বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আবারো উত্তপ্ত এবং নাটকীয় ঘটনায় মোড় নিতে চলেছে। সাধারণ নির্বাচনের এখনো দুই থেকে আড়াই বছর বাকি, এরই মাধ্যে শুরু হয়েছে বিদেশি মেহমানদের আনাগোনা, নানা নসিহত, দেখা-সাক্ষাত।
নিজের ঘরের সমস্যা, নিজের ঘরের অন্দর মহলের ঝগড়া-ঝাটি, নিজেদের মান-অভিমান ইত্যাদি নিয়ে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, তাদের সমর্থন আদায়ের জন্য প্রতিনিয়ত দৌড়-ঝাপ এর কি যে এক তীব্র প্রতিযোগীতা- কী সরকারি, কী বেসরকারি, কী ছোট, কী বড় দলগুলোর মধ্যে একধরনের স্নায়ুযুদ্ধ্ব দেখে, হতবাক হয়ে যাই। ভেবে অবাক হই, রাজনৈতিক দল এবং নেতা-নেত্রীদের দৈন্যতা দেখে, নিজেদের সমস্যা নিয়ে অযাচিতভাবে বিদেশিদের ডেকে এনে জড়ানোর কীর্তি-কলাপ দেখে ভিমড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। এই যখন আমাদের নেতা-নেত্রী আর তাদের দলগুলোর অবস্থা, তাহলে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সাধন কী করে হবে? যারা নিজেরাই দেউলিয়া, নিজেদের রাজনৈতিক এই দৈন্যতা দিয়ে আর যাই হোক জনকল্যাণ করা যাবেনা। বাংলাদেশের বিগত ৪০ বছরের রাজনৈতিক অবস্থা এবং এর অবস্থান অন্তত তাই আঙ্গুল দিয়ে আমাদেরকে দেখিয়ে দেয়।
আমার মতো আর দশজন সাধারণ-খেটে খাওয়া সাধারণ বাংলাদেশি যারা বিদেশ-বিভূঁইয়ে পড়ে আছেন, দেশের জন্য যাদের মন-প্রাণ প্রতিনিয়ত কাঁদে, তারা অন্তত স্বীকার করবেন যে, যে সব সম্মানিত রাষ্ট্রদূতেরা দায়িত্ত্ব নিয়ে আমাদের দেশে যান, বিশেষত বিলেত-আমেরিকা-ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের কথা বলছি, সাধারণত সেই সব দেশের সম্মানিত রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশে যাওয়ার আগে নিজেদের দেশের মিডিয়া কিংবা সাধারণ জনগনের মধ্যে তাদের ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ, সাড়া, কিংবা পরিচিতি বলতে গেলেই ছিল না, বা একেবারেই শুন্যের কোঠায় থাকে। অথচ বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটির মাটিতে পা দেবার আগে থেকেই শুরু হতে থাকে সেই সব সম্মানিত রাষ্ট্রদূতদের এমন সব প্রচার-প্রচারণা, আর আমাদের সম্মানিত সেই সব অতি ক্ষমতাধর মাননীয় নেতা-নেত্রীদের তাদের প্রতি অতি আগ্রহের বদৌলতে রাষ্ট্রদূত নামের সম্মানিত সেই পদবিটি তখন আমাদের কাছে হয়ে যায় অতি মূল্যবান এক সোনার হরিণ। কারণ তাদের একটুখানি সাক্ষাত, একটুখানি সহানুভূতি আর সমর্থন তথা তাদের সঙ্গে ফটোসেশন আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের ভবিষ্যৎ এর নিয়ন্ত্রক তথা হর্তা-কর্তায় উপনীত হয়ে থাকে। এভাবে আমরা নিজেরাই তাদেরকে এক মহা ক্ষমতাধর শক্তিশালী ব্যক্তিতে পরিণত করে দিয়ে আমাদের নিজেদের বিষয়ে সিদ্ধ্বান্ত গ্রহণের সুযোগ করে দিয়ে থাকি।
এর বদৌলতে রাতারাতি তিনি বা তারা পেয়ে যান মিডিয়া পরিচিতি, যেন রূপালী পর্দার তারকা খ্যাতিকে অনেক ক্ষেত্রে তারা ছাড়িয়ে যান, কারণ সর্বক্ষেত্রেই যে তাদের নসিহত, বাণী অবধারিত।
আমাদের অতি ক্ষমতাধর নেতা-নেত্রীদের কল্যাণে এইসব রাষ্ট্রদূতেরা নিজেরাও অনেক সময় ভুলে যান তাদের ডিপ্লোম্যাটিক দায়-দায়িত্ত্ব আর সীমার কথা। যেমন আগের টার্মের মার্কিন ও ভারতীয় রাষ্ট্রদূতগণ আর ইউরোপীয় কূটনৈতিকবৃন্দ। কোনো ক্ষেত্রে কোনো আমাদের নেতাদের ডোনার এজেন্সির রিপ্রেজেনটেটিভদের দ্বারস্থ হতে দেখে নিজেকেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হয়।
বড় কষ্ট হয়, বড় আক্ষেপ এর সাথে বিগত দশক ধরে লক্ষ্য করে আসছি যে, জাতীয় কোনো ইস্যূতে এক হওয়াতো দূরে থাকুক, নিজেদের ঝগড়া-ফ্যাসাদ নিয়ে বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়ে জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিতে এই সব রাজনৈতিক কুশীলব নেতা-নেত্রীদের বুক সামান্যতম কেঁপে ওঠেনা। বরং এতে নিজেদের বাহাদুরি, নিজেদের প্রতিপত্তি আর ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য সব কিছু, যদি পারতেন উনারা গোটা দেশটাই বিক্রী করে দিয়ে হলেও বুক টান করে বলতেন, অমুক রাষ্ট্রদূত আমার বন্ধু, অমুক রাষ্ট্রদূত আমাকে সমর্থন করেছেন!
হায়রে রাজনীতি, হায়রে আমাদের অতি ক্ষমতাধর, অতি জনপ্রিয় নেতা-নেত্রীরা! আমাদের লজ্জা হয় আপনাদের সেইসব কর্মকাণ্ডে। আপনাদের লজ্জা করেনা, একজন রাষ্ট্রদূতের দরবারে হাজিরা দিয়ে বা তাকে সুযোগ করে দিয়ে আবদার জানাতে বা ঘরোয়া রাজনৈতিক বিষয়ে তাকে মিমাংসা, ফায়সালার মোড়ল বানাতে! তাদের নসিহত নিয়ে তাদের কথামতো, তাদের ফর্মুলায় রাজনৈতিক সিদ্দ্বান্ত নিতে। কতটুকু দৈন্য, কতটুকু দেউলিয়া হলে কোনো দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল এবং তার নেতা-নেত্রীরা এমন নগ্নভাবে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের রাজনীতিতে অবধারিতভাবে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিতে পারেন তার সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা আমাদের সমকালীন নেতারা।
মাননীয় অতি ক্ষমতাধর আর অতি জনপ্রিয় নেতা-নেত্রীগণ আপনাদের এইসব কর্মকাণ্ড দেখে কবরে থেকেও আপনাদের পূর্বসূরী এবং বাঙালির প্রিয় মুজিব ভাই টুঙ্গিপাড়ায় শায়িত বঙ্গবন্ধু, সন্তোষে শুয়ে থাকা প্রিয় মাওলানা ভাষানী, রাজধানীর বুকে শুয়ে থাকা রাজনীতির শ্রেষ্ঠ দার্শনিক প্রিয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর বাংলার বাঘ শেরে বাংলা ফজলুল হক আর সংসদ চত্ত্বরে শায়িত প্রিয় জিয়াউর রহমান, সিলেটের কোলে শায়িত মেজর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীও লজ্জায় অবনত মস্তকে ডুঁকরে কেঁদে ওঠেন নিশ্চয়! বাঙ্গালীর মননে-মগজে-মস্তকে এইসব অনাচার দেখে বোধ করি তারা ধিক্কার দিতে থাকেন, নিজ জাতির এমন অধঃপতনে বিষাদময় হয়ে ওঠে তাদের পারলৌকিক জগৎ। এ পটভূমিতে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বারবার ফুলদিয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন, শহীদ আর বিজয় দিবসের কুচ-কাওয়াজ আর তোপধবনি তাদের কাছে আজ বড় বেমানান করে তুলেছে- ধারণা করছি।
চল্লিশ বছরে যে বাংলাদেশ হতে পারতো মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর, যে বাংলাদেশ হতে পারতো সারা বিশ্বের কাছে আদর্শ মডেল রাষ্ট্র, সেই বাংলাদেশ আজো খুড়িয়ে,খুড়িয়ে হাঁটে, লক্ষ্য খুঁজে বেড়ায় প্রতিনিয়ত, আর ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রীদের বিদেশি দাতা আর ডোনারদের কাছে ধর্না দিয়ে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়- এই কি ছিলো আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য!
গত চল্লিশ বছরে এই রাজনৈতিক দলগুলো আর এর নেতা-নেত্রীরা কী করেছে! তারা জাতিকে এখন পর্যন্ত দিতে পারেননি কোনো সঠিক দিক-নির্দেশনা। অথচ উনারা অভিজ্ঞতা আর জনপ্রিয়তার বিশাল ভাণ্ডর নিয়ে জাতির ললাটে এঁকে চলেছেন একের পর এক উম্মত্ত্ব ক্ষমতার লড়াইয়ের ইতিহাস। এই কি আমাদের জনগণের প্রাপ্তি? এই কি আমাদের জনগণের সকল আশা-ভরসার নিয়তি? এই অবস্থা থেকে কি আমাদের কোনো পরিত্রাণ নেই!
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৯ ঘণ্টা, ০৬ মার্চ, ২০১২