বরং সাধারণ নাগরিকের মতো আইনভিত্তিক সু-আচরণ প্রত্যাশা করেছেন সবার জন্য। এই মানসিকতা রাষ্ট্রের প্রত্যেকটা অঙ্গের মধ্যে প্রতিফলিত হলেই তবে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
[email protected]