এছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি ও উদ্বেগ কাজ করে। এসব কিছু যথাযথভাবে মোকাবিলা করেই দীর্ঘদিন ধরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে রাশিয়া।
সম্প্রতি বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট শামীম খান রাশিয়া ভ্রমণে যান। ভ্রমণকালে তিনি নবভরোনেস পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প ঘুরে আসেন। সে সময় তিনি এ ধরনের প্রকল্প পরিচালনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জনসাধারণের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের মিথস্ক্রিয়াসহ বিভিন্ন ব্যাপারে সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন, জানতে চান তাদের অভিজ্ঞতা।
শামীম খানের সঙ্গে কথা হয় নবভরোনেস প্রকল্পের সহযোগী পরিচালক তননা কডারিয়াসকভের। ২৫ বছর ধরে রেডিয়েশন নিয়ে এই প্রকল্পে কাজ করছেন তিনি।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্য ঝুঁকি ও তা নিরসনের ব্যাপারে জানতে চাইলে তননা জানান, নবভরোনেস কেন্দ্রে ব্যবহৃত ভিভিইআর-১২০০ রিয়্যাক্টরে দুর্ঘটনার কোনো আশঙ্কা নেই। এমনকি এর ফলে পরিবেশের ওপরও বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো বিরূপ প্রভাব নেই। তারপরও বিকিরণের মাত্রা গণনা ও তা নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে প্রতিবছর এখানে মাটি, পানি, বাতাস, কৃষিসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে প্রায় ৫৫ হাজার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। পরিবেশকে বিরূপ প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য বিকিরণ মাত্রার একটি নির্দিষ্ট পর্যায় থাকে। এখানে সবক্ষেত্রেই তা নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে রয়েছে।
এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, বিকিরণ, দূষণ ইত্যাদি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ কাজ করে, সেগুলোকে রাশিয়া কীভাবে মোকাবিলা করে জানতে চাইলে তননা বলেন, বিকিরণের পর্যায়সহ সার্বিক বিষয় জনসাধারণকে অবহিত করতে সংবাদমাধ্যমকে কাজে লাগানো হয়। প্রতিবছর এ সংক্রান্ত পত্রিকা ও পুস্তিকা বের করা হয়। জনসচেতনার জন্য সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়াতে সঠিক তথ্য তুলে ধরলে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকে না। এ জন্য সাংবাদিকদেরও পারমাণবিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনীয় ধারণা থাকা দরকার। এ জন্য প্রতিনিয়িত এ সংক্রান্ত সব কিছুর তথ্য-উপাত্ত মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করা হয়।
নবভরোনেস পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই রেফারেন্স প্ল্যান্ট ঈশ্বরদীর নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। রাশিয়ার মতনই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরতে ঈশ্বরদীতে শিগগিরই একটি মিডিয়া সেন্টার চালু করা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. সৌকত আকবর বাংলানিউজকে বলেন, এই প্রকল্প সম্পর্কে জনগণের কাছে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরার লক্ষ্যে আমরা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। ২০২০ সালের জানুযায়ি মাস থেকেই ঈশ্বরদীতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকন্দ্র সংক্রান্ত একটি মিডিয়া সেন্টার চালু করা হবে। এর জন্য ইতোমধ্যেই ভবনও ভাড়া নেওয়া হয়ে গেছে। নিজস্ব ভবন হলে পরে মিডিয়া সেন্টারটি সেখানে স্থানান্তর করা হবে। রূপপুর প্রকল্পের সীমানার বাইরে চারপাশে ৪০টির মতো মনিটরিং সেন্টার থাকবে। এরই মাঝে এসবের কাজ শুরু হয়ে গেছে।
সৌকত আকবর আরও বলেন, কোনো স্থানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের আগে সেখানে রেডিয়েশনের (বিকিরণ) মাত্রা যে পরিমাণ থাকে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর পরও তা একই মাত্রায় থাকতে হবে। পূর্বের চেয়ে বেশি হওয়া চলবে না। সারা বিশ্বেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এটা অপরিহার্য। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি আসার আগেই ২০২২ সালের মধ্যে এই মিনটরিং সেন্টার প্রস্তুত করা হবে।
এদিকে সূত্র জানায়, রূপপুর প্রকল্প পরিচালনায় সার্বিক দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের ২৫০ শিক্ষার্থী রাশিয়ার ন্যাশনাল রিসার্চ নিউক্লিয়ার ইউনিভার্সিটি ‘মেফি’তে(Moscow Engineering Physics Institute) পড়াশোনা করছেন। পাশাপাপশি ভিভিইআর-১২০০ রিয়্যাক্টর পরিচালনা শিখতে নবভরোনেসের কন্ট্রোল সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ১৪০ জন।
ভিভিইআর-১২০০ রিয়্যাক্টর সম্পর্কে জানতে চাইলে নবভরোনেসের উপ-প্রধান প্রকৌশলী ইগর গুসেভ জানান, এ রিয়্যাক্টরে প্রকল্পের লাইফ টাইমের (আয়ুষ্কাল) শতকরা ৯০ ভাগই উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। এই রিয়্যাক্টরের লাইফ টাইম ৬০ বছর। অটোমেশন সিস্টেমের কারণে এর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত সহজ। রাশিয়ার ৩জি(+) প্রজন্মের এ রিয়্যাক্টর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির রিয়্যাক্টর। এর আপডেট ভার্সন ভিভিইআর-১৫০০ উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা চলছে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিভিন্ন সুবিধার কথা উল্লেখ করে ইগর গুসেভ আরও বলেন, অন্য উৎসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের তুলনায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ কম। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের জ্বালানি হিসেবে কয়লা পরিবহনে যে ব্যয় হয় পরমাণবিক বিদ্যুতের জ্বালানি ইউরেনিয়াম পরিবহনে সেই খরচ হয় না। গ্যাসবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস আনতে হয়। সে জন্যও যথেষ্ট ব্যয় হয়। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুতের ক্ষেত্রে এসব খরচ নেই।
এছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা হয় নবভরোনেসের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তারা জানান, প্রথমে এর স্পান্ট জুয়েল (বর্জ্য) পুকুর বা জলাধারের পানিতে ৮/১০ বছর রেখে ঠাণ্ডা করা হয়। এরপর শক্ত লোহার সিলিন্ডারে ভরে মাটির নিচে সংরক্ষণ করা হয় তা। মাটির নিচে ১০০ থেকে ৩০০ বছর থাকলেও এই বর্জ্য মানুষ বা জীববৈচিত্র্যের কোনো ক্ষতি করবে না। বাংলাদেশে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য রাশিয়ায় নেওয়া হবে। এ বিষয়ে উভয়দেশের মধ্যে আন্তঃসরকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি অনুসারে রূপপুরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রাশিয়ার।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৯
এসকে/এইচজে