ঢাকা: অবশেষে কুইক রেন্টাল সিন্ডিকেটই জয়ী হতে চলেছে। সিন্ডিকেটের প্রস্তাবিত ফর্মুলায় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, নো বিদ্যুৎ, নো পেমেন্ট সুপারিশ করলেও তা বদলে দেওয়া হচ্ছে। বসে থাকলেও আগের মতোই সরকারকে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছেন।
দেশের স্বার্থে নয়, মূলত এ সিন্ডিকেটের চাপের কারণে মেয়াদ শেষের আগেই কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ খাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ শেষ না হতেই ২০২০ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ কেন এ উত্তর খুঁজতে গিয়েও সিন্ডিকেটের ভূমিকা দেখা গেছে। কোন কারণে সরকার পরিবর্তন হলেও সিন্ডিকেটের মুনাফা যাতে অটুট থাকে সে বিষয়টিই এখন মুখ্য। অদৃশ্য কারণে সরকারও নিজেকে সঁপে দিয়েছে সিন্ডিকেটের হাতে।
প্রথমে আইপিপিতে রূপান্তরের উদ্যোগ নিলেও আইনি জটিলতার কারণে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোফাজ্জল হোসেনকে প্রধান করে ৮ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয় বিষয়টিতে মতামত দেওয়ার জন্য।
কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। যেহেতু বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে তেমন অগ্রগতি নেই। তবে তারা নো বিদ্যুৎ নো পেমেন্টের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু কুইক রেন্টাল ব্যবসায়ীদের চাপে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হচ্ছে।
কমিটির সদস্যরা আরও জানিয়েছেন, রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুরো খরচ ভাড়া হিসেবে পেয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। তাই এখন এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের আর ভাড়ার বিষয়টি থাকার কথা নয়। এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের একটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর সময় নো বিদ্যুৎ নো পেমেন্টে ভিত্তিতে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কমিটি চেয়েছিলো ওই চুক্তিটিকে উদাহরণ হিসেবে ধরে মেয়াদ বাড়াতে।
কিন্তু কুইক রেন্টাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ক্যাপাসিটি পেমেন্ট (বসে থাকলে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়া) দাবি করেছে। চলতি সপ্তাহেই এ বিষয়ে দরকষাকষির জন্য বৈঠক বসবে। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোফাজ্জেল হোসেন দরকষাকষির বৈঠকের বিষয়ে নিশ্চিত করেন। তিনি বাংলানিউজকে জানান, ২ অক্টোবর কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের সঙ্গে বসা হবে। সেখানেই চূড়ান্ত হবে ভাড়ার পরিমাণ। আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম হয়ত সেখাবে নাও হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, শীতকালে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয় না। সে সময়েও এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মচারীদের বসিয়ে রেখে বেতন দিতে হয়। তাই বিনিয়োগকারীরা ভাড়া দাবি করেছে। আমরা চেষ্টা করছি যতটা কমানো যায়।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, এভাবে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ নেই। যখন যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হবে প্রয়োজন হলে তখন মেয়াদ বাড়ানো হয়। আগেই ঢালাওভাবে মেয়াদ বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই।
তিনি বলেন, সরকার বেআইনি কাজ করছে। সরকার দেশের বিদ্যুৎ খাতকে ধ্বংস করে আর কতো কুইক রেন্টাল সিন্ডিকেটের স্বার্থ দেখবে!
তিনি দাবি করেন, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে যে সময়ের জন্য চুক্তি করা হয়, সে সময়ের পুরো খরচ ভাড়া হিসেবে পেয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। অনেক পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এনে বেশি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। মেয়াদান্তে সরকারকে একটি টোকেন মানির বিনিময়ে মালিকানা হস্তান্তর করার কথা। এখন এগুলো সরকারের সম্পদ হয়ে যাওয়ার কথা। আইপিপির ক্ষেত্রে তো তাই হয়।
কুইক রেন্টালের ক্ষেত্রে যেহেতু আলাদা কোনো আইন নেই, এক্ষেত্রেও আইপিপির মতো হওয়ার কথা এমন দাবি করেন বিডি রহমতউল্লাহ।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে নয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে কমিটি। এগুলো হচ্ছে— সামিট গ্রুপের মালিকানাধীন খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ১০৫ মেগাওয়াট ও মদনগঞ্জ সামিট পাওয়ার লিমিটেডের ১০০ মেগাওয়াট, পাওয়ারপ্যাক মতিয়ারার কেরানীগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, সিনহা পাওয়ারের আমনুরা ৫০ মেগাওয়াট, নর্থ পাওয়ার সলুশন লিমিটেডের (এনপিএসএল) কাটাখালী ৫০ মেগাওয়াট, খান জাহান আলী পাওয়ার কোম্পানির নোয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াট, এ্যাকর্ন ইনফ্রাকচার লিমিটেডের জুলদা ১০০ মেগাওয়াট, ডাচ্-বাংলা পাওয়ারের সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট ও ওরিয়নের মেঘনাঘাট আইইএল কনসোটিয়াম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের মেঘনাঘাট ১০০ মেগাওয়াট।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে তিনটি রেন্টাল (তিন বছর মেয়াদী) ও ১৭টি কুইক রেন্টাল (পাঁচ বছর মেয়াদী) বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে এক হাজার ৬৫৩ মেগাওয়াট। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় উৎপাদনে আসে আরও পাঁচটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে চলতি বছর শিকলবাহা, ঠাকুরগাঁও, পাগলা ও খুলনার ৪টি কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হবে যাবে। আগামী বছর শেষ হবে ভেড়ামারা ও সিদ্ধিরগঞ্জের দু’টি কেন্দ্রের। ঘোড়াশালের দুটি কেন্দ্রের মেয়াদ আছে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। ২০১৬ সালে মেয়াদ শেষ হবে নোয়াপাড়ার দুটি এবং মেঘনাঘাট, খুলনা, মদনগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জে একটি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৩
ইএস/এমজেএফ/জিসিপি