ঢাকা: ভারত থেকে আসা কম দহনক্ষমতাসম্পন্ন ও বিষাক্ত সালফারযুক্ত কয়লার দখলে চলে গেছে দেশের বাজার। পরিবেশ আইনে বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
পরিবেশ আইনে কয়লায় ক্ষতিকারক সালফারের পরিমান নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। পরে অবশ্য বিশেষ বিবেচনায় তা ১ শতাংশে উন্নীত করা হয়।
পরিবেশবিদরা বলছেন, কয়লায় সালফারের পরিমান শূন্য দশমিক ২ শতাংশ হলে আন্তর্জাতিক মানের ধরা হয়।
কিন্তু কয়লা আমদানিকারকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে বছর বছর সালফারের পরিমাণ শিথিল করা হচ্ছে।
আর এ সুযোগে বাড়তি মুনাফার জন্য ৩ থেকে ৫ ভাগ সালফারযুক্ত বিষাক্ত কয়লা আনছে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা। আমদানি করা কয়লা পরীক্ষারও কোনো ব্যবস্থা নেই। ভারতের রফতানিকারকরা এনভয়েসের সঙ্গে যে সার্টিফিকেট দিচ্ছে তারই ওপর নির্ভর করা হচ্ছে।
তবে ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো নিরুৎসাহিত করার জন্য গেজেট প্রকাশ করে সালফারের মাত্রা শিথিল করা হয়েছে বলে জানান সিলেট কয়লা আমাদনীকারক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক চন্দন সাহা।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “কাঠ পোড়ানো হলে পরিবেশের ক্ষতি হয়, তাই ইটভাটায় কয়লা ব্যবহারে সালফারের বিষয়টি শিথিল করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। ”
আর ইটভাটায় এখন যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তাতে সালফারের মাত্রা বেশি থাকলেও পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না বলে দাবি করেন চন্দন সাহা।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সালফার মৌল বা যৌগ পুড়ে উৎপাদিত সালফার-ডাই-অক্সাইড গ্যাস স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
ভারত থেকে আমদানি করা কয়লায় বেশি মাত্রায় সালফার উপস্থিতির কথা জেনেও অনেকে তা কিনছেন।
এর কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেছে, অনেকে এর ক্ষতিকর দিকটি জানেন না। তবে সবচেয়ে বড় কারণ, দেশীয় কয়লার চেয়ে সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে বলে এসব কয়লা কিনছেন ক্রেতারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কয়লা আমদানিকারক বাংলানউজকে জানিয়েছেন, সরকার প্রতি টন কয়লার দর ৬২ ডলার নির্ধারণ করলেও সে দামে কয়লা পাওয়া যায় না। বতর্মানে প্রতি টন ১১০ থেকে ১১৫ ডলারে কিনতে হচ্ছে।
সরকারি নিয়মে ফাঁকি দিতে কয়লা আমদানিতে ব্যাংকের মাধ্যমে টন প্রতি নির্ধারিত ৬২ ডলারই যাচ্ছে। আর বাকি অর্থ যাচ্ছে কালো বাজারের মাধ্যমে।
অন্যদিকে, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে কয়লার দর প্রায় ১৩০ ডলার। ভারতীয় কয়লার সঙ্গে প্রতি টনে দামের ব্যবধান ১৫ ডলার। সুতরাং কম দামের দিকেই ঝুঁকছে ব্যবসায়ীরা। এতে মানের বিচার না করে নিজের অজান্তেই ক্ষতির শিকার হচ্ছেন ক্রেতারা।
বকুল মিয়া নামের এক কয়লা আমদানিকারক জানান, “ক্রেতারা ক্ষতিকর সালফারের উপস্থিতি বা দহনক্ষমতা বিচার করে না। আর আমরা এতোকিছু জানিও না। ”
সিলেট কয়লা আমাদনীকারক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক চন্দন সাহার দাবি, ভারত থেকে কয়লা আমদানি করার সময় এনভয়েসের সঙ্গে সালফারের সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।
তিনি জানান, গত বছর ভারত থেকে ১৮ লাখ মেট্রিক টন কয়লা আমদানি করা হয়েছে। তবে এ কয়লার দহনক্ষমতার ব্যাপারে তার কোনো ধারণা নেই বলে স্বীকার করেন তিনি।
অপরদিকে সরকারি হিসাবে, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ি, জয়পুর হাটের দীঘিপাড়া, রংপুরের খালাশপীর এবং বগুড়ার কুচমায়সহ পাঁচটি কয়লা খনিতে প্রমাণিত মজুদ রয়েছে প্রায় ২৪ হাজার ৫শ লাখ টন উন্নত মানের কয়লা। যা দেশের বর্তমান মোট চাহিদার হিসাবে ৮১৬ বছরের চাহিদা মিটবে। এ কয়লায় সালফারের উপস্থিতি এক শতাংশেরও কম।
শুধু বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে বছরে ৮ লাখ টন কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। অপর চারটি খনি এখনো নানা বাধার কারণে উত্তোলনে যেতে পারছে না।
ভারত থেকে আসা নিম্নমানের কয়লার দহনক্ষমতা মাত্র ৭ থেকে ৮ হাজার বিটিইউ (ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট)। এ কয়লা কিনে নিজের অজান্তেই প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা।
অন্যদিকে, দেশীয় কয়লার দহনক্ষমতা প্রায় সাড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার বিটিইউ। কয়লাখনি বিশেষজ্ঞদের কাছে সুইট কয়লা নামে পরিচিত এ কয়লা বিশ্বের খুব কম দেশেই রয়েছে।
দেশে উন্নতমানের এতো বিপুল পরিমান কয়লা থাকা সত্বেও শুধু উত্তোলনের অভাবে চাহিদা মেটাতে আমদানি করতে হচ্ছে। এতে করে নিম্নমানের এমনকি ক্ষতিকর পদার্থযুক্ত কয়লাও দেশে আসছে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বার্ষিক কয়লার চাহিদা প্রায় ৩০ লাখ টন। কয়লা উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৮ লাখ টন। অবশিষ্ট ২২ লাখ টনের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে আমদানি করে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খসড়া কয়লানীতি রিভিউ কমিটির সদস্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, “আমাদের দেশে মূলত ইটভাটায় বেশি কয়লা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ক্ষতিকারক সালফারের বিষয়ে আইন থাকলেও প্রয়োগ না থাকায় দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। ”
পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক মকবুল ই-এলাহী বাংলানিউজকে বলেন, “আমাদের দেশের কয়লাকে কালোমানিক বললে সঠিক মূল্যায়ন হতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই কালোমানিক ফেলে রেখে আনা হচ্ছে বিষাক্ত কয়লা। ” এতে দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মকবুল-ই-ইলাহী আরো বলেন, “একই পরিমাণ ইট পুড়তে বাংলাদেশি কয়লা পরিমাণে অনেক কম লাগে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বুঝতে না পেরে ভারতীয় কয়লা ব্যবহার করে নিজের অজান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ”
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ কয়লা উত্তোলনে বেশি দূর এগোতে পারেনি বলে খেদ প্রকাশ করেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কীত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া বাংলানিউজকে বলেন, “আমাদের দেশের কয়লা বিশ্বের মধ্যে উন্নত মানের। এ কয়লা ফেলে রেখে বিষাক্ত কয়লা আমদানি করে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। ”
জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য কয়লা উত্তোলনের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১২
ইএস/সম্পাদনা: জাহাঙ্গীর আলম, নিউজরুম এডিটর; আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর