ঢাকা: বিদ্যুতের উৎপাদন ও লোডশেডিং নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সারাদেশে যখন ভয়াবহ লোডশেডিং চলছে সেখানে পিডিবি’র হিসাবে মাত্র ৯ শতাংশ লোডশেডিং দেখানো হয়েছে গত শনি ও রোববার।
পিডিবি’র এ হিসাবকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা ‘মনগড়া’ বলে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তা উড়িয়ে দেওয়া হতো। এবার সরকারের খোদ দ্বিতীয় ব্যক্তি, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্বীকার করে নিয়েছেন বিদ্যুৎ নিয়ে দেওয়া তথ্য বিভ্রান্তিকর।
বিভ্রান্তির মাত্রা কতটুকু তা জানতে বাংলানিউজের অনুসন্ধান চলে।
রোববারের হিসেবটিই দেখুন। এই দিন পিডিবি’র হিসেবে সারা দেশে আট থেকে দশ শতাংশ লোডশেডিং হয়েছে বলে দেখানো হয়। অথচ ওই দিন কেবল পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডেরই (আরইবি) লোডশেডিং ছিলো এক হাজার মেগাওয়াট। যা সারাদেশের মোট চাহিদার ২০ শতাংশ ও আরইবি’র চাহিদার প্রায় ৩৫ শতাংশ।
আরইবি কি তার লোডশেডিংয়ের হিসেব সঠিক দেয়? সে প্রশ্ন রাখা হয়েছিলো আরইবি’র সদস্য (প্রকৌশল) নাজমুল হোসেন চৌধুরীকে। তিনি জানালেন, শনিবার রাত ৭ টায় ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ পেয়েছেন ১ হাজার ৮৩৩ মেগাওয়াট।
এক প্রশ্নের জবাবে নাজমুল হোসেন চৌধুরী বলেন, আরইবিকে ১ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং দেওয়া হয়। তবে শনি ও রোববার লোডশেডিং কম ছিল। সারাদেশে কম বেশি বৃষ্টি হওয়ায় চাহিদা কম ছিল।
এমন একটি কম চাহিদার দিনেও মেহেরপুরসহ দেশের একাধিক জেলায় ওই দিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং করে আরইবি।
মজার বিষয় হচ্ছে- আরইবি’র এই কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যকেও ‘মনগড়া’ বলে মন্তব্য করেছেন অন্য অনেকেই।
বাংলানিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় সর্বাধিক লোড শেডিংয়ের শিকার মেহেরপুরে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি মেহেরপুরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, ‘খুবই খারাপ আবস্থা চলছে। এর আগে কখনও এমন লোডশেডিং হয়নি। চুয়াডাঙ্গায় রোববার দিনে ১৮ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ পাওয়া গেছে মাত্র তিন মেগাওয়াট। একই সময়ে মেহেরপুরে ২০ মেগাওয়াট’র বিপরীতে পাওয়া গেছে মাত্র পাঁচ মেগাওয়াট। ’
এই কর্মকর্তার তথ্য মেনে নিলে বোঝা যাবে মেহেরপুরের মানুষ চাহিদার চার ভাগের এক ভাগ বিদ্যুৎ পেলেও চুয়াডাঙ্গার মানুষ পেয়েছে চাহিদার ছয় ভাগের এক ভাগ বিদ্যুৎ।
ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) জানিয়েছে, গত রোববার তাদের প্রায় ৪৮ শতাংশ লোডশেডিং দেওয়া হয়। এদিন বিকেল সাড়ে তিনটায় তাদের মোট চাহিদা ছিল ৫৮১ মেগাওয়াট। সে সময়ে তাদের সরবরাহ করা হয় মাত্র ৩০১ মেগাওয়াট। যে কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং দিতে হয়েছে।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) জানিয়েছে, রোববার তাদের ১ হাজার ২৫ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে (দুপুরে) মাত্র ৭৭১ মেগাওয়াট।
এদিকে, রোববার বিদ্যুতের হিসাব নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য দেওয়ার পর পিডিবি’র ওয়েব সাইট থেকে লোডশেডিং সংক্রান্ত সকল তথ্য মুছে ফেলা হয়। অন্যান্য তথ্য দেখা গেলেও লোডশেডিং সংক্রান্ত তথ্য ফেইলিওর দেখাতে থাকে। এমনকি পিডিবি’র নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তথ্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) কার্যালয়ে ১৯ মার্চ পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর গণশুনানিতে অংশ নিয়ে পিডিবি চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবির বলেছিলেন, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের মোট ঘাটতি এক হাজার ৮০০ মেগাওয়াট । অথচ পিডিবির ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছিলো, ওই দিন দেশে মাত্র ৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎঘাটতি ছিল।
বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘প্রকৃত সত্য এর চেয়েও কঠিন।
তারা বলেন, আমরা বুঝি না কেন এই বিষয়টি গোপন করে রাখা হয়। কেন বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়।
গোপন করে যদি জনগণের কোনো লাভ হতো তাহলে কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু এতে করে মানুষ হতাশ হয়। প্রশাসনের প্রতি আস্থা হারায়-- মন্তব্য তাদের।
পিডিবি প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা গেছে, বোরো মৌসুমে পিক আওয়ারে লোডশেডিং থাকবে প্রায় ১ হাজার ২১৭ মেগাওয়াট। সেচ মৌসুমে (জানুয়ারি-এপ্রিল) দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ১৫২ মেগাওয়াট। যার বিপরীতে ওই সময়ে উৎপাদন হবে ৫ হাজার ৯৪৫ মেগাওয়াট। কিন্তু কোন দিনই এ হিসাব অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি পিডিবি।
কনজ্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ`র (ক্যাব) উপদেষ্টা সামছুল আলম বলেন, ``অর্থমন্ত্রী অনেক কথা না বুঝেই বলেন। তাই তার সঙ্গে একমত বা দ্বিমত হওয়ার কিছু নেই। তবে আন্দাজে বললেও এই কথাটি অনেকটাই সঠিক। ``
আরইবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, পিডিবির লোডশেডিংয়ের তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় না। বেশির ক্ষেত্রেই প্রকৃত চাহিদা আড়াল করা হয়।
অনেক চেষ্টা করেও পিডিবি’র চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার সেল ফোনে একাধিক বার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১২
ইএস/
মাহমুদ মেনন, কনসালট্যান্ট এডিটর;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।