ঢাকা, শনিবার, ৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ জুন ২০২৪, ১৪ জিলহজ ১৪৪৫

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

দ্বিতীয় পর্ব

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র: ‘গ্রিন বেল্ট’-এ পাখির কলরব, খালে দাপাচ্ছে ডলফিন

রেজাউল করিম রাজা, রামপাল (বাগেরহাট) থেকে ফিরে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৩ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২৪
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র: ‘গ্রিন বেল্ট’-এ পাখির কলরব, খালে দাপাচ্ছে ডলফিন

বাগেরহাটের রামপাল এলাকায় ১৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রকল্পের পাশেই মইদারা খালে গিয়ে দেখা মেলে অসংখ্য ডলফিনের। খালের জলে রামপাল প্রকল্পের উদ্যোগে পুরো প্রকল্প এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে সবুজের বেষ্টনী বা গ্রিন বেল্ট।

আর গ্রিন বেল্টের সবুজ বনে আকৃষ্ট হয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় উড়ে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির দল। এর মধ্যে আছে নানা ধরনের অতিথি পাখি। বিকেল হলে মইদারা খালে ভেসে উঠে ডলফিনের দল। তারা আপন মনে খেলায় মেতে ওঠে। সুন্দরবনের প্রান্ত সীমানা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে যখন এ প্রকল্পটি গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল তখন পরিবেশবাদীরা বনের পশুপাখির ক্ষতি হবে এমন আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু কোন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশেই ডলফিনের মতো প্রাণীর এমন দাপাদাপি আর হরেক রকম পাখির কিচিরমিচিরই বলে দিচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশবান্ধব উদ্যোগে বনের পশুপাখিরা ভালো আছে।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্রিন বেল্টটি ১৩৫ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হচ্ছে। বিভিন্ন পাখির মধ্যে প্রকল্পের আশেপাশে স্থানীয় পাখি ছাড়াও আছে অতিথি পাখির আনাগোনা। মাছরাঙা, ঘুঘু, কাঠঠোকরা, কোকিল এবং বিভিন্ন ধরনের অতিথির পাখির বিচরণ রয়েছে। গ্রিন বেল্টের কারণে প্রকল্প এলাকাতেই আরেকটি বন গজিয়ে উঠছে। বিভিন্ন গাছের মধ্যে ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূল জাতীয় গাছ ছাড়াও আম, নারকেল, কাঁঠাল, আসোকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হচ্ছে। গ্রিন বেল্টটি এখন প্রকল্পের আশেপাশের পাখি ও উদ্ভিদ প্রজাতির বেড়ে উঠা ও বসবাসের আবাসস্থলে পরিণত হচ্ছে।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) এমডি সঙ্গীতা কৌশিক বলেন, প্রকল্পের প্রথম দিন থেকেই পরিবেশ কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ইউনেস্কোর একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান সুন্দরবনের পাশে প্রকল্পের অবস্থান বলে, এলাকার পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে আমরা খুবই সচেতন। মৈত্রী প্লান্টে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে যা ফ্লু-গ্যাস ডি-সালফারাইজেশন এবং ইএসপির মাধ্যমে ধোঁয়া নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করে। প্রবাহিত গ্যাসে সালফার নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করে। ফ্লু-গ্যাসের জন্য কোনো বাইপাস নেই। ফ্লু গ্যাস ডি-সালফারাইজেশন ছাড়া প্লান্ট কাজ করবে না।

তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় প্রকল্পের শুরু থেকেই আমরা কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে পরিবেশগত বিষয়টি মাথায় রেখেছি। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বনায়ন কর্মসূচির অধীনে স্থানীয় এক লাখ ১৬ হাজারের বেশি চারা রোপণ করা হয়েছে। আমরা পাঁচ লাখ গাছ লাগাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রকল্পের টেকসই অবকাঠামোর কারণে সাম্প্রতিক রিমাল ঘূর্ণিঝড় প্লান্টে কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। মৈত্রী টাউনশিপে আমাদের একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রও রয়েছে যেখানে নিকট এলাকা থেকে গ্রামবাসীরা এসেছিল। আমরা গ্রামবাসীদের খাবার এবং অন্যান্য রসদ সরবরাহ করেছি।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রর পিডি শান্তনু কুমার মিশ্র বলেন, আমরা এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্রিন বেল্টে পাঁচ লাখ ম্যানগ্রোভ ও স্থানীয় প্রজাতির গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেছি। এরই মধ্যে আমরা দেড় লাখ গাছ লাগিয়েছি। এরপরে আরও দেড় লাখ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি গাছগুলোও লাগানো হবে। এ গ্রিন বেল্টটি বনের পাখিদের জন্য বাসস্থান হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া বনের অন্য পশুদের জন্য এটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এমনটি এ গ্রিন বেল্ট বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে বন ও পরিবেশকে রক্ষা করবে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি এ কেন্দ্রের গ্রিন বেল্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দেশের উপকূলকে রক্ষা করবে।

তিনি বলেন, এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে যা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের জন্য বিশ্বে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকরী একটি প্রযুক্তি। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ফ্লু-গ্যাস ডিসালফারাইজেশন (এফজিডি) প্রযুক্তি ব্যবহার করছে যা কেন্দ্রে সালফার দূষণরোধ করছে। এছাড়া এখানে আছে লো নক্স বয়লার। এতে কেন্দ্রে নাইট্রাস অক্সাইড এর মাত্রা কম থাকে। এটি একটি জিরো ডিসচার্জ প্লান্ট। রামপালের মতো দেশের অন্য কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে পাঁচ লাখ বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নেয়নি। এ উদ্যোগটি একে দেশের অন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্টাল মনিটরিং চলমান আছে। এটি প্রকল্পের শুরু থেকেই ছিল। তাদের নিজস্ব স্বাধীন কমিটি বিষয়টি নজরদারি করছে এবং তারা এ রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও পাঠাচ্ছেন আর সেই রিপোর্টে এটি নিশ্চিত করা হয়েছে যে এ প্রকল্পের ফলে সুন্দরবন ও তার আশেপাশে ইকোলজিক্যাল ক্ষতি হচ্ছে না। বরং প্রকল্পের চারপাশে গ্রিন বেল্ট গড়ে তুলে আমরা একে একটি পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরিণত করছি।

রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প বা মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরুর সময় থেকেই গ্রিন বেল্ট এর উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় থেকেই গাছ লাগানো শুরু হয়। বর্তমানে সেই গাছগুলো বড় হয়ে গভীর বনে পরিণত হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় যখন কাজ শুরু হয় তখন এ জমিতে কিছুই ছিল না। এ পুরো এলাকায় মোট পাঁচ লাখ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এখন যে বনায়ন হচ্ছে বা গাছ লাগানো হচ্ছে তা প্রকল্প এলাকার আশেপাশেই লাগানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত বন বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে এক লাখ গাছ লাগানো হয়েছে। আরও এক লাখ গাছ বন বিভাগের সঙ্গে লাগানোর কাজ প্রক্রিয়াধীন। খুব দ্রুত এ সংক্রান্ত চুক্তি সই হলে কাজ শুরু হয়ে যাবে। এ গ্রিন বেল্টে শ্বাসমূল জাতীয় গাছ, নারকেলসহ বন বিভাগ এ এলাকার জন্য যে ধরনের গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে সেই গাছগুলোই রোপণ করা হচ্ছে। গ্রিন বেল্টে লাগানো রোপণকৃত এক লাখ গাছের মধ্যে ৮৭ হাজার গাছ এখন বেঁচে আছে।

প্রকল্পের কর্মকর্তারা আরও বলেন, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশ কার্বন পজিটিভ রাখার জন্য এ গ্রিন বেল্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চারপাশে প্রকল্প এলাকা তথা গ্রিন বেল্টে আরও বেশি পরিমাণে গাছ লাগানো হচ্ছে।

পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে এখানে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে কয়লার যে শেড সেটি সম্পূর্ণ ঢেকে রাখা হয়। যে কয়লা সমুদ্র থেকে কেন্দ্রে আনা হয় সেটিও বার্জে ঢেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে চিমনি তা ২৭৫ মিটার উচ্চতার যা, এখন পর্যন্ত মানবসৃষ্ট সবচেয়ে বড় চিমনি। এতে পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। এছাড়া এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক প্রিসিপিটেটর (ইএসপি) ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ কার্যকর, অর্থাৎ সর্বোচ্চ যে কয়লা তা এখানেই ডিপোজিট ও সংগ্রহ হয়ে যায়। এতে বায়ু দূষণের আশঙ্কা কম থাকে। এছাড়া এখানে আরও আছে ফ্লু-গ্যাস ডিসালফারাইজেশন (এফজিডি) একে বাইপাস করা যাবে না। এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সালফার সংগ্রহ হয়ে যায়। কোনো কিছুতে আর সালফার যায় না। আর এ কেন্দ্রে যে কয়লা ব্যবহৃত হয় তা কম অ্যাস এবং কম সালফারযুক্ত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. হারুনর রশীদ খান বলেন, যেকোনো গ্রিন বেল্ট সারা পৃথিবীতে সবার জন্য কাম্য। এ গ্রিন বেল্ট আমাদের রক্ষা করে। আমরা সুন্দরবনকে বাংলাদেশের ফুসফুস বলি। এ বনটি আমাদের শুধু অক্সিজেনই দেয় না, এটি একইসঙ্গে কার্বনডাই অক্সাইডকে শুষে নিয়ে দূষণ রোধ করে। এ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেহেতু কয়লা পোড়ানো হবে এতে বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইডের মতো কিছু গ্যাস দূষণ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিল যে তারা এ ক্ষতিকর গ্যাস দূষণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে এবং এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্যও। এর পাশাপাশি তারা যদি গ্রিন বেল্ট তৈরি করে তবে তা অবশ্যই একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যেহেতু এরই মধ্যে সেখানে বিভিন্ন পাখি আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে তার অর্থ এ যে সেখানে জীববৈচিত্র্যের উন্নতি হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমি মনে করি দেশের অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর এ ধরনের ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।

আরও পড়ুন>>

>>> আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৬ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২৪
আরকেআর/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।