ঢাকা: সর্বোচ্চ সাজার রায় কার্যকর হয়েছে, স্বাধীন বাংলা থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন দুই চরম স্বাধীনতাবিরোধী। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও মিথ্যাচারের মাধ্যমে বিতর্ক তৈরি করে রেখে গেছেন তারা।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকরের পর তাদের প্রাণভিক্ষা চাওয়া নিয়ে পরিবারের সদস্য এবং বিএনপি-জামায়াতের অবস্থান নিয়ে এমন অভিযোগ উঠেছে।
দু’জনকে একই ফাঁসির মঞ্চে পাশাপাশি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে শনিবার (২১ নভেম্বর) দিবাগত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের প্রাণভিক্ষা চাওয়া নিয়ে বিতর্ক গত চারদিনেও জিইয়ে রেখেছেন দু’জনের পরিবারের সদস্যরা। যার যার দলও এ থেকে রাজনৈতিক ফাঁয়দা নিতে চাচ্ছে বলেও অভিযোগ করছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, মৃত্যুক্ষণেও অসাধু রাজনীতি করে গেছেন দু’জন। প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন, কিন্তু শেষ সাক্ষাতে পরিবারের কাছে অস্বীকার করে তারপর ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন। আর তাদের দলও সেটি নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের মতানুসারীদের রাজনীতিতে ধরে রাখতেই এ কৌশল।
সরকার ও রাষ্ট্রপক্ষের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরী তাদের একাত্তরের অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন বলে নিশ্চিত করা হলেও বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করা হচ্ছে কেবলমাত্র রাজনীতি ধরে রাখার কৌশল হিসেবে- এ অভিযোগও উঠছে।
ফাঁসি কার্যকরের দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুজাহিদ ও সাকার সঙ্গে দেখা করে ঢাকা জেলা প্রশাসনের দুই ম্যাজিস্ট্রেট তৃতীয়বারের মতো জানতে চান, তারা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ও প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না। কয়েক ঘণ্টার আলোচনা শেষে দুপুরে লিখিতভাবে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানান তারা। দণ্ডিতদের আবেদনপত্র দু’টি স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় হয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে পৌঁছে দেওয়াসহ নিয়মমাফিক ধারাবাহিক সব প্রক্রিয়া চালান রাষ্ট্রপক্ষ। সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচের কাগজপত্র বঙ্গভবন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে কারাগারে পৌঁছালে শুরু হয় ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি।
কিন্তু বিকেল থেকেই মুজাহিদ ও সাকার পরিবারের সদস্যরা প্রাণভিক্ষার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বিষয়টিকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা চালাতে থাকেন। রাতে শেষ দেখা করে এসে তারা জোর দিয়ে বলতে থাকেন, মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরী ক্ষমা বা প্রাণভিক্ষা চাননি। এর মধ্যেই পরিবারের সদস্যদের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবৃতির মাধ্যমে জামায়াত ও বিএনপিও একই ধরনের দাবি করে বসে।
এরপর থেকেই মুজাহিদ-সাকা জীবনসায়াহ্নে এসে অহঙ্কার ভেঙে প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন, নাকি চাননি, রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া আবেদনে কী লেখা ছিল? দোষ স্বীকার করলেন কি-না?- এসব নিয়ে বিতর্ক জিইয়ে রাখার চেষ্টা চলছে।
সাকা চৌধুরীর মরদেহ রাউজানে দাফন শেষে রোববার (২২ নভেম্বর) তার ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন সংবাদ সম্মেলনে।
শেষ সাক্ষাতে প্রাণভিক্ষার বিষয়টি জানতে চেয়েছিলেন বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন হুম্মাম। জবাবে সাকা নাকি তাকে বলেছেন, ‘৬ ফুট ২ ইঞ্চি তোমার বাবা, কারও কাছে মাথা নত করে না’।
সাকার ছোট ভাই জামালউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, তিনি (সাকা) বলেছেন- ‘যদি মার্সি (ক্ষমা) চাই, মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে চাইবো, কোনো বান্দার কাছে নয়’।
কিন্তু গণমাধ্যম বলছে, রাষ্ট্রপতির কাছে হুম্মাম নিজেও আরজি নিয়ে গিয়েছিলেন।
এদিকে মুজাহিদের প্রাণভিক্ষার বিষয়টি ‘অসত্য’ বলে দাবি তোলে তার দল জামায়াত।
দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান শনিবার রাতে বিবৃতিতে বলেন, ‘বিভিন্ন গণমাধ্যমে কারা অধিদফতরের বরাত দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে যে, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন। প্রচারিত এ খবরটি সম্পূর্ণ অসত্য ও বিভ্রান্তিকর’।
মুজাহিদের স্ত্রী তামান্না-ই-জাহান রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ দায়িত্বশীলদের কাছে ‘ন্যায়বিচার’ প্রত্যাশা করে বক্তব্য দিয়েছেন ফাঁসির আগে।
শনিবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি তার অন্য চাওয়া জানান, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে আরজি জানাই, তার (মুজাহিদ) বিরুদ্ধে একটা মামলা বিচারাধীন। সেটি শেষ হওয়া পর্যন্ত যেন আইনি লড়াইয়ের অধিকার দেওয়া হয়’।
কারাগারে দেখা করে এসে মুজাহিদের ছেলে আলী আহম্মেদ মাবরুর দাবি করেন, তারা বাবা চিঠি একটি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতিকে। তবে তা বিচার ব্যবস্থার অসঙ্গতি নিয়ে, ক্ষমা চেয়ে নয়।
সাংবাদিকদের কাছে তিনি দাবি করেন, কারা কর্তৃপক্ষের চাপের মুখে তার বাবা চিঠি একটি লিখেছিলেন। তবে সেটা কোনো আবেদন নয় এবং কোনো ক্ষমা প্রার্থনাও তিনি করেননি। আমার বাবাকেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছেন, ‘আমি এই বিচারের অসঙ্গতিগুলো এবং আমার ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকারগুলোর যে যে ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হয়েছে, সেসব বিষয়গুলো নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে একটা চিঠি দিয়েছি’।
‘বাবা বলেছেন, আমার কোনো প্রয়োজন নেই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার এবং আমি সেটা করিনি’- দাবি আলী আহম্মেদ মাবরুরের।
আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী প্রাণভিক্ষার বিষয়টি একযোগে নিশ্চিত করে আসছেন প্রথম থেকেই।
তারা বলেন, দণ্ডিতরা প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন আইন মোতাবেক। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে তারা ক্ষমা চেয়েছেন।
মন্ত্রীরা দণ্ডিতদের চিঠির বিবরণও দেন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সরাসরি বলেন, দেশ-বিদেশের মদতদাতাদের মদদে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে প্রাণভিক্ষা নিয়ে মিথ্যাচার চালাচ্ছেন দণ্ডিত পক্ষ।
‘আইনমাফিক সালাউদ্দিন-মুজাহিদ দরখাস্ত করেছেন রাষ্ট্রপতি কাছে। ক্ষমা না চাইলেও রায় কার্যকর করতে পারতাম, ক্ষমা চাইলেও পারতাম। সুতরাং এটাকে ইস্যু বানাতে চেয়ে লাভ নাই। তারা এখন কী বলছেন, সেটিতে কিছু যায় আসে না’- বলেন তিনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানান, সকালে প্রথম আবেদনটি করেন মুজাহিদ। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রাণভিক্ষা চান তিনি। এরপর সালাউদ্দিন ইংরেজিতে লেখা চিঠিতে ৪৯ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন।
প্রশ্ন মন্ত্রীর, ‘আবেদন আমরা রাষ্ট্রপতিকে পৌঁছেছি। ক্ষমা না চাইলে আমরা এসব কেন করবো’?
দুই পরিবারের অস্বীকারের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পরিবারের হয়তো এ বিষয়ে ‘নলেজ’র অভাব ছিল। নিয়ম অনুসারে দণ্ডিতরা আমাদের মাধ্যমে ক্ষমা চেয়েছেন। সেটি পরিবারের নাও জানা থাকতে পারে।
‘শাস্তি মওকুফের সব চেষ্টা-কৌশলই তারা করেছিলেন’- বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
শুধু যে প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন সালাউদ্দিন ও মুজাহিদ, তাই নয়- প্রকারান্তরে তারা আদালতের রায়ের যৌক্তকতা মেনে নিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
তিনি বলেন, যে যেভাবেই বলুন না কেন, চিঠিতে যাই লেখা থাকুক না কেন, আসামিরা ক্ষমা চেয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষসহ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বিএনপি-জামায়াত ও দুই যুদ্ধাপরাধীর পরিবারের ‘মিথ্যাচার’ ও বিভ্রান্তি তৈরির অপচেষ্টাকে নিজেদের রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখার কৌশল হিসেবেই দেখছেন।
তারা বলছেন, রাষ্ট্রপক্ষের অসত্য বলার তেমন কারণ নেই। ফাঁসি কার্যকরে কোনো বাধা যেহেতু নেই, তাহলে কেন মিথ্যা বলবেন তারা? তাই কৌশলটুকু সাকা-মুজাহিদপক্ষই নিয়েছেন বলে হিসেবে-নিকেশে বের করছেন তারা।
কেউ কেউ বলছেন, ‘মৃত্যুক্ষণেও অসাধু রাজনীতি করে গেছেন দু’জন। প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন, পরিবার ও দল সেটি অস্বীকার করছে। তাদের মতানুসারীদের রাজনীতিতে ধরে রাখতে এ কৌশল’।
কেউ কেউ বলছেন, ‘প্রাণভিক্ষা পেলে দ্বিতীয় জন্ম হতো তাদের, যেটি হতো তাদের জন্য বোনাস লাইফ। তাই আবেদন জানিয়ে রেখেছিলেন বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে। আবেদন নাকচ হওয়ার সম্ভাবনা কতোটা প্রবল সেটিও জানতেন তারা। তাই পরে বিষয়টি বেমালুম অস্বীকার করে গেছেন পরিবারের কাছে, এটিই পরে চলে গেছে যার যার দলের কাছে’।
অতি উৎসাহী কেউ আবার চিঠিগুলো দেখতে চেয়েছেন, উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছেন।
কিন্তু আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন, এসব আবেদনপত্র গোপনীয়। রাষ্ট্রপতির অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা যাবে না।
আইনমন্ত্রী সুস্পষ্টভাবে এটিও জানিয়ে দিলেন, তারা কী দাবি করলেন, তাতে কিছু যায় আসে না। গোপন চিঠি প্রকাশে রাষ্ট্র বাধ্য নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
এসকেএস/এএসআর