ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

আলোর পথে এসপিএম

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ও ইফতেখার ফয়সাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৪
আলোর পথে এসপিএম

চট্টগ্রাম থেকে: আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম)। ইতোমধ্যেই চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে।

অর্থায়নের অনিশ্চয়তাও কেটে গেছে চাইনিজ এক্সিম ব্যাংক এগিয়ে আসায়। আগামী বছরের প্রথম দিকেই কাজ শুরু হবে।

এসপিএম নির্মিত হলে প্রতিটন ক্রড আমদানিতে ৪ ডলারের মতো পরিবহন খরচ কমে যাবে। এছাড়া জাহাজ থেকে ক্রড অয়েল (অপরিশোধিত তেল) আনলোডিংয়েও জটিলতা দূর হবে। জরিমানা প্রদান থেকে রক্ষা পাবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় খাতের একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনকারী প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড’র (ইআরএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজী মো. আলী আফজাল বাংলানিউজকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

এসপিএম প্রকল্পে ব্যয় হবে ৪৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। নির্মাণ কাজের শেষে চালু করার পর দেতে ৬ -৭ বছরের মধ্যে বিনিয়োগ উঠে আসবে। এরপর পুরোটাই মুনাফায় থাকবে বলে জানিয়েছেন ইআরএল এমডি।

মহেশখালীর দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে থাকছে প্রধান কেন্দ্র। সেখান থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরত্বে থাকছে রিজার্ভার ট্যাংক। গভীর সমুদ্রে মাদার ভ্যাসেল থেকে ক্রুড অয়েল ৩৬ ইঞ্চি ব্যসের পাইপের মাধ্য দিয়ে সরাসরি রির্জাভারে আসবে। এই রির্জাভারের ধারণ ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছে আড়াই লাখ মেট্রিক টন।

স্টোরেজ ট্যাংকার থেকে ইআরএল পর্যন্ত অবসোরে (জলভাগ) ৬৩ কিলোমিটার এবং অনসোরে (স্থলভাগ) ৩০ কিলোমিটারসহ মোট ৯৩ কিলোমিটার ডাবল পাইপ লাইন থাকবে। এর একটি হচ্ছে ১৮ ইঞ্চি ডায়া অপরটি ১০ ইঞ্চি ডায়া।

ইআরএল এমডি জানান, বাংলাদেশ মারবান ও অ্যারাবিয়ান লাইট ক্রড আমদানি করছে। একটি পাইপ লাইন দিয়ে মারবান (কালচে রঙয়ের) ক্রড, অপরটি দিয়ে তুলনামূলক উজ্জ্বল অ্যারাবিয়ান লাইট ক্রুড সঞ্চালন করা হবে। যা এখন গভীর সমুদ্রে মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজের মাধ্যমে কর্ণফ‍ুলী নদীতে অবস্থিত ইস্টার্ন রিফাইনারির জেটিতে আনা হচ্ছে। সেখান থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমেই আরএল’র স্টোরেজে নেওয়া হয়।

এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানাবিধ কারণে মাদার ভ্যাসেল থেকে ক্রুড আনলোড করতে বিলম্ব হচ্ছে। এ কারণে মোটা অংকের লোকসান দিতে হয় বিপিসিকে। এসপিএম নির্মিত হলে অনিশ্চয়তা দূর হয়ে সক্ষমতা বাড়বে ইআরএল’র।

বছরে সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন টন অর্থাৎ সাড়ে ৫৫ লাখ টন ক্রুড অয়েল হ্যান্ডেলিং করতে পারবে রাষ্ট্রীয় মালিকার এ প্রতিষ্ঠানটি।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, এখন ৬০ কিলোমিটার দূরে মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজে করে ক্রড ইআরএল’তে নেওয়া হয়। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা রকম বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।

বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে এসপিএম নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সে সময় একটি মাত্র পাইপ লাইন বসানোর কথা ছিলো। তাতে ব্যয় ধরা হয়েছিলো ১২৯ মিলিয়ন ডলার। এতে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি) অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো।

পরে  স্টোরেজ থেকে ৯৩ কিলোমিটার ডাবল পাইপ বসানোর পরিকল্পনা গৃহীত হলে বাজেট বেড়ে ৪৪৬ মিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। যে কারণে পিছিয়ে যায় আইডিবি। আইডিবি একক প্রকল্পে এতো বড় বিনিয়োগ করেন না বলে জানিয়েছেন ইআরএল এমডি।
যে কারণে প্রকল্পটি ঝুলে যায়।

সম্প্রতি চীনা এক্সিম ব্যাংক এগিয়ে আসায় বিষয়টি আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। ইপিসি ঠিকাদার হিসেবে চাইনিজ সিপিপিবি’র (চাইনিজ পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ব্যুরো) সঙ্গে সমঝোতা স্মারক চুক্তি  (এমওইউ) সই হয়েছে।

ইআরএল এমডি জানান, আগামী বছরের প্রথম দিকে কাজ শুরু হবে। আর ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার উপযোগী হবে। ২০০৯-১০ অর্থ বছরে বাংলাদেশের জ্বালানি তেলে চাহিদা ছিলো ৩৭ লাখ টন। এ চাহিদা এখন ৫৫ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু সে তুলনায় বাড়েনি রাষ্ট্রীয় একমাত্র তেল শোধনাগার ইআরএল’র ক্ষমতা।

যে কারণে বিপুল পরিমাণ পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হচ্ছে বিপিসিকে। অপরিশোধিত তেল আমদানি করে শোধন করলে প্রতি ব্যারেলে সাশ্রয় হয় ৪ ডলারের মতো। নানা হিসেব নিকেশের কারণে লোকসান দিতে দিতে রুগ্ন হয়ে পড়ছে বিপিসি।

অন্যদিকে এসপিএম’র পাশাপাশি ইআরএল’র শোধন ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি বছরে ১৫ লাখ মেট্রিক টন ক্রড অয়েল পরিশোধন করতে পারে।

এছাড়া নতুন আরও দু’টি ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। প্রাকসমীক্ষা যাচাই শেষ হয়েছে। টেকনিক্যাল কমিটি পরামর্শক নিয়োগের টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি করছে। এর পরেই দরপত্র আহ্বান করা হবে। এতে ব্যয় হবে ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।

এসপিএম’র সমান্তরালে শোধনাগারের কাজও চলছে বলে জানিয়েছেন গাজী মো. আলী আফজাল। অন্যদিকে রির্জাভারও বাড়ানো হচ্ছে ইআরএল’র। বর্তমানে ক্রড অয়েলের স্টোরেজ ট্যাংকের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার টন। আর পরিশোধিত তেলের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার টন। নতুন করে আরও ৪টি স্টোরেজ ট্যাংকার নির্মাণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ ৪টি স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণ করা হলে ধারণ ক্ষমতা বাড়বে সাড়ে ৫৬ হাজার মেট্রিক টন।

বিপিসির সহযোগী এ প্রতিষ্ঠানটি বিপিসির কাছ থেকে অপরিশোধিত তেল নিয়ে পরিশোধন করে আবার বিপিসির কাছে হস্তান্তর করছে। প্রতি ব্যারেলে ৭৩ টাকা বিল পায়। এতে কোম্পানিটি ২০১২-১৩ অর্থ বছরে এক হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে। সে হিসেবে এসপিএম ও শোধনাগার যুক্ত হলে বছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করতে সক্ষম হবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি।

এসপিএম ও শোধনাগার নির্মিত হলে একদিকে যেমন ইআরএল’র মুনাফা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। তেমনি বিদেশ থেকে পরিশোধিত তেল আমদানি কমে যাবে। তাতে রাষ্ট্রও বিশাল (প্রতি ব্যারেলে ৪ ডলার) লোকসান থেকে রেহাই পাবে।

বিপিসি’র চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, ইপিসি ঠিকাদার নিয়োগের ফাইল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় ইআরডিতে পাঠিয়েছে। তারা অনুমোদন দিলেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বাংলানিউজকে জানিয়েছেন আমরা যতদ্রুত সম্ভব এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী ৪ মাস আগে ইআরএল’র দ্বিতীয় ইউনিটের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু নানা রকম সিন্ডিকেটের কাজকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। আমরা যতদ্রুত সম্ভব প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।