২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর রাজনীতির মাঠে বিএনপির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এরপরও নেতৃত্বের চালিকাশক্তি ছিল মূলত ছাত্র সংগঠন ও তাদের সমর্থকদের হাতে।
কিন্তু সম্প্রতি সেনাপ্রধানের বক্তব্য, ইশরাকের মেয়র ইস্যুতে যমুনা ঘেরাও ও ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রদলের কঠোর অবস্থানের পর দৃশ্যপটে রীতিমতো ঝড় বইতে দেখা যায়। এমনকি পদত্যাগের গুঞ্জন ওঠে প্রধান উপদেষ্টার।
এসব ঘটনায় মাঠের পর রাজনীতির চালকের আসনে বিএনপি বসবে, এমনটাই মনে করেছিলেন বিশ্লেষকেরা। কিন্তু শনিবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধিদলের বৈঠকে এমন কয়েকজন ছিলেন, যাদের নিয়েই ছিল বিএনপির ঘোর আপত্তি।
এই বৈঠকে ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। তার পদত্যাগের দাবিতে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন ও তার সমর্থকেরা কয়েকদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপিও দলীয়ভাবে এই দাবি জানিয়েছে। তবে বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে আসিফ মাহমুদকে রেখে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কী বার্তা দিলেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। নির্বাচন, সংস্কার, বিচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন বিএনপি নেতারা। আওয়ামী লীগের বিচারের দাবি জানান তারা। তিন পৃষ্ঠার এক চিঠিতে বিএনপি দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছে।
আদালতের রায়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ পাওয়া ইশরাক হোসেনের শপথ নেওয়ার বিষয়ে সরকার ব্যবস্থা নেবে বলে এতে আশা প্রকাশ করা হয়। শপথ না দিয়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি।
আসিফ মাহমু্দের উপস্থিতিতেই বিএনপি লিখিত বক্তব্যে বলে, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টা যাদের বক্তব্যে এবং কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে– এমন বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি। ’
ছাত্র আন্দোলনে সমন্বয়কদের একজন আসিফ মাহমুদ। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে তিনি উপদেষ্টা পরিষদে জায়গা পান। তার সঙ্গে ছিলেন আরেক সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। পরে নাহিদ পদত্যাগ করে ছাত্র-আন্দোলনকারীদের নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি গঠন করেন। বিএনপির সঙ্গে দলটির টানাপোড়েন রয়েছে। অনেকে মনে করেন, এই দলের সঙ্গে ঘনিষ্টতা রয়েছে আসিফ মাহমুদের।
বৈঠক সূত্র বলছে, শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে দেখেই মন খারাপ করেন। লিখিত চিঠি দেওয়া আর সুনির্দিষ্ট নির্বাচনের রোডম্যাপ চাওয়াই ছিল বৈঠকের মূল বিষয়। কিন্তু সেই বৈঠকে ছিল আন্তরিকতার অভাব। এ কারণে বৈঠক শেষেও সালাহউদ্দিন আহমেদ ছিলেন কিছুটা বিরক্ত ও উত্তেজিত।
বৈঠক শেষে সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুই ছাত্র উপদেষ্টা এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগের বিষয়টি আমরা লিখিতভাবে প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছি। তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে আমরা বলেছি। ’
এ বিষয়ে বিএনপির সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বাংলানিউজকে বলেন, বিএনপিকে পয়েন্ট অব নো রিটার্নে ঠেলে দিচ্ছে ড. ইউনূসের আশেপাশের কিছু উপদেষ্টা ও চক্র। তার বিরুদ্ধে রাজপথে অল আউট আন্দোলনে নামাটা দুর্ভাগ্যজনক হবে। কিন্তু সেটা ছাড়া এরা ক্ষমতা ছাড়বে না, এমন কথাই সালাহউদ্দিন আহমদ বৈঠকের পর ঘনিষ্ঠজনদের বলেন।
এই বৈঠকে অবশ্য সব ছাপিয়ে আসিফ মাহমুদ ও সালাহউদ্দিন আহমদের হাত মেলানোর একটি ছবি সামনে এসেছে। বৈঠকের পরদিন সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। যাতে তিনি সাম্প্রতিক সমালোচনার বিপরীতে বিএনপির এই নেতাকে সমর্থন জানিয়েছেন।
বৈঠক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক মোহাম্মদ রাশেদ আলম ভূঁইয়া বাংলানিউজকে বলেন, গতকালকের বৈঠকের পর সালাহউদ্দিন আহমেদ খুবই উত্তেজিত ছিলেন। সারা দেশের মানুষ টিভিতে এটি দেখেছেন। সিনিয়র নেতাদের সামনে তার কথা-বার্তা অনেকটাই অশোভন ছিল। তিনি হয়তো বৈঠকের ফল নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। এজন্যই এমনটি করেছেন।
তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস বারবার বলেন ছাত্ররা তাকে নিয়োগ দিয়েছে। ছাত্ররা না থাকলে এই সরকারের ভ্যালিড গ্রাউন্ডও থাকে না। তারাই তো গণঅভ্যুত্থানের নেতা। ছাত্রদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসছে, সেগুলো দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু তাদের তো একেবারে বাদ দেওয়া যাবে না।
এই শিক্ষক বলেন, বিএনপিকে এখন এগোতে হবে জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মতো সহনশীল হতে হবে। তা না হলে এমন অবস্থায় সবচেয়ে বেশি সুবিধা নেবে জামায়াত।
রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বেপারি বাংলানিউজকে বলেন, এখন উপদেষ্টাদের পদত্যাগের বিষয়টি সামনে আনা উচিত নয়। কালকের বৈঠক ছিল অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। তার আগে সরকারের বিবৃতিও ছিল অনেক কঠোর এবং উদ্বেগের।
তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস ডিসেম্বরে নির্বাচন দেবেন না। বিএনপিরও এখন এটি বোঝা উচিত। জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যেই যাতে জাতীয় নির্বাচন আদায় করে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে বিএনপির কৌশলী হতে হবে। অধ্যাপক ইউনূস চালাক মানুষ। তার গতকালের বৈঠকও অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেয়। তাকে কেউ ভুল বোঝাবে, তা মনে হয় না। তিনি নিজেই ভালো বোঝেন।
এই বিশ্লেষক বলেন, এখন সবকিছুই অধ্যাপক ইউনূসের নিয়ন্ত্রণে। এখানে তিনি না থাকলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি হবে। ক্ষতি হবে বিএনপিরই। আমেরিকা এতদিন অনেক কিছুই ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশ দেখতো। এখন দেখে সরাসরি বাংলাদেশকে। এ দেশের আশপাশে আমেরিকার স্বার্থ আছে। বাংলাদেশেরও স্বার্থ কীভাবে অক্ষুণ্ণ থাকে, সেসব বিষয় সমন্বয় করে বিএনপির পলিসি ঠিক করা উচিত। সেভাবে কথাও বলা উচিত। ইউনূসের বিরুদ্ধে এখন চীনও কিছু করবে না। বিএনপির আরও ম্যাচিউর হওয়া উচিত।
এমন অবস্থায় বিএনপি কি ডিসেম্বরে নির্বাচন আদায় করে নিতে পারবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে নুরুল আমিন বেপারির কথা হলো, অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে আমেরিকা, ইইউ ও পশ্চিমারা আছে। চীনও অধ্যাপক ইউনূসের ভারত নীতির কারণে সরকারের পাশে থাকবে। তিনি ডিসেম্বরে নির্বাচন দেবেন না, এটি নিশ্চিত করেই বলছি। তবে বিএনপির উচিত হবে অপরাপর দলকে সঙ্গে নিয়ে জুনের মধ্যে যাতে জাতীয় নির্বাচন হয়, সেদিকে সরকারকে ধাবিত করা। সবাইকে সঙ্গে রাখা, কোনো ফাঁদে পা না দেওয়া।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, জানুয়ারি থেকে জুনে জামায়াত, এনসিপিসহ কিছু দল স্থানীয় সরকার, গণপরিষদ নির্বাচন চাইতে পারে। বিএনপির সেজন্য জাতীয় নির্বাচনমুখী সহনশীল ও গণমুখী আচরণ করতে হবে। সরকারকে বিরোধী না বানিয়ে নিজেদের সরকার মনে করতে হবে।
এসএ/এনডি