ঢাকা: পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর মনে করেন পেট্রোবাংলাকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গতিশীল করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি।
সম্প্রতি বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি এমন দাবি করেন।
প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি ইচ্ছায় দায়িত্ব নিয়েছি উল্লেখ করে আবার যদি প্রধানমন্ত্রী চান তাহলে এ দায়িত্ব পালন করবেন বলেও জানিয়েছেন
তিনি।
২০০৯ সালের ১৮ অক্টোরব পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হিসেবে ১বছরের জন্য চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ পান। মেয়াদ শেষ হলে ২০১০ সালে আবার দ্বিতীয় দফায় ২বছরের জন্য চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ পান। ১৭ অক্টোবর চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ব বিভাগের এই অধ্যাপকের।
তার সময়ে গ্যাসের উৎপাদন ঘাটতি, দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গ, সফলতা ব্যর্থতা এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। আজ পড়ুন প্রথম পর্ব।
তিনি মনে করেন পেট্রোবাংলাকে অতীতের যে সময়ের চেয়ে বেশি গতিশীল করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি। এ জন্য প্রশাসনিক সংস্কার জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।
বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময়ে স্থবির হয়ে থাকা বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনকে(পেট্রোবাংলা) কাজে ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন। এ কার্যক্রমের ধারা অব্যহত থাকলে অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেব বলেও মনে করেন তিনি।
বিশাল কর্মযজ্ঞের কারণে বর্তমান সরকারের সময়ে গ্যাসের উৎপাদন বেড়েছে দৈনিক ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তিনি বলেন বর্তমান সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন দেশে দৈনিক গ্যাস উৎপাদন হতো ১ হাজার ৭১৩ মিলিয়ন ঘনফুট। যা বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ২৮৪ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে।
চলতি বছরেই আরও প্রায় দৈনিক আরও ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাইপ লাইনে যুক্ত হবে। এ গুলো হচ্ছে সালদা থেকে প্রায় ২০ মিলিয়ন, ফেঞ্চুগঞ্জ ২০, তিতাস থেকে ৩০ থেকে ৩৫, এবং শ্রীকাইল থেকে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট।
শ্রীকাইল থেকে গ্যাস উৎপাদন দেরি প্রসঙ্গে সমালোচকদের উদ্দেশে বলেন, কারো বিশেষ স্বার্থে নয়। পাইপ লাইন সমস্যার কারণে এখান থেকে গ্যাস উৎপাদন বিলম্ব হচ্ছে। তারা চেষ্টা করছেন দ্রুত পাইপ লাইন নির্মাণ করে গ্যাস উত্তোলন করতে। কিন্তু যে দিক দিয়ে পাইপ লাইন তৈরি হবে সেখানে পানি থাকায় কাজ বিলম্ব হচ্ছে।
ড. হোসের মনসুর বলেন, আমার সময়ে প্রায় ১৮ টি কূপ খনন করা হয়েছে। আর ২টির কাজ চলছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে অনুসন্ধান ক’প অন্যটি হচ্ছে উন্নয়ন ক’প।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে সরকার সুন্দলপুর ও শ্রীকাইলে ২টি নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। এ ছাড়া ৭টি নতুন স্ট্রাকচার আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, সুনেত্র গ্যাস ফিল্ডে ড্রিলিং চলছে। এখানে গ্যাস আবিষ্কার হলে প্রায় ২ থেকে ৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস পাওয়া যাবে। যা হবে একটি বিশাল অর্জন।
সুনেত্র গ্যাস ফিল্ডে সোমবার (অক্টোবর ৮) পর্যন্ত ২ হাজার ২৬ মিটার ড্রিলিং শেষ হয়েছে। তারা ধারণা করছেন আড়াই হাজার থেকে ২৬শ মিটারে প্রচুর গ্যাসের মজুদ রয়েছে।
দেশের বর্তমান গ্যাসের মজুদ প্রসঙ্গে বলেন, ডিএনপি, ইউএসজিএস, পেট্রোবাংলার রির্জারভার ইউনিট, হাইড্রোকার্বন ইউনিট দেশের গ্যাস মজুদ নিরূপন করেছে। তাদের কারও তথ্যের সঙ্গে কারো তথ্যের মিল নেই। তবে এসব মজুদ নির্ণয়কারি প্রতিষ্ঠান ১২ টিসিএফ থেকে ১৮ টিসিএফ পর্যন্ত মজুদ থাকার কথা বলেছে।
সে হিসেবে আমরা বলি দেশের বর্তমান মজুদ রয়েছে ১২ থেকে ১৫ টিসিএফ। যা বর্তমান হারে উত্তোলন হতে থাকলে দেশের ১৬ থেকে ২০ বছরে শেষ হয়ে যাবে। এ ছাড়া প্রাক্কলিত মজুদ (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য) রয়েছে ২৬.৭৪ টিসিএফ।
বর্তমান সরকারের সময়ে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৪৬০ কিলোমিটার লাইন ২-ডি সার্ভে করা হয়েছে। ৩-ডি সার্ভে করা হয়েছে ১ হাজার ১৯৭ বর্গ কিলোমিটার লাইন।
এতে প্রাক্কলিত মজুদ বেড়েছে উল্লেখ করে বলেন, চলতি অথবা আগামী সপ্তাহে সিলেট গ্যাস ফিল্ডের ৩-ডি ফলাফল আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হবে।
কি পরিমাণ মজুদ বেড়েছে আগেই বলা সম্ভব নয় উল্লেখ করে বলেন, ৩-ডিতে ৭ হাজার মিটার মাটির নিচে নতুন একটি গ্যাস জোন বিশাল মজুদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
গ্যাজপ্রমকে কাজ দেওয়ার সমালোচনার জবাবে বলেন, বাপেক্স হয়ত কাজ করতে পারত। কিন্তু তাতে সময় অনেক বেশি লাগত। দেশের বাড়ন্ত গ্যাস চাহিদার কথা মাথায় রেখেই দ্রুত কাজের জন্য গ্যাজপ্রমকে কাজ দেওয়া হয়েছে।
বেশি দুরত্বে দ্রুত পৌঁছতে হলে মানুষ যানবাহন ব্যবহার করে উল্লেখ করে বলেন, এ ক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে। রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমকে কাজ দেওয়ায় দেশের স্বার্থের কোন ক্ষতি হয়নি। বরং ভবিষ্যতে তাদের এই কাজ মাইলফলক হয়ে থাকবে।
গ্যাজপ্রমকে ১০ টি ক’পের বিপরীতে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ায় বেশি হয়নি উল্লেখ করে বলেন, বাপেক্স এই কাজ করলে হয়ত আরও বেশি লাগতে পারতো।
গ্যাজপ্রম ২টি রিগ এনেছে উল্লেখ করে বলেন, তার খুব শিগগিরই কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। তাদের এই কাজ শেষ হলে এখান থেকে বাড়তি গ্যাস পাইপ লাইনে দেওয়া সম্ভব হবে। এতে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে বর্তমান গ্যাস সংকট কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে।
সরকার আসার পরে দ্রুত গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে ফাস্ট ট্রাক প্রকল্প নেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়েছিল বেশ কিছু ক’প রয়েছে যেগুলো অল্প খরচে সংস্কার করে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাস বাড়তি পাওয়া সম্ভব। সে প্রকল্প অগ্রগতি নেই।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পর্যালোচনা করে দেখা যায় কূপ গুলোর সংস্কার করে খুব বেশি ভাল ফল পাওয়া যেতো না। তাই করা হয়নি। তবে ফাস্টট্র্যাকের আওতায় বিশেষ আইনে গ্যাজপ্রমকে কাজ দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামে গ্যাস সংকট প্রসঙ্গে বলেন, আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ পাইপ লাইন দিয়ে দৈনিক ১৮৫ মিলিয়নের বেশি সঞ্চালন করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে সাঙ্গু গ্যাস ফিল্ড থেকে উৎপাদন কমে যাওয়ায় সেখানে সংকট তৈরি হয়েছে। তবে অনেক কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
২০০৬ সালে গ্যাস সংকট মোকাবেলায় উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ (এবি) পাইপ লাইন থেকে তিতাস গ্যাসের ভাল্ব (ভিএস) স্টেশন পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার পাইপ লাইন নির্মাণের সুপারিশ করে। সুপারিশ পেট্রোবাংলার বোর্ড সভায় অনুমোদন হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি।
এ বিষয়টি তার জানা নেই মন্তব্য করে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, আমরা নরসিংদী মনোহরদি লুপ লাইনসহ অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। সঞ্চালন সংকট দুর করার জন্য। আগে গ্যাস সিলেট অঞ্চলে উদ্বৃত্ত থাকত। তাদের বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে এখন আর গ্যাস বাড়তি থাকেনা বলেও দাবি করেন তিনি।
গৃহস্থালীর কাজে এলএনজি (তরলায়িত প্রাকৃতিক গ্যাস) ব্যবহার এগিয়ে নেওয়া জন্য মহেষখালিতে এলএনজি টামির্নাল নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে বার বার দরপত্র আহ্বান করেও যোগ্য ঠিকাদার না পাওয়ায় আবার রিটেন্ডার করা হবে বলেও জানান তিনি।
সরকার অবসোরে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা জন্য মডেল পিএসসি ২০১২ (উৎপাদন বন্টন চুক্তি) খসড়া অনুমোদন করেছে। শিগগিরই এই পিএসসি ২০১২ ওয়েব সাইটে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
দ্রুতই সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হবে উল্লেখ করে বলেন, অগভীর সমুদ্রে থাকছে ৯টি ব্লক আর গভীর সমুদ্রে থাকছে ৩টি ব্লক।
মডেল পিএসসি-২০০৮কে দেশের স্বার্থে পরিবর্তন করে পিএসসি ২০১২ খসড়া করা হয়েছে। মডেল পিএসসি ২০১২তে গ্যাস রপ্তানির কোন সুযোগ রাখা হয়নি। এমনকি গ্যাসকে এলএনজি আকারে পরিবর্তন করেও রপ্তানি করার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
পিএসসি ২০০৮ কর্পোরেট ট্যাক্স দিতে হত পেট্রোবাংলাকে। কিন্তু পিএসসি ২০১২ কর্পোরেট ট্যাক্স ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করার বিধান করা হয়েছে।
এ ছাড়া শ্যালো ব্লকে বাপেক্স ১০ শতাংশ ক্রেডিট মুনাফা পাবে। সিলিং করা হয়েছে ১৮০ থেকে ২০০ ইউএস ডলার।
৮ নম্বর ব্লক ২০০৩ সালে বাপেক্স দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোন কর্মসূচি হাতে নিতে না পারা প্রসঙ্গে বলেন, সেখানে সাইচমিক সার্ভে করা হয়েছে।
২০১০ সাল থেকে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। আপাতত আবাসিকে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কোন পরিকল্পনা সরকারের নেই। তবে শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার বেশকিছু প্রস্তাব বিবেচনাধীন রয়েছে।
সরকার প্রথমে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন এবং শিল্পকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলেও জানান তিনি।
গ্যাসের উপর পুরোপুরি জ্বালানি খাত নির্ভরশীল হওয়াকে জ্বালানি খাতের জন্য বড় হুমকি উল্লেখ করে বলেন, এখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। তা নাহলে সামনে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি পড়তে হতে পারে।
পেট্রোবাংলার এই চেয়ারম্যান মনে করেন, দেশের জ্বালানি খাতের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে যাওয়া প্রয়োজন। এছাড়া পরমাণু এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে নজর দিতে হবে। তা হলে বিপরর্যয় দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর