সিরাজগঞ্জ: দীর্ঘ ১৬ বছর দাপটের সঙ্গে রাজনীতির মাঠ চষে বেড়ানো সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এখন লাপাত্তা।
এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক এক মন্ত্রী, চার সাবেক এমপি ও দুই উপজেলা চেয়ারম্যানসহ অনেক নেতা।
খোঁজ নেই সাবেক ছয় এমপি, নয় উপজেলা চেয়ারম্যান, সাত পৌর মেয়রসহ শতাধিক জনপ্রতিনিধির। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতারাও।
গত বছর ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটির নেতারা নিখোঁজ হলেও এতদিন যাদের দমিয়ে রাখা হয়েছিল সেই বিএনপি-জামায়াত সক্রিয় হয়ে উঠেছে জেলার রাজনীতির মাঠে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সদরসহ পুরো জেলাই বিএনপি-জামায়াত ও ছাত্র-জনতার দখলে চলে যায়। ওই দিনই পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর পর থেকে আর দেখা মেলেনি জেলার শীর্ষ নেতাদের। এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে দায়ের হওয়া ১০টি হত্যা মামলা ও একাধিক বিস্ফোরক মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর হাজার হাজার নেতাকর্মী।
ঢাকা, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী, সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি তানভীর ইমাম, সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক এমপি ডা. আব্দুল আজিজ ও সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সাবেক এমপি চয়ন ইসলাম। এছাড়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শামীম তালুকদার লাবু, উল্লাপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান সেলিনা মির্জা মুক্তি ও তাড়াশ উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মনি এবং সাবেক পিপি আব্দুর রহমান, সাবেক জিপি রেজাউল করিম রাখাল গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
চারটি হত্যা মামলার প্রধান আসামি হয়ে পালিয়ে রয়েছেন সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি হাবিবে মিল্লাত মুন্না, তিনটি হত্যা মামলার আসামি হয়ে সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক এমপি আব্দুল মমিন মণ্ডলও পলাতক। তিন হত্যা ও এক অস্ত্র মামলায় কারাগারে রয়েছেন সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরী ও তার স্বামী সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শামীম তালুকদার লাবু।
তিনটি হত্যা ও একটি চাঁদাবাজি মামলার আসামি হয়ে লাপাত্তা সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার।
এছাড়া অন্তরালে রয়েছেন সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সাবেক এমপি তানভীর শাকিল জয়, সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সাবেক এমপি মেরিনা জাহান কবিতা। তাদের সবার নামেই একাধিক মামলা রয়েছে।
হত্যাচেষ্টা মামলায় কারাগারে রয়েছেন সাবেক এমপি ডা. আব্দুল আজিজ, বিস্ফোরক ও ভাঙচুরের মামলায় চয়ন ইসলাম এবং তানভীর ইমামও কারাগারে রয়েছেন। সাবেক মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাস হত্যা ও বিস্ফোরক মামলায় কারাগারে রয়েছেন।
হত্যা মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট কে এম হোসেন আলী হাসান, সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ তালুকদার, সহ-সভাপতি আবু ইউসুফ সূর্য, ইসহাক আলী, বদরুল আলম, সাবেক পৌর মেয়র আব্দুর রউফ মুক্তা, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন, পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক হেলাল উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক সেলিম আহমেদ, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রাশেদ ইউসুফ জুয়েল, যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক একরামুল হকসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের শীর্য পর্যায়ের অধিকাংশ নেতাই। হত্যা, বিস্ফোরক, হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজির মামলায় পালিয়ে রয়েছেন জেলার আওয়ামী লীগপন্থী সব ইউপি চেয়ারম্যান।
পালিয়ে থাকা নেতাদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকলেও অনলাইন ও অফলাইনে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ প্রভাবশালী অনেক নেতার খোঁজ মিলছে না।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারকে গত ডিসেম্বর মাসে লন্ডনে দেখা গেছে এমন একটি সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। তবে জেলার পলাতক বাকি নেতারা কে কোথায় রয়েছেন, সেটা জানা যায়নি।
জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট বিমল কুমার দাস ও অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ সরকারসহ দলের বেশ কয়েকজন আইনজীবী নেতা আদালতে আইন পেশায় থাকলেও রাজনীতির মাঠে তাদের দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে ঠিক যেন আওয়ামী লীগের উল্টো বিএনপি-জামায়াতের ক্ষেত্রে। দুই বছর পর ২০২৪ এর ১৭ অক্টোবর নিজ জন্মভূমি সিরাজগঞ্জের মাটিতে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। এরপর থেকেই তিনি নিয়মিত সভা-সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছেন। দল গোছাতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন সাবেক এমপি জেলা বিএনপির সভাপতি রুমানা মাহমুদ, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু।
রাজশাহী বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিরাজগঞ্জ জেলা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক আমিরুল ইসলাম খান আলীমও মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। সাবেক এমপি আব্দুল মান্নান তালুকদার, এম আকবর আলীসহ একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীরা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।
দীর্ঘদিন এলাকায় আসতে না পারা জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান গত ৫ আগস্টের পর থেকে ছোট বড় শতাধিক সভা-সমাবেশ করে রাজনীতির মাঠে নিজের অস্তিত্বের কথা জানান দিয়েছেন।
এরই মধ্যে জেলার পাঁচটি আসনের দলীয় প্রার্থীর নামও ঘোষণা হয়েছে। বিগত সময়ে বারবার কারা বরণকারী জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা শাহীনূর আলম ও সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক জাহিদুল ইসলাম রাজনীতির মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কয়েকজন নেতাকর্মী বলেন, ক্ষমতায় থাকতে ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন না করে হাইব্রিডদের প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে অযোগ্য, অদক্ষদের কাছে পদ বিক্রি করে দলটির বারোটা বাজিয়ে জেলার শীর্ষ নেতারা পালিয়ে গেছেন। আমরা যারা বঞ্চিত ছিলাম, তারাই বেশি বিপদে রয়েছি।
দলের শীর্ষ নেতারা পলাতক থাকায় এ বিষয়ে কারও মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। মধ্যম সারির আইনজীবী নেতারাও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ১৬ বছর ধরে আমাদের নামে শত শত মিথ্যা মামলা দিয়েছে। মামলা, হামলা আর হুলিয়ার মধ্যে আতঙ্ক নিয়েই আমরা দলের কর্মসূচি পালন করেছি। কর্মসূচির মধ্যেও হামলা চালানো হয়েছে। তারপরও আমরা ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করেছি। এতে দলের নেতাকর্মীদের মামলা-হামলার শিকার হতে হয়েছে। আমাদের নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হয়। তিনি দুই বছর এলাকায় আসতে পারেননি।
তবে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘ ১৬ বছর পর প্রাণ খুলে রাজনীতি করছি। জেলার উন্নয়নের লক্ষ্যে সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করতে পারছি। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, যোগ করেন তিনি।
জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক জাহিদুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগের সময় আমাদের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে একজন সমর্থকও নির্যাতনের বাইরে ছিল না। আমরা সরকারের চাপের মধ্যেও গঠনমূলক রাজনীতি চালিয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ কর্মসূচিগুলো পালন করেছি। কোনো সভা করার চেষ্টা করলেই সেটাকে গোপন বৈঠক আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সহায়তায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে বিস্ফোরক মামলা দিত। রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো ছিল শর্ট। সংক্ষিপ্ত মিছিল করতাম। জনসভার কোনো সুযোগ ছিল না। আমাদের অফিসও খুলতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর আমরা চাপমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে রাজনীতি করতে পারছি। এরই মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়েছে, তাদের শপথও হয়েছে। আমাদের নেতা মাওলানা রফিকুল আলম খান প্রায় সাড়ে তিন বছর কারাগারে ছিলেন। আগস্টের আগে তিনি মুক্তি পান। এলাকায় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারিনি। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর তিনি ছয় মাসে শতাধিক সফর করেছেন, ১৫টির মতো বড় সমাবেশ করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৫
এসআই