সহকর্মী সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনির নৃশংস হত্যার প্রায় এক মাস হতে চললো। কিন্তু সাংবাদিক এই দম্পতি হত্যা রহস্যের কোনো কূল-কিনারা এখনো হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, বিএনপি নেতাসহ অনেকেই নানা কথা বলেছেন। অমানবিক হত্যার পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের বক্তব্য অনুযায়ী ৪৮ ঘণ্টা সময় পার হয়েছে বহুদিন আগেই। ৬৪৮ ঘণ্টাও পার হয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রীর তাৎক্ষণিক উচ্চবাক্য এখন তামাশায় পরিণত হয়েছে।
নৃশংস এ জোড়াখুনের রহস্য উদঘাটনের চেয়ে কথা হচ্ছে বেশি। বর্তমানে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি রাজনীতিতে উপনীত। প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, সরকারের পক্ষে বেডরুম পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে, বিরোধী দলীয় নেত্রী বলেছেন, সরকারের দুর্নীতির গোপন তথ্য থাকায় সাংবাদিক সাগর ও রুনিকে খুন করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করা হয়েছে।
সরকার নিয়োজিত প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট শাখার কার্যক্রম হতাশাব্যঞ্জক। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ কেন, সংবাদকর্মীরাই বোধ হয় সত্যিকারভাবে কিছু বলতে পারছেন না।
সাংবাদিক দম্পতি হত্যার রহস্য উন্মোচনে সরকারের ব্যর্থতায় গোটা সাংবাদিক সমাজ আজ ঐক্যবদ্ধ। যদিও এ ঐক্যের প্রক্রিয়া শুরু বেশ কিছুদিন আগ থেকেই। সাংবাদিকদের অষ্টম ওয়েজ বোর্ড ঘোষণা থেকে শুরু করে সকল সাংবাদিক হত্যার বিচারের দাবিতে বিশিষ্ট সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরীর নেতৃত্বে সারাদেশের সংবাদকর্মীরা এক হয়েছেন। সাংবাদিক সমাজের এ ঐক্য আজ সময়ের দাবি। এ একতা দেশের রাজনীতিবিদদের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও বটে।
সম্প্রতি দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রতিবেদক নিখিল ভদ্র সরকারি সংস্থার বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে পা হারালেন। তখন থেকেই যেন দেশের সংবাদকর্মীরা জ্বলে উঠলেন। রাজপথে নেমে এলো সাংবাদিকতা পেশার প্রায় সকল সংগঠন। রাজধানীর তোপখানা সড়কস্থ জাতীয় প্রেস ক্লাবের দুর্ঘটনা কবলিত এলাকা সেদিন অবরুদ্ধ হলো বিক্ষুব্ধ সাংবাদিকদের বিক্ষোভে। পা হারানো সহকর্মী বন্ধু নিখিলের সে ঘটনার প্রতিবাদের রেশ না ফুরাতেই মাত্র ক’দিন পর ঘটলো আরো একটি ঘটনা। অল্প মূল্যের জাতীয় একটি দৈনিক থেকে চাকরিচ্যুত প্রতিবেদক দীনেশ দাস নিহত হলেন সরকারি সংস্থার স্টাফ বাসের চাকার তলায়। এ ঘটনায়ও রাজপথ প্রতিবাদমুখর হলো। তবে তা তীব্রভাবে। হৃদয়বিদারক এ ঘটনার প্রতিবাদ ও বিচার এবং নিহত সাংবাদিকের পরিবারকে পুনর্বাসনের দাবিতে সেদিন দলে দলে একত্র হলেন সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ।
আহত সাংবাদিক নিখিল ভদ্রের সুচিকিৎসা এবং প্রয়াত সাংবাদিক দীনেশ দাসের পরিবারকে পুনর্বাসনের দাবিতে যখন সোচ্চার হলেন সারাদেশের সাংবাদিকরা, তখনি সবার টনক নড়লো। এগিয়ে এলো সরকার, বসুন্ধরা গ্রুপ এবং কয়েকটি ব্যাংক।
কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অপ্রত্যাশিত এবং ন্যক্কারজনক ঘটনা দু’টিতে অনিরাপদ সড়কের ভাবনায় দেশবাসী গভীর আচ্ছন্ন। ঠিক এমন সময় সামাজিক নিরাপত্তায় আবারো ছন্দপতন হলো। রাজধানীতে খুন হলেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। এ যেন পরিকল্পিত হত্যা। ক্ষত-বিক্ষত এবং রক্তাক্ত অবস্থায় পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া এ সাংবাদিক দু’জন একমাত্র অবুঝ সন্তান মেঘকে রেখে গেলেন। মেঘ যাতে আড়াল হয়ে না যায় সেজন্য প্রধানমন্ত্রী ওনার জীবন অবধি ওর সকল দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু লোমহর্ষক এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে তার সরকারের দায়িত্বহীনতা দেশের সকল মানুষের কাছে এখন পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। রাজধানীতে এতোবড় হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে যখন কোনো কিনারা হচ্ছে না, তখন দেশের সংঘবদ্ধ সকল সাংবাদিক ফোরাম জেগে উঠেছে।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ ফোরামের সমাবেশ হয়েছে। হুইল চেয়ারে করে এ সমাবেশে যোগ দেওয়া প্রবীণ সাংবাদিক, বিশিষ্ট কলামিস্ট অনিকেত (ছন্দনাম) অর্থাৎ অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা নির্মল সেন লিখিত বক্তব্যে সাংবাদিকদের নিরাপত্তায় এ ঐক্যকে অভিনন্দন জানান। হাসপাতলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় টেলিফোনে সংহতি প্রকাশ করেন আরেক প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবিএম মূসা। অনেকেই সকল সাংবাদিক হত্যার বিচারের দাবিতে সাংবাদিকদের এ ঐক্যকে সাধুবাদ জানান সেদিন।
সাংবাদিক দম্পতি হত্যার বিচার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মন্তব্য সম্পর্কে আমার একজন ফেসবুক বন্ধু লিখেছেন, সরকারের পক্ষে রাজপথ পাহারা দেওয়া সম্ভব কী? আমার মন্তব্য এটা হয়তো সম্ভব! দেশের অধিকাংশ মানুষ সমকালীন বিষয়কে প্রাধান্য দেয়। চলমান ঘটনা বা ইস্যু আগের বিষয়টিকে আড়াল করে দেয় কিংবা ধামাচাপা দিয়ে ফেলা হয়। যেমন আড়াল বা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে সাংবাদিক শামসুর রহমান, মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালুসহ অসংখ্য নিবেদিত সংবাদকর্মীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কামালউদ্দিন সবুজ দু’ ধারায় বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের একীভূত হওয়ার ব্যাপারে অনাপত্তি জানিয়েছেন। অধিকাংশই একে ইতিবাচক মনে করছেন। রাষ্ট্রনীতিতে প্রত্যেকের রাজনৈতিক একটি মতাদর্শ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি মনে করি, যে কোনো পেশায় রাজনীতিকরণ অবাঞ্ছনীয়। সাংবাদিকতা পেশায়তো অবশ্যই তা কাম্য নয়, তাতে সাংবাদিকতা জনগণের কাছে নিরপেক্ষতা হারায়। ঐক্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট পেশার সুরক্ষা করে এবং তাতে পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় রাখে। অতি সম্প্রতি প্রয়াত তিনজন এবং গুরুতর আহত একজন সাংবাদিকের ক্ষেত্রে তা আমরা লক্ষ্য করেছি। তবে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এ ঐক্য প্রক্রিয়ায় দুরভিসন্ধির বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে। কেননা, দেশের পচনশীল সমাজ এবং রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের মধ্যে আমরা আজ আবদ্ধ। এ খোলস থেকে কবে আমরা মুক্ত হবো?
সাগর-রুনিসহ সকল সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে আগামী ১৮ মার্চ রাজধানীতে সাংবাদিক ঐক্যের মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও রয়েছে। আমি মনে করি, আমাদের সাংবাদিকদের এই ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস অবশ্যই একটি ইতিবাচক ফল দেবে। আর সে প্রত্যাশার প্রতীক্ষায় রইলাম।
সুস্বাগতম সাংবাদিক ঐক্য। শান্তি কামনা করি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিসহ নিহত সব সাংবাদিকের আত্মার।
লেখক অর্থনীতি বিষয়ের সাংবাদিক
[email protected]
বাংলাদেশ সময় : ১৬৪১ ঘণ্টা, ০৮ মার্চ, ২০১২