মহাসড়ক থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া এই পথটি ধরে ৬ কিলোমিটার গেলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র। রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র।
তবে একটি সংযোগ সড়কেই নাম রটে গেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। ময়লা লুঙ্গি কিংবা প্যান্ট আর শার্ট-পাঞ্জাবি গায়ে সে পথে ছুটে চলা মানুষগুলোর মুখে মুখে সে নাম। এদের সবারই কর্মসংস্থান এখন এই ‘বিদ্যুৎকেন্দ্র’ নির্মাণকে ঘিরে।
সাংবাদিকদের একটি দল সে পথ ধরে সেদিকেই এগুলো। আর পৌঁছে দেখা গেলো- রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাথমিক কাজ শেষ পর্যায়ে। কর্তৃপক্ষ জানালো, মূল নির্মাণ কাজ শুরু হবে মার্চে।
ভূমি অধিগ্রহণ হয়েছে ২০১০ সালে। এরপর মাটি ও বালু ভরাট চলেছে, বেষ্টনি দেওয়াল পড়েছে, নির্মিত হয়েছে সংযোগ সড়ক। এসব নিয়েই গত কটি বছর ধরে প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে এসব শ্রমিকের হাতে। সুনির্দিষ্ট করে বললে জায়গাটি- রামপাল উপজেলার রাজনগর ও গৌরম্ভা ইউনিয়নের সাপমারী কৈ-গর্দ্দাশকাঠি মৌজা। অদূরেই পশুর নদী।
এখানেই নির্মিত হবে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে ১৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
দেশে এখন পর্যন্ত স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রধান জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাস। কিন্তু গ্যাসের মজুদ দ্রুত কমে যাওয়ায় অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আর গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। মূল্য এবং প্রাপ্যতার দিক থেকে বিচার করলে কয়লা-ই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জ্বালানি।
উন্নত দেশগুলো যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন, জাপান, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তাদের মোট বিদ্যুতের ৪০ থেকে ৯৮ শতাংশ উৎপাদন করে কয়লা দিয়ে। বাংলাদেশে কয়লায় উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ মাত্র ১ শতাংশের সামান্য বেশি (১.৩৩%)।
কর্তৃপক্ষ জানায়, সেই দিক বিবেচনা করে সরকার পশুর নদীর তীর ঘেঁষে রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা।
সাংবাদিকদের সামনে কাজের ধারাবাহিক অগ্রগতি তুলে ধরতে তারা জানালেন, ২০১০ সালে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে রামপালের ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই শুরু হয় জমি ভরাট ও সড়ক নির্মাণের কাজ। যা এখন শেষ প্রায়। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বমোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২.৭৭ বিলিয়ন ইউ.এস ডলার। যার মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (ইপিসি) মূল অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হবে এক দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার।
তারা আরও জানালেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। সার্বক্ষণিক পরিবেশগত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালুসহ প্রকল্প এলাকায় সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার লক্ষে ২ লাখ বৃক্ষ রোপন করা হবে। আগামী ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে এই প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলে দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সংকট দূর হওয়ার পাশাপাশি এই অঞ্চলের শত শত মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) আনোয়ারুল আজম সে কথাই বলছিলেন। তিনি বলেন, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রাথমিক কাজ এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল কাজ শুরু হবে মার্চ মাসে। আগামী ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে এই প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে।
সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকায় থাকায় বিদ্যুত কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ যথাসময়ে শেষ হবে বলেই আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রকল্পের উপ – ব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও নিরাপত্তা) মো. অলিউল্লাহ।
কাজ পরিচালানর জন্য এরই মধ্যে একটি নান্দনিক অফিস ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বসানো হয়েছে কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার। পশুর নদীতে জেটি নির্মাণের কাজও সম্পন্ন হয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এলাকার নিরাপত্তার জন্য ৩০ জন আনসার, ৫জন পুলিশ দায়িত্ব পালন করছেন।
বাবু বাড়ী এলাকার মহাসড়ক থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পর্যণ্ত ৬ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের ফলে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ তাদের ঘেরের চিংড়ি, জমির ফসল সহজে কম খরচে বাজারজাত করতে পারছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় এলাকার শিক্ষার্থীরাও এখন সহজে স্কুল –কলেজে যেতে পারছে। এগুলোকে বাড়তি সুবিধা বলেই মনে করছেন মো. অলিউল্লাহ।
তিনি জানান, প্রকল্পের প্রায় সকল ধরণের কাজে যোগ্যতা অনুসারে এলাকার মানুষকে কাজ দেওয়া হয়েছে।
একটি উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে অপর প্রকল্প সংযুক্ত। আর সেসব মাথায় রেখেই সরকার একযোগ বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এমন মত দিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, পদ্মা সেতু হয়ে গেলে ব্যবসা বাণিজ্যেও প্রসার ঘটবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে। এতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। আর সে চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতা করে পরিবেশবাদীদের একের পর এক আন্দোলনকে অযৌক্তিক বলেও মত দেন এই কর্মকর্তা।
প্রকল্প এলাকায় কাজ করার সময় কথা হয় শ্রমিক আব্দুস সালামের সাথে। বাড়ি গৌরম্ভায়। তিনি জানান, তিন বছর ধরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রঙের কাজ করছেন। তার মতো রাজনগর ও গৌরম্ভা ইউনিয়নের অনেকেই এখানে কাজ করছেন।
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের উপ – ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিনোদ ভোয়ার (Vinod Bhoyar) বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের অব্যাহত বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ এবং যৌক্তিক মূল্যে গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর জন্য কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে একটি মহল প্রথম থেকেই ভিত্তিহীন, কাল্পনিক ও মনগড়া বক্তব্য এবং তথ্য দিয়ে এ প্রকল্প সম্পর্কে মানুষের মনে এক ধরণের নেতিবাচক মনোভাব এবং ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
বিদ্যুত কেন্দ্রটি সুন্দরবনের কোনও ক্ষতি করবে না এই মত দিয়ে তিনি বলেন, এজন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে এই প্রকল্পে।
প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই ভারতীয় কর্মকর্তা।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চালু হলে এখানে প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিকসহ প্রায় ৭শ’ কর্মসংস্থান হবে বলেও জানন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৭
এমআরএম/এমএমকে