জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেছেন, রাজনৈতিক অনেক পুরোনো সমীকরণ আছে, অনেকগুলো পক্ষ আছে যারা আগামী নির্বাচনে অনুপস্থিত থাকবে। এতে নতুন সমীকরণ দেখা যাবে।
তিনি বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র গঠনের যে প্রবণতা তা এবার সমূলে উৎপাটন করতে হবে। জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষার মূল জায়গাটাজুড়ে রয়েছে সংস্কার। পুরো রাষ্ট্রের কাঠামোতে সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো মনে করছেন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কাছে তারা অনেক ক্ষেত্রে নিরাপদ নন। আলটিমেটলি জনগণের কাছেই সব নিরাপত্তা। এটা যদি বুঝতে পারি, তাহলে সব জায়গার মতবিরোধ দূর করা সহজ হবে। সম্প্রতি সমসাময়িক বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন- এ পরিপ্রেক্ষিতে আপনার দলের অবস্থান কী?
সামান্তা শারমিন: গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো শেষে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের যে সময়সীমা ঘোষণা করেছেন সে অনুযায়ী নির্বাচন হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সামনের নির্বাচনটা হওয়া উচিত গণপরিষদ নির্বাচন। এটাই একমাত্র যৌক্তিক পন্থা। সেটার জন্য কীভাবে এগোতে পারি তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ আলোচনা হতে পারে।
প্রশ্ন: সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে আপনারা কোন পথে এগোবেন?
সামান্তা শারমিন: সংস্কার ও নির্বাচনকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখছি না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করা প্রয়োজন সেখানে অবশ্যই সংস্কার আবশ্যক। পাশাপাশি যে প্রেক্ষাপটে জুলাই বিপ্লব হতে দেখলাম সেটা মনে রাখা এবং আমলে নেওয়া উচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আর আমাদের দেশের তরুণরা বারবার রক্ত দিয়ে সে স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার চেষ্টা করে। রাষ্ট্রের যেসব গণতান্ত্রিক কাঠামো আছে তার যথাযথ সংস্কার করা প্রয়োজন। নির্বাচনের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র গঠনের যে প্রবণতা তা এবার সমূলে উৎপাটন করতে হবে। জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষার মূল জায়গাটাজুড়ে রয়েছে সংস্কার। পুরো রাষ্ট্রের কাঠামোতে সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন:সংস্কার প্রশ্নে অনেক মৌলিক ইস্যুতে বিরোধ দেখা দিয়েছে। ওইসব ইস্যুতে দলগুলোর সঙ্গে আপনারা কীভাবে নেগোসিয়েশন করবেন?
সামান্তা শারমিন: সংস্কারের বিষয়বস্তুর কোন কোন জায়গা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। আমাদেরও উদ্বেগ রয়েছে। সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। তা সত্ত্বেও সবাই অংশগ্রহণ করছেন। আমরা মনে করি, পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে মতভেদগুলো সমাধান হওয়া উচিত। মতভেদকে আমরা খারাপ ভাবে দেখছি না। কিন্তু কোনো বিষয়ে অনমনীয় হয়ে যাওয়াটা যুক্তিযুক্ত নয়। এটা আমাদের ক্ষেত্রেও বলব। কিন্তু কিছু বিষয় রয়েছে সেখানে আমাদের ঐকমত্য হতেই হবে। কিছু মৌলিক বিষয় রয়েছে সেখানে মতবিরোধের কোনো সুযোগ নেই। কিছু রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখছি মৌলিক বিষয় নিয়ে মতভেদ ক্রিয়েট করছেন। সেটা একেবারেই কাম্য ছিল না।
প্রশ্ন: আলোচনার টেবিলে সমাধান হবে এ ব্যাপারে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
সামান্তা শারমিন: আশাবাদী। রাজনৈতিকভাবে আমাদের তো এক ধরনের পূর্বতন ইতিহাসের বোঝা টানতে হয়। এটা একটা বিষয় আছে। সেই সঙ্গে আমরা সম্ভাবনার জায়গাটাও দেখতে চাই। যদি এমন হয় যে, সব রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে একটি নির্বাচনের পথে হাঁটবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভালো কিছু করার জন্য, বাংলাদেশের মানুষকে একটা নিউ স্টার্ট দেওয়ার জন্য এগিয়ে যাবে- এ বিষয়টা যদি দলগুলোর স্বপ্নের মধ্যে থাকে তাহলে অনেক কিছু আমাদের জন্য সহজ হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো মনে করছেন তারা অনেক ক্ষেত্রে নিরাপদ নন রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থার কাছে। আলটিমেটলি জনগণের কাছেই সব নিরাপত্তা। এটা যদি বুঝতে পারি তাহলে সব জায়গার মতবিরোধ দূর করা সহজ হবে।
প্রশ্ন: সরকার ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এনসিপির দলীয় প্রস্তুতি কী হবে?
সামান্তা শারমিন: নির্বাচনের আগে কিছু ধাপ রয়েছে যা সব রাজনীতি দলগুলোকেই পার হতে হয়। যাদের নিবন্ধন হয়ে গেছে তাদের তো অনেক ধাপ পার হয়ে গেছে। নতুন অনেক দল রয়েছে যারা নিবন্ধন নিয়েছে। আমাদের নিবন্ধন এখনো নেওয়া হয়নি। তাই নির্বাচনের আগে আমাদের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ধাপ পার হতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে যে কোনো সময়ে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি।
প্রশ্ন: ভোটের রাজনীতিতে আপনারা কীভাবে এগোবেন? কত আসনে মনোনয়ন দেবেন। জোট করবেন নাকি একক প্রার্থী দেবেন?
সামান্তা শারমিন: মনোনয়নের জায়গাটা নিয়ে আমরা এখনো চিন্তা করি নাই। পুরো সংগঠনের জায়গা থেকে চিন্তা করছি। এখন ৩০০ আসন রয়েছে। তবে এটা বাড়তে পারে বা কমতে পারে। শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশনের কী ধরনের সিদ্ধান্ত হয় সেটা দেখার বিষয়। সব আসনে প্রার্থী দেওয়া সব রাজনৈতিক দলের টার্গেট থাকে। আমাদেরও আছে। সফলতার বিষয়টি সময় বলে দেবে। নির্বাচনের আগে নানা ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাই এ নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
প্রশ্ন: এরই মধ্যে দলকে ও বেশ কয়েক শীর্ষ নেতাকে কিছু বিতর্কের মধ্যে যেতে দেখা গেছে। এসব বিষয় সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
সামান্তা শারমিন: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব নিয়ে অনেক কিছু হয়। দলীয় ফোরামে এসব নিয়ে আমাদের মধ্যে আলাপ হয়। বিষয়গুলো আমাদের নজরে থাকে। সব নিয়ে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন করি। এটা একটা সুস্থ ডেমোক্রেটিক কালচারের অংশ হবে একটি দলের জন্য। এতে একটি দল বা ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারী হওয়ার রাস্তাটা বন্ধ হয়ে যাবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রাজনীতির প্রধান পরিসর হয়ে ওঠা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না। যদিও আমরা দেখেছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে অভ্যুত্থানের সময়। কিন্তু এখন আমাদের দায়িত্বশীল বা আরও প্রজ্ঞাবান রাজনীতির দিকে ঝুঁকতে হবে।
প্রশ্ন: আগামী নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াতের মতো বড় দলগুলোর সঙ্গে এনসিপির নাম জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
সামান্তা শারমিন: এটা খুবই আশা ব্যঞ্জক ঘটনা। নতুন দল হলেও এনসিপিকে গুরুত্ব সহকারে মানুষ নিচ্ছে। এটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল। আমরা সেই দায়টা বোধ করি। আশা করি- আসন্ন নির্বাচনে ভোটের হিসাবে হয়তো অনেক কিছু নতুন করে মেলাতে হবে। রাজনৈতিক অনেক পুরোনো সমীকরণ আছে, অনেকগুলো পক্ষ আছে যারা আগামী নির্বাচনে অনুপস্থিত থাকবে। এতে নতুন সমীকরণ দেখতে পাব এটাই আমরা মনে করছি। এটার প্রভাব নির্বাচনেও পড়বে। আমি মনে করি আগামী নির্বাচনে অনেকগুলো সারপ্রাইজ দেখতে পাব। নিজেরাও সারপ্রাইজড হতে পারি। আশা করি এনসিপি ভালো ফল করবে।
প্রশ্ন: নির্বাচন নিয়ে অনেক ধরনের ফর্মুলার কথা শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে মাইনাস ফর্মুলা নিয়ে। এ নিয়ে আপনাদের দলীয় অবস্থান কী?
সামান্তা শারমিন: এসব গুজব। এ নিয়ে এনসিপির কোনো দলীয় অবস্থান নেই। বিএনপির পক্ষ থেকে এ নিয়ে কথা বলা হয়েছে। তবে বিএনপির মতো বড় দলের এ ধরনের গুজবে কান দেওয়াকে প্রত্যাশা করি না। এরকম কোনো পরিস্থিতি ঘটছে না।
প্রশ্ন: এই মুহূর্তে সরকারের প্রতি আপনাদের পরামর্শ কী?
সামান্তা শারমিন: গত কয়েক মাস ধরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছি। সরকার যদি এ দুটি বিষয়কে সিরিয়াসলি নেয় তাহলে বাকি অনেক বিষয়ে সফলতা অর্জন করবে। পাশাপাশি অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা। তাদের বিচার প্রক্রিয়া ঠিকভাবে হচ্ছে কি না সেটা দেখভাল করা। গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। এসবের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতি চলতে পারে।
প্রশ্ন: গণ অভ্যুত্থান নাকি বিপ্লব- এনসিপির কাছে এই প্রশ্নের উত্তর কী?
সামান্তা শারমিন: আমরা দেখেছি এ প্রশ্নটা বারবার এসেছে। প্রথমত এটাকে থিউরিটিক্যাল বা তাত্ত্বিক প্রশ্ন বলে মনে হয়। মূলত একটা বিপ্লবের আশা নিয়ে সংঘটিত হয়েছে গণ অভ্যুত্থান। গণ অভ্যুত্থান না বলে যদি আরও পার্টিকুলার বলি তাহলে এটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে গণ মানে মানুষের অংশগ্রহণকে। অনেকে এটাকে গণ অভ্যুত্থান বলতে চান কিন্তু বিপ্লব একেবারে বলতে চান না। এটার ইনটেনশন হলো- বিপ্লব বললে এটাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে যায় কি না। দেখেন আমাদের কাছে একজন শহীদের রক্ত, বিশজন শহীদের রক্ত আর লাখ লাখ শহীদের রক্ত এটার কোনো পার্থক্য তৈরি করে না। আমরা মনে করি- এই রক্তের আকাঙ্ক্ষা ছিল বিপ্লব, আমূল সংস্কার, বাংলাদেশটাকে নতুনভাবে সাজানো। এটা ছিল বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সংঘটিত একটি অভ্যুত্থান।
প্রশ্ন: নির্বাচনী রাজনীতিতে জনগণের কাছে আপনারা কী ধরনের বার্তা নিয়ে যাবেন?
সামান্তা শারমিন: রাজনীতির পুরোনো বন্দোবস্ত বাদ দিয়ে জনগণের কাছে নতুন বন্দোবস্তের রূপরেখা তুলে ধরব। এর স্বরূপটা অনেকেই জানতে চাচ্ছেন। ঘোষণাপত্র, আমাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি, নির্বাচনী ইশতেহার সবকিছুতেই এটা স্পষ্ট করা হবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিকভাবে গড়ে তোলা আমাদের লক্ষ্য। বাংলাদেশের মানুষের কাছে আমরা এসব কর্মসূচি নিয়ে যাব।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই বিষয়টা নিয়ে এনসিপির ভাবনাটা কী?
সামান্তা শারমিন: দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে- বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য কোনো ফরেন পলিসি গ্রহণ করা হয়নি। প্রফেসর ইউনূস আন্তর্জাতিকভাবে শক্তিশালী লোক। অভ্যুত্থানের পর থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বার্থ এবং রাজনৈতিক মর্যাদা রক্ষা করে আন্তর্জাতিক মহলে কথা বলছেন। বাংলাদেশকে উপস্থাপন করছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সব সময় অত্যন্ত জটিল এবং রাজনৈতিকভাবে ইনভলভমেন্ট অনেক বেশি। সেই জায়গায় আমরা বলেছিলাম যে শেখ হাসিনাকে অবশ্যই ফিরিয়ে দিয়ে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। তাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত এখানে অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান নিয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। ফরেন পলিসি হিসেবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মর্যাদা রক্ষা করাটা অনেক জরুরি। বাংলাদেশের মর্যাদা নষ্ট করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা কম্প্রোমাইজ করে এমন কোনো ফরেন পলিসি দেখতে চাই না। কোনো কম্প্রোমাইজ দেখতে চাই না।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০২৫
এসআই