ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় বাঁচতে পারেন সৈয়দ মহিউদ্দিন

শামসুল আরেফীন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৩ ঘণ্টা, মে ৮, ২০২২
প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় বাঁচতে পারেন সৈয়দ মহিউদ্দিন সৈয়দ মহিউদ্দিন

চাটগাঁইয়া গানের শক্তিমান গীতিকার সৈয়দ মহিউদ্দিন (মহি-আল-ভান্ডারী) দীর্ঘকাল ধরে গুরুতর অসুস্থ। ২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের ডিসি হিলে এক অনুষ্ঠানে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

সেদিন তিনি ক্রেস্ট ও সনদ নিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়ে বাম হাত ও বাম পা ভেঙে ফেলেন।  

নগরীর সার্জিস্কোপ হাসপাতালে তাঁর প্রাথমিক চিকিৎসা চলে। তিনি সুস্থ না হলেও প্রায় ২০ দিন পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন থেকে প্রায় একবছর শয্যাশায়ী থাকার পর তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে অথবা রিকসায় চড়ে কিছুটা চলাফেরা করতে পারতেন। এভাবে দেড় বছর চলার পর আবার তিনি আছাড় খেয়ে বাম হাত ও বাম পায়ে মারাত্মক আঘাত পান। এরপর থেকে তিনি পুরোদমে শয্যাশায়ী।  

কাতালগঞ্জে আনিকা কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন ভাড়া করা একটি সেমিপাকা গৃহে তিনি মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তিনি অকৃতদার হওয়ায় একা একা সেই গৃহে দিন-রাত অতিবাহিত করেন। চাটগাঁইয়ার গানের খ্যাতিমান শিল্পী প্রয়াত শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের পুত্র সঙ্গীতশিল্পী প্রেমসুন্দর বৈষ্ণব, তার পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধা করিম আবদুল্লাহ পরিবার সৈয়দ মহিউদ্দিনের এই দুঃসময়ে তাঁর দেখাশুনা করেন, তাঁকে খাওয়ান-পরান। তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ছাত্রী জলি দাশ, তার স্বামী স্বপন দাশ এবং প্রবাসী আরও অনেকে আর্থিক সহযোগিতা করে থাকেন। বিশেষ করে নিউজার্সি প্রবাসী ইলিয়াস জসিমের নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতার কথা উল্লেখ করার মতো। কিন্তু এভাবে কয়দিন চলবে? এভাবে কি জীবন চলে? তাঁর খাওয়া-পরা ও বাসা ভাড়ার স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। বিশেষ করে তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য দরকার বিপুল অর্থ।
  
আরও যাঁরা চাটগাঁইয়া গানের স্বনামধন্য গীতিকার রয়েছেন তাঁদের মধ্যে রমেশ শীল, মোহাম্মদ নাসির, অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী, মলয় ঘোষ দস্তিদার, এম এন আখতার, আবদুল গফুর হালী, ইয়াকুব আলী, ফণী বড়ুয়া, সনজিত আচার্য, অমলেন্দু বিশ্বাস, অজিত বরণ শর্মা, ইকবাল হায়দার, এম এন আলম, কাজল দাস, গোপাল দাশ, দীপক আচার্য্য, বাবুল আচার্য্য, মো. নূরুল আলম, রনজন চক্রবর্তী, রশিদ কাওয়াল, লক্ষ্মীপদ আচার্য্য ও শাহাদাত আলী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।  

কিন্তু সৈয়দ মহিউদ্দিন ও তাঁদের মধ্যে একটি বড়ো পার্থক্য রয়েছে। তাঁদের অনেকে চাটগাঁইয়া গানের নামে কাউয়া আঞ্চলিক গান ও পল্লিগীতিও রচনা করেছেন প্রচুর। কিন্তু সৈয়দ মহিউদ্দিন সতর্কতার সঙ্গে তা করেননি। তিনি বিশুদ্ধ চাটগাঁইয়া গানই রচনা করেছেন। আরও খোলাসা করে বললে বলতে হয়, তিনি চাটগাঁইয়া গান রচনায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে অন্য কোনো ভাষার মিশ্রণ ঘটাননি। এছাড়াও তাঁর রচিত চাটগাঁইয়া গানে সুর সংযোজনে তিনি আধুনিক মন-মনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন। সুরগুলো একেবারে মৌলিক। এ কারণে চাটগাঁইয়া গানের ইতিহাসে তিনি নিঃসন্দেহে অমর হয়ে থাকবেন।

বলাবাহুল্য, চাটগাঁইয়া গান রচনায় ও তাতে সুর সংযোজনে যিনি এমন কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, সেই সৈয়দ মহিউদ্দিনের লেখালেখির সূচনা কিন্তু চাটগাঁইয়া গান দিয়ে নয়। জীবিকার তাগিদে তিনি ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন, ছড়াও লিখেছিলেন। একসময় সেসব ছেড়ে দিয়ে আধুনিক বাংলা গান রচনায় মনোনিবেশ করেন। তার আগেই তিনি দক্ষতার সঙ্গে তবলা বাজাতে শিখেছিলেন, সুর সম্পর্কে অর্জন করেছিলেন অসাধারণ জ্ঞান।  

সৈয়দ মহিউদ্দিন জানিয়েছেন, ‘আমি কুমিল্লায় ওস্তাদ সুরেন দাসের সান্নিধ্যে গিয়েছিলাম। তাঁর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখেছিলাম। ওস্তাদ সোবহান সাহেব আমাকে তবলা শিখিয়েছিলেন। ঢাকায় কলকাতার ওস্তাদ শওকত আলী কাদেরি সাহেবের সান্নিধ্য মনে রাখার মতো। তিনিও আমাকে তবলায় কিছুদিন দীক্ষা প্রদান করেন। চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ প্রিয়দারঞ্জন সেনগুপ্তের সংস্পর্শ ও স্নেহ পেয়েছিলাম। তিনি সঙ্গীতের বিভিন্ন বিষয়ে আমাকে জ্ঞান দান করেন’।  

আধুনিক বাংলা গান রচনাকালে সৈয়দ মহিউদ্দিন মাসিক সঙ্গীত পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ ছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি ২৫টি আধুনিক বাংলা গানের পাণ্ডুলিপি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে জমা দিয়ে  তালিকাভুক্ত গীতিকারে পরিণত হন। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের অনুরোধে চাটগাঁইয়া গান লিখতে শুরু করেন। প্রথমে তীর মশলা কোম্পানির জন্য চাটগাঁইয়া ভাষায় লিখেছিলেন একটি বিজ্ঞাপনী গান। তারপর লিখেছিলেন:

অ জেডা ফইরার বাপ/একদিন বুঝিবা জেডা একদিন বুঝিবা।
ক্ষেতর উদ্দি কোণা কুইন্যা আর কতদিন হাডিবা,
তোঁয়ার ক্ষেতদি কেয় হাডিলে হেঁত্তে ওয়া গাইল দিবা।
হারা বছর গরু ছঅল এদ্দি এদ্দি পালিলা,
বাঁধি বুল্যাই কইলে জেডা ভেটকাই ভেটকাই হাসিলা,
হাসি হাসি জোলম গরি বটতলে তুঁই কি নিবা।
বালতির ভুতুর পানি রাখি দুধ দোয়াইতা জঅ,
এক বালতি দুধ গাইএ দিএ মাইনচুরে বুঝঅ,
এই পাইন্যা দুধুর বেচা টেঁয়া কন সন্দুখুত রাখিবা।
তোঁয়ারঅ ক্ষেতত বাইউন মরিচ কধু ধরে জানি,
ঢাগর ক্ষেতর কধু কিল্যাই ঠেংগে ছিঁড় টানি,
হেই পরর জিনিস ভার পুরাই লই নিজুর উয়াইর পুরাইবা।
তোঁয়ার বাপ ভাই আইন-ত মাইনচে কয় বউত তরবিয়ত,
তুঁই কত্তুন পাইলা জেডা এইল্যা কু খাছিয়ত,
গোডা জীবন কাডাই দিলা হালাল কঁত্তে চিনিবা।

এটাই সৈয়দ মহিউদ্দিনের প্রথম চাটগাঁইয়া গান। ১৯৮১ সালে শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের কণ্ঠে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে প্রচারিত হলে তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তারপর থেকে সৈয়দ মহিউদ্দিন একের পর এক চাটগাঁইয়া গান লিখে গেছেন। তাঁর রচিত ও সুরারোপিত জনপ্রিয় ও উল্লেখযোগ্য চাটগাঁইয়া গান হলো ‘মেজ্যান দিএ মেজ্যান দিএ ঐতারত’, ‘সাম্পান মাঝি সাম্পান বায় আগর মতো পেসিঞ্জার ন পায়’, ‘অউডা কঅছে ভাইপুত ক্যেনে বলে ম্যাট্টিক পাশ গল্লি’, ‘আঁরা এই সংসারত মিলিমিশি আছি দুয়া জাল’, ‘গর্কি তুয়ান বন্যা খরা মহামারি ঘূর্ণিঝড়’, ‘তারা সাত ভাইউত্তে উগ্যা ভৈন পাতা বালি নাম পাতা বালি’, ‘তালাকনামা পাঠাই দিলাম চিঠির ভিতরে’, ‘লি লি লি লি লি আঁয় আঁয় মোয়াপে’, ‘আইচ কাইল ঢেঁইর ঘরত কম দেখা যায় ধান’, ‘আঁই কারে কইলাম কি তুঁই কি হুনিলা কি’, ‘আঁর বউয়রে আঁই হাসাইয়ম আঁই কাঁদাইয়ম’, ‘আঁর বাপর বাড়ি কধুরখীল হউরু বাড়ি গুজারা’, ‘আসকার ডিঁইর পুকপাড়ে আঁর ভাঙাচোরা ঘর’, ‘আহ্ হায় রে গরু টানের গরু গাড়ি’, ‘এই পোয়াছা আঁর বরই গাছত তোরা’, ‘কিল্লাই গেলি ঠিক ধুইজ্জ্যা ভাঙিবুল্যাই বোলার বাআ’, ‘তুঁই বন্ধু আঁর সুখ পিঞ্জরার ভাগ্যুর লটারি’, ‘থগ্যই থগ্যই রে তে আইস্যেল ভালা’, ‘পোয়ার মনত শান্তি নাই শান্তি নাই ভাত পানি ন খার’, ‘বউ আইনতু যার দুলা মিঞা গদুনাত চড়ি’, ‘বন্ধু ঘরর কামরা পুরাই দিলা চালানি পাঠাই’, ‘মন কাচারা মাঝি তোর সাম্পানত উইটতাম নঅ’ ও ‘অজেডা ফইরার বাপ’ প্রভৃতি।  

এসব গান তাঁকে শুধু বড়ো মাপের গীতিকার নয়, কিংবদন্তিতুল্য গীতিকারেও পরিণত করেছে। উল্লেখনীয়, তাঁর চাটগাঁইয়া গান শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ছাড়াও গেয়েছেন শেফালী ঘোষ, আবদুর রহিম, সনজিত আচার্য্য, কল্যাণী ঘোষ, কল্পনা লালা, রবি চৌধুরী, আলাউদ্দিন তাহের, শিমুল শীল, প্রেমসুন্দর বৈষ্ণব, জলি দাশ, ফকির শাহাবুদ্দিন, প্রিয়া ভৌমিক, পান্না চেমন, চৈতি মুৎসুদ্দি, শেফালী সরগম, পলি শারমিন, তাপস বড়ুয়া, সাইফুদ্দিন পারভেজ ও নিখিলেশ বড়ুয়া প্রমুখ।

সৈয়দ মহিউদ্দিন চাটগাঁইয়া গান ছাড়াও অনেক মরমি গান ও মাইজভাণ্ডারী গানও রচনা করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর জনপ্রিয় মরমি গান ‘ওরে আইতে নিজে কান্দিলি যাইতে কান্দাবি স্বজন/দুই কান্দনের বাঁধনে তোর জীবন ও মরণ’ এবং জনপ্রিয় মাইজভাণ্ডারী গান ‘তুমি রাজভাণ্ডারীর খাস ভাণ্ডারী বাবা শফিউল’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মরমি গানটি এখানে উপস্থাপন করা যাক:

(ওরে) আইতে নিজে কান্দিলি যাইতে কান্দাবি স্বজন
দুই কান্দনের বাঁধনে তোর জীবন ও মরণ।
ওরে ভোলামন...

কেন এত হাসাহাসি, অতি ভালোবাসাবাসি,
মিঠা রঙ্গ মাখামাখি ক্যান্ রে ভোলামন?
ওরে কচু পাতার জলের কথা রাখিও স্মরণ।

খুন, লিপ্সা, ভাগাভাগি, তার ভেতরে রাগারাগি,
হিংসা তরে মারামারি ক্যান রে ভোলামন?
ওরে দুষ্টু কর্মে ইবলিসের ইচ্ছা হয় পূরণ।

আছে বলে পরাণপাখি গায়ের জোরে হাঁকাহাঁকি,
দমের নিশ্বাস অবিশ্বাসী য্যান রে ভোলামন?
ওরে পুট্টুস কইরা দেহ ছাড়ি যাইতে কতক্ষণ?

চিতা কিংবা গোরস্থানে, আগুন না হয় মাটির সনে
রঙ্গ সাঙ্গ হইবার আগে য্যান রে ভোলামন?
সৎ গুরু তোকাইয়া ধরো মহির নিবেদন।

তিনি রাগপ্রধান গানও লিখেছেন, যা কাবেরি সেনগুপ্তা প্রমুখ গেয়ে থাকেন। এমন গীতিকারের দীর্ঘকাল ধরে অসুস্থতার কারণে করুণ দশা সত্যিই বেদনাদায়ক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা যদি তাঁর দিকে একটু সুনজর দেন, তাঁকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন, তাহলে দেশে বা বিদেশে তাঁর উন্নত চিকিৎসা হতে পারে, তিনি বেঁচে যেতে পারেন। তিনি সুস্থ হয়ে আবারও মৌলিক চাটগাঁইয়া গান রচনায় ও তাতে সুর সংযোজনে মনোযোগ দিতে পারেন এবং তা ছড়িয়ে দিতে পারেন চট্টগ্রাম তথা বাংলার আকাশে-বাতাসে।

লেখক: লোকসাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।    

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০২২
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।