বাংলানিউজের সরেজমিন অনুসন্ধানে অভিযোগ পাওয়া গেছে, গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি তিতাসের অসাধু কর্মকর্তাদের উৎকোচ দিয়ে যুগ যুগ ধরে বস্তিটিতে গ্যাসের অবৈধ সংযোগের কারবার চলছে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে।
লক্ষীপুরের রামগঞ্জের আব্দুল মান্নান। স্ত্রী খাদিজা বেগমকে নিয়ে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন কড়াইল বস্তির বউবাজার এলাকার ‘ক’ ব্লকে। অন্য অনেকের মতো তিনিও এখানকার সরকারি জমিতে তৈরি করেছিলেন দোতলা ঘর। নিচতলায় পাকা ফ্লোর হলেও পুরো বাড়িটিই কাঠ ও টিনের।
এ বাড়িতে ১২টি ছোট ছোট ঘর তৈরি করেছিলেন আব্দুল মান্নান। এর একটিতে ছিলো স্ত্রী ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তার বসবাস। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা অন্যত্র থাকেন। নিজেদের থাকারটি বাদে অন্য ১১টি ঘর ভাড়া দিয়ে তিনি প্রতি মাসে সাড়ে ২৭ হাজার টাকা ভাড়া পেতেন। এ আয় থেকে অবৈধ গ্যাস সংযোগে বসানো ছয়টি চুলার জন্য চিহ্নিত সিন্ডিকেটকে দিতে হতো ৩ হাজার ৬০০ টাকা। এর সঙ্গে পানি ও বিদ্যুৎ বিল দিয়েও এক সময়ে বনানী মাঠের পাশে পান-বিড়ি বিক্রি করা মান্নানের বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু বুধবার (১৫ মার্চ) রাতের আগুন কেড়ে নিয়েছে তার সকল কিছু।
প্রতক্ষ্যদর্শীদের অভিযোগ, আব্দুল মান্নানের বাড়ির দোতলারই একটি রান্নাঘরের চুলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। তবে মান্নানের স্ত্রী খাদিজা বেগমের দাবি, এসবের কিছুই তারা জানেন না। ওই সময় লক্ষীপুরের রামগঞ্জের বাড়িতে ছিলেন। রাত আড়াইটায় বড় মেয়ের টেলিফোনে আগুনের সংবাদ পেয়ে তিনি ও তার স্বামী বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) দুপুরে কড়াইলে পৌছেছেন। এসে দেখেন, সারা জীবনের সম্বল পুড়ে শেষ। সাজানো সংসারের ছাইয়ের স্তুপ থেকে তখনো ধোঁয়া উঠছিল।
আব্দুল মান্নানের প্রতিবেশি বরিশালের বানারিপাড়া উপজেলার চাউলাকাঠি গ্রামের আবুল কালাম। গত ২৬ বছর ধরে গুলশান লেকে নৌকা বেয়ে কড়াইল বস্তিতে লোক পারাপারের কাজ করে আসছিলেন। ১০ বছর আগে নিজের ও স্ত্রীর জমানো আশি হাজার টাকায় বস্তির একটি জমি কিনে নেন তিনি। সে জমিতে তৈরি করেন কাঠ ও টিনের দোতলা বাড়ি। এ বাড়ির ১০টি ঘরের একটিতে তিনি স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। বাকি ঘরগুলো ভাড়া দিয়েছিলেন ২ হাজার ৬০০ টাকা করে।
আবুল কালাম বাংলানিউজকে বলেন, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে গত বছরের জুলাইয়ের জঙ্গি হামলার পর কড়াইলে নৌকা চলাচল বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। এরপর থেকে ঘরভাড়ার টাকাই ছিল তার পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। রাতে যখন আগুনের ঘটনা ঘটে, তখন ঘর থেকে কেবল জীবন নিয়েই কোনো রকমে বের হতে পেরেছেন তারা। বাকি সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ঘরগুলোর সঙ্গেই। এখন সব হারিয়ে পথে বসেছেন আর সবার মতোই।
কেবল বাড়িওয়ালা মান্নান বা কালামই নয়, এ অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নিয়েছে বস্তির আরো প্রায় দুই হাজার পরিবারের সব কিছু। তারাও কেবল জীবন নিয়েই কোনো রকমে ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্তদের বেশিরভাগই খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষ।
শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার ফিরোজ মিয়া তেমনই একজন। পেশায় রাজমিস্ত্রি ফিরোজ মিয়া ২ হাজার ৬৫০ টাকায় স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন এখানে। আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে তারও সবকিছু।
ফিরোজ মিয়ার অভিযোগ, এখানকার হাজার হাজার বাড়ির এমন একটিও নেই, যেখানে কমপক্ষে দু’টি করে গ্যাসের সংযোগ ছিল না। প্রতিটি বাড়ির নিচতলা ও দোতলায় ছিলো আলাদা আলাদা রান্নাঘর। সব বাড়িতেই সারাদিন ধরে ১০ থেকে ২০টি পরিবারের রান্না চলতো চার থেকে ছয়টি চুলায়।
কড়াইল বস্তির বাড়িওয়ালা আব্দুল হামিদ বাংলানিউজকে বলেন, বউবাজার এলাকায় ২০০৪ সালেও ভয়াবহ আগুন লেগেছিলো। সেবারও হাজার হাজার মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছিলেন গ্যাসের চুলার আগুনে। মেইন লাইন থেকে প্লাস্টিক পাইপের মাধ্যমে এসব চুলার গ্যাস আসতো বাড়িগুলোতে। টিন ও কাঠের বাড়িগুলোতে গ্যাসের লাইন টানা হতো খোলামেলা ভাবে শূন্যে ঝুলিয়ে। এসব লাইন থেকে চিহ্নিত সিন্ডিকেট চুলাপ্রতি মাসে বিল নেয় ছয়শ’ টাকা করে।
এ ধরনের একটি লাইন থেকে মাস তিনেক আগেও আগুনের ঘটনা ঘটে বস্তির ৫ নম্বর গেট বাজার এলাকায়। সেবারের আগুনেও পুড়ে ছাই হয় হাজার খানেক বাড়ি ও কয়েক হাজার পরিবারের সহায়-সম্বল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
তিতাসের উপ-মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ শাজাহান বাংলানিউজকে জানান, কড়াইল বস্তিতে তাদের কোনো সংযোগ নেই। যদি কোনো সংযোগ থেকে থাকে, তা অবৈধ। কিছুদিন পর পরই তারা এসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নে অভিযান চালিয়ে থাকেন।
ফটো স্টোরি দেখতে এখানে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ২২২০ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৭
আরএম/এএসআর