ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সাধারণ মানুষের কী দোষ?

তপন চক্রবর্তী, ডেপুটি এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২২
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সাধারণ মানুষের কী দোষ? ...

পূর্ব ইউরোপের একটি রাষ্ট্র ইউক্রেন। জনসংখ্যা সাড়ে চার কোটির বেশি।

 ১৯৯১ সালের ২৪ আগস্ট সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ইউক্রেন।  রাশিয়ার পর এটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রুশিয় প্রজাতন্ত্র রুশ ফেডারেশন হিসেবে গঠিত হয় এবং একক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হয় রাশিয়া। বিশ্বের নবম জনবহুল এই দেশে ১৪৩ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে।

সামরিক শক্তির বিচারে বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান দ্বিতীয়। ইউক্রেনের অবস্থান ২২ নম্বরে। সামরিক শক্তি পর্যবেক্ষণকারী গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্যানুযায়ী, রাশিয়ার সৈন্যসংখ্যা ৮ লাখ ৫০ হাজার, ইউক্রেনের সৈন্য ২ লাখ। উভয় দেশের রিজার্ভ সৈন্য আড়াই লাখ।

রাশিয়ার ১২ হাজার ৪২০টি ট্যাংক আছে, ইউক্রেনের আছে ২ হাজার ৫৯৬টি। রাশিয়ার আছে ৩০ হাজার ১২২টি আর্মড যান, ইউক্রেনের ১২ হাজার ৩০৩টি। রাশিয়ার স্বয়ংক্রিয় কামান ৬ হাজার ৫৭৪টি, ইউক্রেনের আছে ১ হাজার ৬৭টি। রাশিয়ার মোবাইল রকেট প্রজেক্টর ৩ হাজার ৩৯১টি, ইউক্রেনের  ৪৯০টি। রাশিয়ার নৌ-বাহিনীর সামরিক যান ৬০৫টি, ইউক্রেনের ৩৮টি। রাশিয়ার আছে বিমানবাহী রণতরি, ৭০টি সাবমেরিন, ১৫টি ডেস্ট্রয়ার। রাশিয়ার রয়েছে ১১টি ফ্রিগেট, ইউক্রেনের একটি। মাইন ওয়ারফেয়ার নৌযান ইউক্রেনের ১টি এবং রাশিয়ার রয়েছে ৪৯টি। ৮৬টি করভেট রয়েছে রাশিয়ার, ইউক্রেনের মাত্র ১টি। রাশিয়ার টহল নৌযান ৫৯টি, ইউক্রেনের ১৩টি। এই পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট হয়, সামরিক শক্তিতে ইউক্রেন এর চেয়ে রাশিয়া অনেক এগিয়ে আছে।

বিশ্বে পারমাণবিক শক্তিধর ৮টি দেশের মধ্যেও রাশিয়া একটি। তাদের এস-৪০০ নামের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা আকাশ প্রতিরক্ষায় কার্যকর। এছাড়া ১ হাজার ২১৮টি বিমানবন্দর, ২ হাজার ৮৭৩টি বাণিজ্যিক জাহাজ আছে। সামরিক খাতে বছরে রাশিয়ার ব্যয় ১৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা আড়াই লাখ। সেই তুলনায় ইউক্রেনের পারমাণবিক অস্ত্রই নেই। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৫০ হাজার। বিমানবন্দর আছে ১৮৭টি। বাণিজ্যিক জাহাজ ৪০৯টি। সামরিক খাতে ১ হাজার ১৮৭ কোটি ডলার ব্যয় করে ইউক্রেন।  

পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার হুমকি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনে অভিযান চালাচ্ছে রাশিয়া। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) ভোর থেকে এই সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ইউক্রেনে ব্যাপক প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে রুশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইউক্রেনের সেনা অস্ত্র পরিত্যাগ করলেই আলোচনা হতে পারে।

রাশিয়া ও ইউক্রেন- উভয়েরই প্রধান ধর্ম অর্থোডক্স খ্রিস্টান। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং খাদ্য একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ অনেক প্রাচীন শহর এবং রুশ জনগোষ্ঠীর একসময়ের রাজধানী। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাশিয়ার বর্তমান রাজধানী মস্কোর চেয়েও কয়েক শতাব্দী আগে। রুশ এবং ইউক্রেনীয় উভয় জনগোষ্ঠীই দাবি করে থাকে কিয়েভই হচ্ছে তাদের আধুনিক সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভাষার মূল কেন্দ্র।

পূর্ব ইউক্রেনে বহু রুশভাষী এবং মস্কোর প্রতি অনুগত লোক বাস করেন, সেখানে রাশিয়ার প্রভাবও গভীর। বস্তুত ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে বৈরিতা একসময় এমন ছিল যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউক্রেনীয়দের একাংশ হিটলারের নাৎসী বাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিল। তারা জার্মানদের ‘ত্রাণকর্তা’ ভেবে মনে করেছিল যে, এবার সোভিয়েত শাসন থেকে মুক্তি পাবে। ইউক্রেনীয়দের আরেক অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ছিল। তবে তৃতীয় আরেকটি জাতীয়তাবাদী অংশ আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও নাৎসী বাহিনী উভয়ের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেছিল।

ইউক্রেন যাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং নেটোর মতো পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে না পারে সেই চেষ্টা বহুদিন ধরেই করছে রাশিয়া। রাশিয়ার নিরাপত্তা দাবিগুলোর মূলে রয়েছে, ইউক্রেনকে কখনোই নেটো সামরিক জোটে নেওয়া যাবে না। রাশিয়া বলছে, নেটো ইউক্রেনকে বহু অস্ত্র দিচ্ছে এবং আমেরিকা রাশিয়ার অগ্রগতি থামাতে উত্তেজনায় হাওয়া দিচ্ছে। পূর্ব ইউক্রেন নিয়ে ২০১৫ সালে মিনস্ক চুক্তি নামে আন্তর্জাতিক যে চুক্তি হয়েছিল তা মানা হচ্ছে না বলেও রাশিয়া ক্ষুব্ধ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং রাশিয়া- উভয়ের সাথেই ইউক্রেনের সীমান্ত রয়েছে, কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হওয়ার কারণে রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের ঐতিহাসিক সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রয়েছে।

২০১৪ সালে যখন ইউক্রেনে রুশপন্থী প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, রাশিয়া সৈন্য পাঠিয়ে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় ক্রাইমিয়া দখল করে নেয়। একই সময়ে রাশিয়ার সাহায্যে জাতিগত রুশ বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বড় একটি এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তখন থেকেই বিদ্রোহীদের সাথে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে।

রাশিয়া চাইছে, ১৯৯৭ সালের আগে নেটোর যে সীমানা ছিল সেখানে এই জোটকে ফিরতে হবে। তারা দাবি করছে, পূর্ব ইউরোপে নেটোর সম্প্রসারণ এবং সামরিক তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। তার অর্থ, পোল্যান্ড এবং সাবেক তিন সোভিয়েত রিপাবলিক লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া এবং লাতভিয়া থেকে নেটো সৈন্য সরাতে হবে এবং পোল্যান্ড এবং রুমানিয়ার মতো দেশ থেকে নেটোর মোতায়েন করা ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে ফেলতে হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই অভিযান প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য রাশিয়ার সতর্ক বার্তা। এখন পূর্ব ইউরোপে পুতিন রাশিয়ার প্রভাববলয় তৈরি করতে চান। এছাড়া এ হামলার মাধ্যমে পুতিন পশ্চিমাদের কাছে জানান দিতে চান, রাশিয়া এখনও বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর। কিন্তু এই যুদ্ধে যেসব সাধারণ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, তার মূল্য কিভাবে দিবেন পুতিন?

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২২ 
টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।