ঢাকা: টানা ৯ বছর রাষ্ট্রক্ষমতা ও ২ বছর সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল ও আত্মবিশ্বাসের জায়গায় নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে হতাশা।
আর এ রকম নানা সংকটের মধ্য দিয়েই মঙ্গলবার (১ সেপ্টেম্বর) বিএনপি পালন করছে প্রতিষ্ঠার ৩৭ বছর। বাংলাদেশের রাজনীতির বিশেষ এক পট পরিবর্তনে ক্ষমতা বলয়ের মধ্য থেকেই ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
প্রতিষ্ঠার পৌনে ৩ বছরের মাথায় এক সেনা অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলে প্রথম সংকটে পড়ে বিএনপি। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যায় দলটির।
কিন্তু সেনা শাসকের হাত থেকে আরেক সেনাশাসকের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পর দেশের সকল গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ ও যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। ওই আন্দোলনের সফল সমাপ্তিতে ৯ বছরের মাথায় ক্ষমতা ফিরে পায় বিএনপি।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির সেই সময়ের সংকটের সঙ্গে বর্তমান সংকটের চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে। সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে একদিকে যেমন ক্ষমতা ফিরে পায় বিএনপি। অন্যদিকে সেনা ছাউনিতে জন্ম নেওয়া দলটি ‘জন্মবদনাম’ ঘুচানোর সুযোগ পায়।
কিন্তু ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় বসা বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামায়াতকে তোয়াজ করতে গিয়ে নিজেদের জন্য অনিবার্য্য পরিণতি ডেকে এনেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
তারা বলছেন, জামায়াতকে ‘জীবন-মরণ সঙ্গী’ বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের মর্মমূলে কুঠারাঘাত করেছে জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের হাতে গড়া দল বিএনপি। সে কারণেই চলমান সংকট উত্তরণে ভুঁইফোর ও নামসর্বস্ব কিছু রাজনৈতিক দল ছাড়া মূলধারার কোনো রাজনৈতিক দলকে পাশে পাচ্ছে না তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, আমার মনে হয় দেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে যে স্ট্যাটেজিতে বিএনপির চলার কথা ছিল, সেই স্ট্যাটেজিতে তারা নেই। নির্বাচন বর্জন, গণতান্ত্রিক দাবি আদায়ে অগণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করতে পারায় চরম সংকটে পতিত হয়েছে দলটি।
জানা গেছে, শুধু বিশেষজ্ঞ মহল বা রাজনীতি বিশ্লেষকরাই নন, খোদ বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্বও মনে করছে প্রতিষ্ঠার ৩৭ বছরের মাথায় এসে চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে বিএনপি। একের পর এক ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত, দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রের টানাপোড়েন এবং আমলা-ব্যবসায়ী ও নীতিহীন লোকের হাতে নেতৃত্ব চলে যাওয়ায় নৈতিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এটা বলতে আর দ্বিধা নেই, প্রতিষ্ঠার পর এমন সংকটে আগে কখনও পড়েনি বিএনপি। তবে এই সংকট কেবল বিএনপির ভুলের কারণে সৃষ্টি হয়েছে এমনটি নয়। বিএনপির হয়তো কিছুটা ভুল হয়েছে, তার চেয়েও বড় কথা ক্ষমতাসীনরা প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করেনি। এখনও করছে না। বিষয়টি পীড়াদায়ক।
কেউ কেউ বলছেন, পর পর দু’টি ব্যর্থ আন্দোলন শেষে অনেকটা ক্ষয়িঞ্চু শক্তির দলে পরিণত হয়েছে বিএনপি। হঠকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘নাশকতা নির্ভর আন্দোলন’র ধাক্কা সামলে উঠতে না পারায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির মতো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট যৌক্তিক ইস্যুতেও কর্মসূচি দিতে ভয় পাচ্ছে তারা।
জানা গেছে, শুধু সরকার বিরোধী আন্দোলন নয়, দল গোছানোর কাজও ঠিক মতো করতে পারছে না বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে টানা আড়াই বছর আন্দোলনকালে ঢাকা মহানগর বিএনপির নিষ্ক্রিয়তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয় দলটিতে। এ কারণে ২০১৪ সালের ১৮ জুলাই সাদেক হোসেন খোকা ও আব্দুস সালামকে সরিয়ে মির্জা আব্বাস ও হাবিবুন নবী খান সোহেলকে মহানগর বিএনপির দায়িত্ব দেওয়া হয়। নির্দেশ দেওয়া হয় ২ মাসের মধ্যে ওয়ার্ড ও থানায় সম্মেলন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার।
কিন্তু গত ১৩ মাসেও ঢাকা মহানগর বিএনপিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেনি মির্জা আব্বাস ও হাবিব নবী খান সোহেল’র নেতৃত্বাধীন আহ্বায়ক কমিটি। গত ৬ জানুয়ারি থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৯২ দিনের অবরোধ কর্মসূচিতেও কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি ঢাকা মহানগর বিএনপি। বরং গ্রেফতার এড়াতে মির্জা আব্বাস ও হাবীব উন নবী খান সোহেল শুরু থেকেই রয়েছেন আত্মগোপনে। খালেদা জিয়ার অনুষ্ঠানে মাঝে মধ্যে হাবীন উন নবী খান সোহেলকে দেখা গেলেও, মির্জা আব্বাসের কোনো দেখা মিলছে না।
এদিকে অগোছালো কেন্দ্রীয় বিএনপিকে ঠিক না করে অপেক্ষাকৃত সংগঠিত ও সক্রিয় তৃণমূল বিএনপি পুনর্গঠনের জন্য গত ১০ আগস্ট চিঠি দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমিটি পুনর্গঠন করে কেন্দ্রে পাঠাতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই চিঠি পাওয়ার পর নতুন করে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে তৃনমূল বিএনপিতে। তৃনমূল থেকে বলা হচ্ছে, মাত্র ৫০দিন সময় বেঁধে দিয়ে কমিটি পুনর্গঠনের যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেটি বাস্তব সম্মত হয়নি। মামলা মোকদ্দমায় জর্জরিত তৃণমূল বিএনপির পক্ষে এত কম সময়ে কমিটি পুনর্গঠন মোটেই সম্ভব না।
এ প্রসঙ্গে পাবনা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার সুলতান মাহমুদ ও নাটোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আমিনুল হক বাংলানিউজকে বলেন, বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কোনো অবস্থাতেই কমিটি পুনর্গঠন সম্ভব না। নিয়ম মেনে কমিটি করতে গেলে আরও অন্তত ৫০ দিন সময় দিতে হবে তৃণমূলকে।
ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মির্জা ফয়সাল বাংলানিউজকে বলেন, তৃণমূল নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে। কেন্দ্র ঠিক হলেই বিএনপি ঠিক হয়ে যাবে।
এদিকে নানা সমস্যায় জর্জরিত বিএনপি বার বার চেষ্টা করেও জাতীয় কাউন্সিল করতে পারছে না। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর জাতীয় কাউন্সিল করেছিল তারা। এরপর ২০১৩ ও ২০১৪ সালের বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও করতে পারেনি জাতীয় কাউন্সিল। স্থায়ী কমিটির বৈঠকও হচ্ছে না নিয়মিত। সর্বশেষ ২০১২ সালের ৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা।
এমন পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার আরেকটি প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করবে বিএনপি। এ উলক্ষে এদিন সকাল সাড়ে ১০টায় দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা। বিকেল ৩টায় রাজধানীর ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল জিয়াউর রহমান তার শাসনকে বেসামরিক করার উদ্দেশ্যে ১৯ দফা কর্মসূচি শুরু করেন এবং রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের জন্য জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার।
পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ১৯৭৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন জিয়াউর রহমান। পরে জাগদল বিএনপির সঙ্গে একীভূত হয়। জিয়াউর রহমান এই দলের প্রথম চেয়ারম্যান হন। অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী হন প্রথম মহাসচিব।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাবস্থায় ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বিএনপি ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয় লাভ করে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জয় লাভ করে।
ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র দুই বছরের মাথায় জিয়াউর রহমান সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হলে তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি হন। পরে ১৯৮৩ সালে সাত্তারকে সরিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি হন।
এরপর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিএনপি সর্বাধিক আসনে জয় লাভ করায় সরকার গঠনের সুযোগ পায়।
২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় ঐক্যজোট ফের সরকার গঠন করে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবি হয় বিএনপির। এ নির্বাচনে মাত্র ২৯টি আসন পায় তারা।
সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে এই মুহূর্তে ক্ষমতা ও সংসদের বাইরে অবস্থান করছে বিএনপি।
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৫
এজেড/এটি