ফরিদপুর: ফরিদপুরে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১ -এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জড়িত। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের সঙ্গে রাজপথে ভূমিকাও রেখেছে ছাত্রলীগ।
কিন্তু ন্যক্কারজনক হলেও সত্য যে, এই সংগঠনটি নব্বইয়ের দশক থেকে যেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্য হয়ে ওঠে ফরিদপুরে।
শুধু প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের ওপর চড়াও হওয়াই নয়, তারা জড়িয়ে পড়ে খুন-জখম, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ধর্ষণ, সরকারি জমি দখল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদক কারবার, তদবির বাণিজ্য, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ অনৈতিক ও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে।
২০০৯ সালের পর এসব অন্যায়-অনাচার পরিচালিত হয়ে এসেছে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক শক্তিকে ব্যবহার করেই।
এই সময়ে ফরিদপুরে ছাত্রলীগের রাজনীতিকে কলুষিত ও ধ্বংস করার জন্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের চেয়েও বেশি দায়ী করা হয় সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার আবদুর রহমানকে। এই সময়ে আবদুর রহমানের ছত্রছায়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
একই সময়ে ফরিদপুরে যুগলীগের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন ফরিদপুর-৪ আসনের আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। যার ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতো যুবলীগ।
ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের অভিযোগ, ফরিদপুরে প্রতি রমজান মাসে মহামারি করোনায় ছাত্রলীগ বেশকিছু সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে সুনাম অর্জন করেছে। কিন্তু তার চেয়ে বহুগুণ বেশি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এই ছাত্র সংগঠনের সকল অর্জন ম্লান করে দিয়েছে। শুধু কলেজ ক্যাম্পাসই নয়, আওয়ামী লীগের হেলমেট বাহিনী হয়ে তারা টেন্ডারবাজি, জমি দখল, মাদক কারবার, তদবির বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ কারবারে জড়িয়ে পড়ে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের মিছিলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে ধারালো অস্ত্রের পাশাপাশি ভারি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গুলি চালানোর ভিডিওফুটেজ এখন ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে ফরিদপুরের ছাত্র রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র রাজেন্দ্র কলেজে জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে পিছিয়ে থাকা ছাত্রলীগের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে। প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের ওপর হামলা চালিয়ে কলেজে আধিপত্য ও রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র সংসদের (রুকসু) প্রতিনিধিত্ব লাভের পর একসময় তারা নিজ দলের প্রতিপক্ষের ওপরেও হামলে পড়ে। সেসময় রাজেন্দ্র কলেজ ছাড়াও পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে তারা সন্ত্রাসের ঘাঁটি গেড়েছিল। বহিরাগত ছাত্রদের হাতে স্থানীয়রাও জিম্মি হয়ে পড়ে। ফরিদপুরের ‘লাট ভাই’ খ্যাত এক আওয়ামী লীগ নেতার প্রশ্রয়ে চলতো এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় এলে ছাত্র রাজনীতির অঙ্গনের এই চিত্রও বদলে যায়। পতন হয় লাট ভাই ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর।
২০০৩ সালে ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে সভাপতি হন মনিরুজ্জামান মনির ও সাধারণ সম্পাদক হন সত্যজিৎ মুখার্জি। ছাত্রলীগের এই অংশ ছিল জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হাসান লাবলুপন্থি। সে সময়ের এমপি ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতাধর মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে বিরোধ চলছিল হাসিবুল হাসান লাবলুর। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে এ বিরোধ চরমে ওঠে।
মাত্র এক বছর না যেতেই ২০১০ সালের ১০ মার্চ ফরিদপুর প্রেসক্লাবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন মোশাররফপন্থিদের বিরুদ্ধে পানি উন্নয়ন বোর্ডে টেন্ডারবাজির অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির। এর পরপরই মিছিলে হামলা চালিয়ে মনিরকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে প্রতিপক্ষ মোশাররফপন্থিরা। এসময় মোশাররফপন্থি এক সাবেক ছাত্রলীগের নেতার নেতৃত্বে ফরিদপুর মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপক আব্দুল হালিমকে কিল-ঘুষি মেরে আহত করা হয়।
২০১৫ সালে একযুগ পরে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে সভাপতি হন নিশান মাহমুদ শামীম ও সাধারণ সম্পাদক হন সাইফুল ইসলাম জীবন। ২০২০ সালে পুলিশের শুদ্ধি অভিযানে খন্দকার মোশাররফের পতনের আগ পর্যন্ত তারাই ছিলেন ছাত্রলীগের পদে।
মূলত এই সময় থেকেই যুবলীগের সঙ্গে মিশে দানব হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ। ফরিদপুরে ছাত্রলীগ এসময় আবির্ভূত হয় ভয়ংকর হেলমেট ও হাতুড়ি বাহিনীর ভূমিকায়। প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনকে পর পুলিশের সহযোগিতায় হামলা চালিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে একক আধিপত্য কায়েম করে ছাত্রলীগ।
২০২০ সালের আগস্টে জেলা ছাত্রলীগের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয় শামীম ও সাইফুলকে। এরপর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার আব্দুর রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদক পদ লাভ করে তানজিলুর রশীদ চৌধুরী রিয়ান ও সাধারণ সম্পাদক হন ফাহিম আহমেদ। এখনো তারা এই পদে বহাল।
জানা যায়, ২০০৪ সালের পর ১৩ বছর বন্ধ ছিল রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্রছাত্রী সংসদ রুকসু নির্বাচন। ২০১৭ আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যদিও ২০১৯ সালের পর আবার বন্ধ হয়ে যায় এ নির্বাচন। তবে তখন থেকে রুকসুর ভবনটি জেলা ছাত্রলীগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। একপর্যায়ে তারা রুকসু ভবনে জেলা ছাত্রলীগের কার্যালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়।
খন্দকার মোশাররফ জামানায় ক্ষমতার ছায়াতলে ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণে রুকসু ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে মাদক আর সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য। রাজেন্দ্র কলেজের শহর শাখার হোস্টেল থেকে জেলা ছাত্রলীগের এক নেতার তত্ত্বাবধানে শহরে মাদকের সরবরাহ করা হতো। এখান থেকে বেরিয়ে জড়িত হতো ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে। এসময়কালে রুকসু ভবন দখল করে সন্ত্রাসী ও মাদকসেবীদের আস্তানায় পরিণত করা হয়।
২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ভোরে শহরের ঝিলটুলী এলাকায় ছিনতাইকারীর হামলায় নিহত হয় ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্টাফ নার্স অরুনিমা ভৌমিক। ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার হাবিবুর রহমান টিটু ও শরিফুল ইসলাম ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীর সদস্য ছিলেন।
২০১৯ সালের ১৮ মে গভীর রাতে ভাঙ্গা রাস্তার মোড়ে সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে ডা. আদনান নামে ফরিদপুর মেডিক্যালের এক ডাক্তারকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শহরের জেনারেল হাসপাতালে ঢুকে সেখানে চিকিৎসাধীন এক নারী রোগীর স্বজন রাসেল নামে যুবককে কুপিয়ে জখম করে জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি দেবাশীষ রায়।
ওই বছরের ৬ আগস্ট শহরের বায়তুল আমান-চাঁদমারি এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের বিবাদে নিহত হন সবুজ নামে এক যুবক। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রুকসু ক্যাম্পাসে রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসে আহত হন ছাত্রলীগের অপর পক্ষের কর্মী সৌরভ মালোসহ আরো কয়েকজন। হত্যায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রক্ষায় তদবির ও পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন আবদুর রহমান।
২০২২ সালের ২৮ আগস্ট অস্ত্র নিয়ে মহাসড়কে মহড়ার ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতাসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের একাংশ অভিযোগ করে জেলা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ মাদক ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৩০ নভেম্বর ফরিদপুরে যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বিএনপির শামা ওবায়েদের একটি বিক্ষোভ সমাবেশে হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ ও চেয়ার ভাঙচুর করা হয়।
সর্বশেষ ফরিদপুরে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ বিবাদ প্রকাশ্য রূপ নেয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফাহিমের ১৫ থেকে ২০ জন সমর্থক দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক আফিফের সমর্থকদের ওপর হামলা চালিয়ে দুজনকে কুপিয়ে জখম করে। এরপর জেলা ডিবি পুলিশের একটি দলের সঙ্গে বোয়ালমারীতে ছাত্রলীগের নেতাদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে গত জুন মাসে।
ছাত্রলীগের রাজনীতির অবনতির এই ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে। ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের মতো একটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ছাত্রলীগের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির মাধ্যমে কলুষিত করা হয় ফমেকের ক্যাম্পাস।
সম্প্রতি ফরিদপুর মেডিক্যালের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় ছাত্রলীগের বহুল আলোচিত তৎকালীন সভাপতি মাশতুরা মোশাররফ ঐষিকা ও সম্পাদক ইমরুল হাসান জীমের সনদ স্থগিতসহ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এ দুজনও আবদুর রহমানের ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। আবদুর রহমানের ক্ষমতাবলে ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন তারা। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তার ওপর চলত ‘স্টিমরোলার’ নির্যাতন।
পরে আ.লীগের পতনের পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবিতে সভাপতি ঐষিকা ও সম্পাদক ইমরুলকে ক্যাম্পাসে আজীবন অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। একইসঙ্গে আরও ১৬ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে ইন্টার্নশিপ বাতিল, সনদ স্থগিত, ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাস থেকে বহিষ্কারসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়।
তবে রাজেন্দ্র কলেজের রুকসু ভবন দখল করে হেলমেট বাহিনীর ভূমিকায় থাকা ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি আজও। তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা খবরও জানা যায়নি এখন পর্যন্ত।
সপ্তাহখানেক আগে এক সন্ধ্যায় যৌথ বাহিনীর অভিযান চালানো হয় ঝিলটুলীতে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির বাড়িতে। তবে কোনো গ্রেপ্তার বা অস্ত্র উদ্ধারের ফলাফল জানা যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০২৪
এসএএইচ