ঢাকা: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অপেক্ষায় কেটে গেছে ৫৩টি বসন্ত। সম্ভবত, আর কোনো প্রকল্পের জন্য এত অপেক্ষা করতে হয়নি বাঙালি জাতিকে।
বুধবার এই সুদীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। তবে সরকারের শেষ সময়ে উদ্বোধন করায় এর ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।
এ সময় তার সঙ্গে থাকছেন প্রকল্পটির কারিগরি ও আর্থিক সহায়তাকারী রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় আণবিক শক্তি কর্পোরেশন (রসএটম)-এর অঙ্গ সংস্থা রুশ এটম প্রতিনিধি ও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের কর্মকর্তারা।
স্বাভাবিক গতিতে প্রকল্পটির কাজ এগিয়ে নিতে পারলে পাঁচ বছরের মধ্যে এক হাজার মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিট ও পরবর্তী এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে আরো এক হাজারসহ মোট দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ এক টাকারও কম খরচে পাওয়া যাবে।
এই প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগের ৯০ ভাগ দেবে রাশিয়া সরকার। আর ১০ ভাগ বিনিয়োগ করবে বাংলাদেশ।
পরিকল্পনাধীন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পাবনার ঈশ্বরদীর থানার রূপপুরে স্থাপন করা হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দুইশ ৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
১৯৬১ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হাতে নেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। শুরুতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়ে ছিল মাত্র দুইশ মেগাওয়াট।
১৯৬৪ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জাহাজযোগে যন্ত্রপাতি আনার পথে জাহাজটির গতি পরিবর্তন করে পাকিস্তানের করাচি বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৯৬৯ সালে দুইশ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের লক্ষে একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কারণে তা পিছিয়ে যায়। স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও ‘৭৫ পরবর্তী সময়ে আবারও এ উদ্যোগ ঝিমিয়ে পড়ে।
’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবারও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং ১৯৯৬ সালে প্রণীত জ্বালানি নীতিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়।
১৯৯৭ সালের ১৬ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় দ্রুত বাস্তবায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ’৯৯ সালে প্রকল্পের প্রাক-বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করা হয়।
২০০০ সালে বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্ল্যান (বিএএনপিএপি) অনুমোদন দেয় সরকার। কিন্তু, সরকার পরিবর্তনের কারণে আবারও থমকে যায় এই প্রকল্পের কাজ।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে আবারও উদ্যোগী হয়। শুরু করে রাশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনা। জটিলতা ছিল এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়াম সরবরাহ ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য রাশিয়া সরকার ফেরত নেওয়ার অঙ্গীকার করায় এর সব জটিলতার অবসান হয়ে যায়।
২০০৯ সালের ১৩ মে সমঝোতা স্মারক সই হয়। একই মাসের ২১ তারিখে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট সই হয় রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে।
২০১০ সালের জুনের ৯ তারিখে প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতি করে একটি জাতীয় কমিটি, বিজ্ঞান প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীকে প্রধান করে কারিগরি কমিটি, সচিবের নেতৃত্বে ওয়ার্কিং গ্রুপ ও ১৭ জুন ৮টি সাব কমিটি গঠন করা হয়।
এ নিয়ে রাশিয়ার বিশেষজ্ঞ দল সরেজমিন পরিদর্শনসহ একাধিক বৈঠক করেন। ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে দেশে ‘ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের লক্ষে অবিলম্বে আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হউক’ শীর্ষক একটি প্রস্তাব পাস হয়।
এদিকে, ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি অথরিটির (আইএইএ) মহাপরিচালক বাংলাদেশ সফর করে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ২০১১ রাশিয়ার সঙ্গে কারিগরি সহায়তা চুক্তি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জাপানের ফুকশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিপর্যয়ের কারণে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করলেও প্রকৃত সত্য হচ্ছে- অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় বাংলাদেশের এই কেন্দ্রটি পুরোপুরি নিরাপদ। ’
ইয়াফেস ওসমান বাংলানিউজকে জানান, বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্লাবের ৩২তম সদস্য হতে যাচ্ছে। এতে বাঙালির মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পাবে।
তিনি নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে বলেন, ‘দেশের মর্যাদার প্রশ্ন এটি। তাই, একে এগিয়ে নেওয়া না নেওয়া নতুন প্রজন্মের হাতে। ’
নিরাপত্তা প্রসঙ্গে ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘জাতির নিরাপত্তা সর্বপ্রথম নিশ্চিত করা হয়েছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এই কেন্দ্রে ৪০ হাজার বিমানের যে শক্তি, সেই শক্তির সমান আঘাত করলেও এর কোনো ক্ষতি হবে না। ’
বাংলাদেশ সময়: ২০১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১৩
ইএস/এবি