ঢাকা: মহাজোট সরকার কয়লানীতি চূড়ান্ত করতে চায় না। ভোটের রাজনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে এমন শঙ্কা থেকেই বিষয়টিকে ইচ্ছে করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
২০০৪ সালে শুরু হয় কয়লানীতি প্রণয়নের কাজ। বিগত বিএনপি সরকারের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। মহাজোট সরকার রিভিউ কমিটিতেই কাটিয়ে দিয়েছে তাদের সময়কাল।
সর্বশেষ উচ্চ পর্যায়ের রিভিউ কমিটির রিপোর্ট এক বছর আগেই সরকারের হাতে পৌঁছেছে। কিন্তু সরকার ইচ্ছা করেই বিষয়টি গোপন করে রাখে। গত সেপ্টেম্বর মাসে রিপোর্টটি গৃহীত দেখানো হয়।
জ্বালানি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সেফাউল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, মতামতের জন্য রিভিউ কমিটির রিপোর্টটি পেট্রোবাংলাকে দেওয়া হবে। পেট্রোবাংলার মতামত পাওয়া গেলে খসড়া কয়লানীতি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদন সাপেক্ষে চূড়ান্ত করা হবে।
জ্বালানি বিভাগের উচ্চ পদস্থ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মূলত উন্মুক্ত পদ্ধতি নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হবে এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সরকার চাইছে না এই বিতর্কে জড়াতে। আর তাই এ ব্যাপারে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে চলছে মন্ত্রণালয়।
একই কারণে গত বছর রিভিউ কমিটি রিপোর্ট দেওয়া সত্ত্বেও চলতি বছরে এসে তা হাতে এসেছে বলে চালানো হচ্ছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
কয়লানীতি রিভিউ কমিটির প্রধান পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোশাররফ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, আমরা সুপারিশসহ রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছি। এখন বিষয়টি সরকারের। তাই কোনো মতামত দিতে চাই না।
তবে মোশাররফ হোসেন মনে করেন, “জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য কয়লানীতি চূড়ান্ত করা জরুরি। গ্যাসের উপর নির্ভরতা কমাতে কয়লার বিকল্প নেই। ”
‘যেসব কয়লা খনি নিয়ে বিতর্ক নেই সেসব খনি কয়লানীতির জন্য আটকে না রাখাই ভালো’—এমনটাই অভিমত তার।
কয়লানীতি রিভিউ কমিটির সদস্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, সরকার কয়লানীতি চূড়ান্ত করতে আন্তরিক নয় । তারা যদি আন্তরিক হতো তাহলে কমিটি-কমিটি-খেলা খেলতো না।
২০০৪ সালে কয়লার জন্য পৃথক নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়। ২০০৫ সালে আইআইএফসি নামের দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে খসড়া কয়লানীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আইআইএফসি খসড়া কয়লানীতি প্রণয়ন করে জমা দিলে অনুমোদনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে পেশ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী খসড়া অনুমোদন না দিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে রিভিউ (সংশোধন সংযোজন) করার দায়িত্ব দেন।
প্রফেসর নুরুল ইসলাম খসড়া কয়লানীতির অনেকগুলো বিষয়ে পরিবর্তনের সুপারিশ করে রিপোর্ট জমা দেন। এরই মধ্যে বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা আসার ছয় মাসের মাথায় নতুন করে খসড়া কয়লানীতি প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেয়। বুয়েটের সাবেক ভিসি প্রফেসর আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে নতুন কমিটি গঠন করা হয়।
পাটোয়ারি কমিটি নামে পরিচিত এই কমিটি খসড়া প্রণয়ন করে জমা দিলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেষ পর্যন্ত সেটিকে চূড়ান্ত করতে ব্যর্থ হয়।
মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পাটোয়ারী কমিটির খসড়া কয়লানীতি অনুমোদন না করে জ্বালানি সচিবকে প্রধান করে রিভিউ করার জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে।
আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি পাটোয়ারী কমিটির খসড়া যাচাই কররা পর, খসড়ার নীতি ও বাস্তবায়ন অংশকে দুই ভাগে ভাগ করে কিছু সংশোধনীসহ শুধু ‘নীতি’ অংশটি অনুমোদনের সুপারিশসহ ২০১০ সালে অক্টোবর মাসে জমা দেয়।
আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশ মোতাবেক চূড়ান্ত না করে ২০১১ সালের মার্চে মাসে আবারও উচ্চ পর্যায়ের রিভিউ কমিটি গঠনের জন্য সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে মোতাবেক সেপ্টেম্বর মাসে গঠন করা হয় রিভিউ কমিটি। কমিটিকে ৪ মাসের মধ্যেই রির্পোট দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
কমিটি ১২ অক্টোবর তারিখে প্রথম সভায় বসে। সে হিসেবে তাদের নির্ধারিত সময় শেষ হয় ২০১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি । কিন্তু তারা ৮ মাস পর ২০১২সালের অক্টোবরে রিপোর্ট জমা দেয়।
মহাজোট সরকারের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী, ২০৩০ সালে প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট পরিমাণ বিদ্যুৎ কয়লা থেকে উৎপাদন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে, প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেশে উৎপাদিত কয়লা দিয়ে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে বাংলাদেশে উত্তোলন করতে হবে বছরে প্রায় ৩৩ মিলিয়ন টন কয়লা। দেশের একমাত্র বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি বছরে মাত্র এক মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করতে সক্ষম।
কোনো খনির কয়লা পেতে হলে প্রক্রিয়া শুরুর পর কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ বছর অপেক্ষায় থাকতে হয়। সে হিসেবে এখনই উদ্যোগ নেওয়া না গেলে কয়লা খাত পিছিয়ে পড়বে। আর এই চাপ গিয়ে পড়বে গ্যাসের উপর।
অন্যদিকে দেশের গ্যাসের মজুদও ফুরিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে ১০বছরেই ফুরিয়ে যাবে বর্তমান মজুদ।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৩
ইএস/জেএম/আরআইএস