ঢাকা: সরকারের মধ্যমেয়াদী বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার।
আর তেমনটি হলে বিদ্যুতের মূল্য দ্বিগুন করেও ঘাটতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুতের উৎপাদন চিত্র অনেকটাই হতাশাজনক।
প্রস্তাবিত রামপাল ও মহেশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে স্বপ্ন দেখছে সরকার। এই দু’টির মধ্যে রামপালে সম্প্রতি কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত স্থানে কিছু অংশে মাটি ভরাট হয়েছে। ২০১৯ সালের আগে এখান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী বাংলানিউজকে বলেছেন, আমরা একইসঙ্গে শিখছি এবং বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে গেছি। যে কারণে কিছু ভূল-ভ্রান্তি আছে। আগে মিলিয়ন ডলারের কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়নি, অথচ এখন অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ চলছে যেগুলোতে বিলিয়ন ডলারের মতো ব্যয় হবে। কোনো সমস্যা হবে বলে আমি মনে করি না।
মহেশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণের কাজই শেষ হয়নি। দাতা সংস্থা জাইকা ২০২২ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ২০২০ সালের মধ্যেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণে জাইকাকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বেসরকারি খাতের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চিত্র চরম হতাশাজনক। মোট ৯টি কয়লাভিত্তিক (আইপিপি) বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তিনটির জন্য চুক্তি হলেও অপর ৭টির চুক্তি স্বাক্ষরেই করতে পারেনি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।
বেসরকারি খাতে ১০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে অনভিজ্ঞ ওরিয়ন গ্রুপকেই দেওয়া হয়েছে ৬টি। দু’দফায় ৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেওয়া হয় ওরিয়নকে। আগের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনোই অগ্রগতি নেই। এখন পর্যন্ত অর্থায়ন চূড়ান্ত করতে পারেনি। অথচ নতুন করে আরও ৩টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেওয়া হচ্ছে ওরিয়ন গ্রুপকে।
ওরিয়ন গ্রুপকে আগে যে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দেওয়া হয়েছে তার মোট উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ১ হাজার ৮৬ মেগাওয়াট। আর নতুন করে যে তিনটি দেওয়া হচ্ছে তার মোট উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ১ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট। তাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়াবে ২ হাজার ২৮০ মেগাওয়াট।
আগের ৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রর মধ্যে একটি ৪৫ মাসে আর অন্য দু’টি ৩৬ মাসের মধ্যে উৎপাদনে যাওয়ার কথা। কিন্তু ২৪ মাস পার হয়ে গেলেও এখনও অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পারেনি কোম্পানিটি।
নিয়ম রয়েছে অর্থায়ন নিশ্চিত করার পর চুক্তি সম্পাদন হবে। অর্থায়নের বিষয়ে সরকার বা বিদ্যুৎ বিভাগের কোনোরকম দায় থাকে না। সংশ্লিষ্ট কোম্পানি যদি যথাসময়ে অর্থায়ন নিশ্চিত ও কাজ শুরু করতে না পারে তাহলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু ওরিয়নসহ অনেক কোম্পানির জামানত বাজেয়াপ্ত না করে দফায় দফায় সময় বাড়ানো হচ্ছে।
অপর ৪টি বেসরকারি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে এস আলম গ্রুপ চট্টগ্রামে দু’টি (৬১২*২), বাঁশখালি ৬০০ মেগাওয়াট বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি ও চট্টগ্রাম-১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ পেয়েছে বিএসআরএম। এই চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে এখনও চুড়ান্ত চুক্তি হয়নি। দফায় দফায় সময় পেছানো হচ্ছে।
অন্যদিকে মালয়েশিয়া, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যৌথ মালিকানায় পৃথক তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু অগ্রগতি সামান্যই। এগুলো হচ্ছে, তেনেগা মালয়েশিয়ার সঙ্গে মহেশখালী-১৩২০ মেগাওয়াট, চীনের সঙ্গে পটুয়াখালী-১৩২০ মেগাওয়াট ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে পটুয়াখালী-১৩২০ মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত সমঝোতা স্মারকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সমূহের অগ্রগতিও সন্তোষজনক নয়। বিবিয়ানা-১ (৪৫০-মেগাওয়াট) বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চলতি বছরে জানুয়ারিতে উৎপাদনে আসার কথা ছিলো। এখন পর্যন্ত কাজই শুরু হয়নি। বিবিয়ানা-২ (৩৪১ মেগাওয়াট) গত জানুয়ারি মাসে উৎপাদনে আসার কথা ছিলো এখন পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ২৫ শতাংশ।
ভেড়ামারা ৩৬০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্টের চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে চলতি বছরের মার্চে। এখন পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ৫ শতাংশ।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সরকারি খাতে ১৪টি, বেসরকারি খাতে ২০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৬ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। আর দর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে ১৯টি। এরমধ্যে সরকারি ৫টি, বেসরকারি ১৫টি। মোট উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট।
এই যখন উৎপাদন অবস্থা সেখানে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে গ্রাহক সম্প্রসারণ প্রকল্প। শুধুমাত্র পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ৭টি গ্রাহক সম্প্রসারণ প্রকল্প চলমান রয়েছে। ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ হবে এসব প্রকল্প। যার মাধ্যমে ২৫ লাখ ২৮ হাজার নতুন গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে। এর বাইরে প্রস্তাবিত ৭টি প্রকল্পে ২০২০ সালের মধ্যে আরও ২২ লাখ ৫০ হাজার এ প্রস্তাবনা পর্যায়ে থাকা ৩টি প্রকল্পে ১৩ লাখ ৬০ হাজার গ্রাহককে সংযোগ দেওয়া হবে।
এতে করে এই বিতরণ সংস্থাটির গ্রাহক সংখ্যা ১ কোটি ৫৬ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। যার বিপরীতে তাদের বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াটে। যা বর্তমানে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াটে সীমাবদ্ধ রয়েছে। কোম্পানিটিকে এখন কমবেশি আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আরইবি চেয়ারম্যান মঈদ উদ্দীন।
এই চিত্র একটি বিতরণ সংস্থার। আরও ৪টি বিতরণ কোম্পানি রয়েছে তাদেরও চাহিদা জ্যামিতিকহারে বাড়বে। বড় বড় শপিং মল তৈরি হচ্ছে যেগুলো বলতে গেলে কয়েকটি জেলার সমান বিদ্যুৎ খাচ্ছে। পাশাপাশি এসি, ফ্রিজ, ওয়াটার হিটারসহ অন্যান্য বিলাসী যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে ব্যাপকহারে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব সম্প্রতি এক সভায় বলেন, উন্নত দেশে জিডিপি ১ শতাংশ বাড়লে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পায় দেড় শতাংশ। আর আমাদের দেশে চাহিদা ১২ থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান আব্দুহু রুহুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে। দু’একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতেই পারে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২০ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০১৪