বরিশাল: সময় যত ঘনিয়ে আসছে সরব হচ্ছেন বরিশাল সিটি নির্বাচনে (বিসিসি) অংশ নিতে চাওয়া প্রার্থীরা। গোটা শহরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এবারের মেয়র প্রার্থীরা।
দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর গত দুই সপ্তাহ নির্বাচনী কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছেন তিনি। যদিও তার সঙ্গে হাতে গোনা কজন ছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। মেয়র সেরনিয়াবত সাদিক আব্দুল্লাহ তার চাচাকে সমর্থন দেবেন বলেছেন। কিন্তু এ কদিনের খোকনের সঙ্গে তার নেতাকর্মীদের দেখা যাচ্ছে না। ছাত্রলীগের নেতাদের দিয়ে টানা কয়েক বছর বরিশালে একক আধিপত্য দেখিয়েছেন সাদিক। কিন্তু তার ভূমিকা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে জনমনে।
সাদিকের লোকজন না থাকলেও খোকনের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে সাবেক সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণের ঘনিষ্ঠজনদের। সাবেক ছাত্রনেতারাও রয়েছেন খোকন সেরনিয়াবাতের সঙ্গে। বিভিন্ন স্থানে প্রচার-প্রচারণায় তারাই বর্তমান প্রার্থীর সঙ্গী হচ্ছেন। এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়, খোকনের কাছে যারা (বর্তমান ছাত্রলীগ নেতারা) ভিড়তে পারছেন না, সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা তাদের ‘মাথাব্যথার’ কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন কিনা।
এদিকে নিজের নির্বাচনী প্রচারণায় বিদ্রোহীদের সঙ্গে নিচ্ছেন খোকন সেরনিয়াবাত। বর্তমান ছাত্রলীগ নেতাদের দাবি, বিতর্কিতদের নিয়ে খোকনের নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতিকর।
বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম এ ব্যাপারে নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো অপশক্তি বিতর্ক তৈরি করতে চাইলেও তারা কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি করতে চান না। তাদের মূল লক্ষ্যই হলো নির্বাচনে জয়লাভ করা।
এদিকে খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ান অভিযোগ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এবারের সিটি নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে বর্তমান মেয়র সাদিকের অনুসারীরা। এবারের প্রার্থীকে তারা (সাদিকের লোকজন) সহায়তা করছেন না। কিন্তু যারা ভোটের মাঠে আছেন তাদের বিতর্কে ফেলার চেষ্টা করেই যাচ্ছেন।
অসীম দেওয়ান বলেন, কৌশলে প্রার্থীকে বাদ দিয়ে আমরা যারা তার পক্ষে কাজ করছি তাদের বিরুদ্ধে লেগেছে ষড়যন্ত্রকারীরা। কয়েকবছর আগে আমাকে ফাঁসিয়ে অস্ত্র দিয়ে আটক করানো হয়েছিল। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত আমাকে খালাস দিয়েছেন। শুধু এভাবেই ষড়যন্ত্র না, আমার বাড়িঘরে হামলা করা হয়েছিল; আমাকে বরিশালে থাকতে দেয়নি। আবার ঢাকায় গিয়েও যে রক্ষা পেয়েছি এমনটা নয়, সেখানে আমার ওপর হামলা হয়েছে।
সব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে যখন নিজ এলাকার রাজনীতিতে সক্রিয় হতে সুযোগ পেয়েছি; সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীরা আমাদের নিষ্ক্রিয় করতে ফন্দি আঁটছে। এবারের প্রার্থী যেসব প্রোগ্রামে অংশ নেন, সেসবে আসে না মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ (সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারী)। তারা আলাদা প্রোগ্রাম করছে, যা নৌকার প্রার্থীর প্রতি বিরোধিতার প্রমাণ দেয়। কিন্তু বরিশালবাসী জানে কারা শেখ হাসিনার পক্ষে, কারা নৌকাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন।
মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জসীম উদ্দিনের দাবি, সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণের মৃত্যুর পর আমাদের কোণঠাসা করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছে বর্তমান মেয়র ও তার লোকজন। শুধু আমার কথা যদি বলি, পোশাকের শো-রুমে লুটপাট চালিয়ে আমার নাম দেওয়া হয়েছে। আমাদের কর্মী হত্যা করে আমাকে সেই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। কিন্তু কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ফলে সব মামলা থেকে আমি মুক্ত হই। এতেও যে তারা থামছে, তাও নয়। আমার এবং আমার বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও হামলা-ভাংচুর চালানো হয়েছে। এত ষড়যন্ত্রের মধ্যেও যখন আমিসহ সাবেক ছাত্রনেতারা আবারও রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হচ্ছি, নৌকার বিজয় নিশ্চিতে কাজ করছি- আমাদের নিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। প্রার্থীর পাশ থেকে লোকজন সরিয়ে দিতে পারলেই তাদের মিশন সাকসেস হবে।
শুধু যে মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের বিরুদ্ধে কর্মকাণ্ড পরিচালনা হচ্ছে, তাও নয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও বর্তমান মেয়রের লোকজন কাজ করছে। বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজের ছাত্র কর্ম পরিষদের ভিপি মঈন তুষার এ অভিযোগ করেন। তার দাবি, সাদিকের লোকজন তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছে। যারা এসব বলে বেড়াচ্ছে তারা থানা ঘেরাও করেছে; উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনে হামলা করেছে। এসব ভিডিও গণমাধ্যমের কল্যাণে বরিশালবাসী দেখেছে। আবার সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে অপদস্থ করার মতো ঘটনা ঘটালেও টার্গেটে শুধু আমরা! আমরা সাবেকরা রাজনীতিতে সক্রিয় হলে কার কী সমস্যা সেটা বুঝতে পারি না।
এসব অভিযোগের পর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জসীম উদ্দিন, অসীম দেওয়ান ও মঈন তুষারের ব্যাপারে মুখ খোলেন জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও মেয়র ছাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারী আতিকউল্লাহ মুনিম। উল্লিখিত নামগুলোই ‘বিতর্কিত’ দাবি করে তিনি বলেন, বিতর্কের কারণে অতীতে তারা সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। তুষার শিক্ষক মেরেছে, অসীম নারীঘটিত কিডন্যাপ কেসে গ্রেপ্তার হয়েছে। আর জসীম তো নিজেই ধর্ষণ মামলার আসামি। বরিশালের মানুষ এদের ভালোভাবে চেনে। তাদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে রেখে কতটুকু সাফল্য আসবে, সেটাই বড় প্রশ্ন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ সব সময় বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তিনি নৌকার পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা তার নির্দেশেই কাজ করবো। তারা (সাবেকরা) যে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন সেগুলোও ভিত্তিহীন। আদালতে কিছুই প্রমাণ হয়নি।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের বর্তমান ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজীব হোসেন খান বলেন, নৌকার বর্তমান প্রার্থী আমাদের সবার প্রার্থী। নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ রয়েছেন। তাদের পাশে এদের নাম রাখা প্রার্থীকে বিতর্কিত করার চেষ্টা। আমাদের যে প্রার্থী রয়েছেন তিনি সম্ভবত এ সব বিষয়ে জানেন না। আর আমার মনে হয় কিছু চাটুকার আছে যারা চায় না নৌকার কর্মীরা প্রার্থীর কাছে যেতে পারুক। এসব চাটুকারদের সরিয়ে আসল যারা মাঠ পর্যায়ের কর্মী তাদের সুযোগ দেওয়া উচিত।
এসব বিষয়ে বিসিসি নির্বাচনের বর্তমান প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, সবাই একসঙ্গে কাজ করবো বলা হলেও মহানগর কমিটি সেভাবে এগিয়ে আসেনি। আমার নির্বাচনী কার্যালয়ে তাদের আগমন তো দেখি না। এ নিয়ে আমার বলার কি আছে? আমি নৌকার প্রার্থী আমাকে তারা বরণ করে নেবে। সেখানে নগরের যদি কেউ না আসে তাহলে আমি তো জোর করে নিয়ে আসতে পারবো না। তারপরও আমি সবার সঙ্গে কাজ করতে চাই। নির্বাচন ও নির্বাচনের পরেও আমরা একসঙ্গে কাজ করবো, সে আশাই করি।
এ বিষয়ে জানতে বর্তমান মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বরিশালে না থাকায় তাকে পাওয়া যায়নি। ফোন করা হলেও তিনি বারবার কেটে দেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, মে ৪, ২০২৩
এমএস/এমজে