ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

বিদ্যুৎকেন্দ্র: বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে হাতিয়ায়

সোলায়মান হাজারী ডালিম,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১
বিদ্যুৎকেন্দ্র: বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে হাতিয়ায়

হাতিয়া (নোয়াখালী) থেকে ফিরে: দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বাসিন্দাদের। বিদ্যুৎ না থাকায় দ্বীপবাসী নির্ভরশীল কেরোসিনের বাতি ও সোলারের ওপর।

৫০০ কেবির একটি ইঞ্জিন জেনারেটর দিয়ে তেলের সাহায্যে নামমাত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে হাতিয়া দ্বীপে। সনাতনী পদ্ধতিতে সরকার প্রতি বছর ভর্তুকি দিলেও ঠিক মতো হাতিয়া পৌরবাসীকে আলোকিত করা যায়নি। দ্বীপের বাকি অংশ থাকছে অন্ধকারে।

অবশেষে দ্বীপবাসীর দীর্ঘদিনের এ ভোগান্তির অবসান হতে চলেছে। বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ১৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। যার মাধ্যমে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চেহারা পাল্টে যাবে দ্বীপের। আর্থ-সামাজিক অবস্থায় আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

সম্প্রতি হাতিয়ায় গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এনে রাখা হয়েছে মালামাল। হাতিয়া উপজেলা সদরের দক্ষিণে হরেন্দ্র মার্কেটের পাশে বালুর মাঠ এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এর আগে বিদ্যুৎ বিভাগ এই স্থানে ১৬ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে বালু ভরাট করেছে।

হাতিয়ার বিদ্যুৎ বিভাগের আবাসিক প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকা উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মশিউর রহমান জানান, হাতিয়ায় স্বাধীনতার পর বিদ্যুতের তেমন উন্নয়ন হয়নি। স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তান সরকার হাতিয়ায় ৫টি ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে শুরু করে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। কিন্তু অনেক পুরাতন ইঞ্জিনগুলো এখন অনেকটাই বিকল।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউসের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার তিনটি নতুন ইঞ্জিন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি কিছুটা সচল রাখে। বর্তমানে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে ১২শ’ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এতে শুধু পৌর এলাকার কিছু সংখ্যক মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। অন্যদিকে নিঝুমদ্বীপসহ হাতিয়ার ১১টি ইউনিয়নের মানুষ বিদ্যুতের এই সুবিধা থেকে বরাবরই ছিল বঞ্চিত।

সরকার হাতিয়ায় টেকশই বিদ্যুতায়নের চিন্তাভাবনা অনেক আগ থেকে শুরু করেছে। এজন্য মন্ত্রণালয়ের অনেকে একাধিকবার সার্ভেও করেন। সবশেষে ২০২০ সালের প্রথম দিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে হাতিয়া সফর করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি হাতিয়াতে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। এরপরই বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা হাতিয়াতে সার্ভে করা শুরু করেন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে কাজ অনেকটা থমকে যায়।

পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে  প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজের গতি ফিরিয়ে আনেন। এর পর পরই হাতিয়াতে শতভাগ টেকশই বিদ্যুৎ উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প নেয় সরকার। যার নাম দেওয়া হয় ‘হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন’ প্রকল্প।

প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩৮৪ কোটি ৩৬ লাখ ১৫ হাজার টাকা। গত ৩ ফেব্রুয়ারি একনেক সভায় তা অনুমোদন দেওয়া হয়। বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে। তবে প্রকল্পের প্রায় ১০ ভাগ কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কুতুবদিয়া দ্বীপে।

এ প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী ফারুক আহম্মেদ বলেন, সরকারের অনুমোদন দেওয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু বিতরণ বিভাগের উন্নয়ন করা হবে। উৎপাদনের জন্য চুক্তি করা হয় দেশ এনার্জি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির সঙ্গে। তারা প্রাথমিকভাবে ১৫ মেগওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন প্ল্যান্ট তৈরি করবে হাতিয়ায়। এতে ১৫ বছরের জন্য চুক্তি করা হয়েছে। যাদের কাছ থেকে প্রতি ইউনিট ১২ দশমিক ১০ সেন্টে কিনে নেবে সরকার।

তিনি আরো জানান, বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য সরকার ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে হাতিয়ায়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে হাতিয়াতে তিনটি নতুন ৩৩/১১ কেবি উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এছাড়া মূল হাতিয়ায় নতুন ৪৬৫ কিলোমিটার ও নিঝুম দ্বীপে ৪৭ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হবে। পুরাতন ২৫ কিলামিটার লাইন মেরামত করে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করা হবে। নিঝুম দ্বীপ হাতিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় হাতিয়ার মোক্তারিয়া ঘাট থেকে নিঝুম দ্বীপ খাল পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার ১১ কেবি সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করা হবে। এছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় অফিস ভবন কাম রেস্ট হাউজ, ডরমিটরি, সীমানা দেয়াল নির্মাণ করা হবে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদনের দায়িত্বে থাকা দেশ এনার্জি লিমিটেডের সিনিয়র প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন জানান, হাতিয়াতে ১৫ মেগওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকারের সাথে চুক্তি হয়েছে। এই জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ হাতিয়ার হরেন্দ্র মার্কেট এলাকায় ৫ একর জায়গা দিয়েছে কোম্পানিকে। সেখানে মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। এখানে ১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন হেভি ফুয়েল ওয়েল (এইচএফও) ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে।

এ ব্যাপারে হাতিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাহবুব মোর্শেদ লিটন বলেন, হাতিয়াবাসীর স্বপ্ন ছিল হাতিয়াতে শতভাগ বিদ্যুতায়ন হবে, আজ তা বাস্তবায়ন হচ্ছে। দ্বীপবাসী সরকারের কাছে এর জন্য বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ থাকবে।

বৈপ্লবিক পরিবর্তন:
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে জীবনযাত্রার ব্যাপক পরিবর্তন আসবে হাতিয়াবাসীর। দ্বীপটিতে স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে পোশাক শিল্পকারখানা, কোল্ড স্টোরেজ, জেলেদের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির কারখানাসহ ছোট বড় অনেক প্রতিষ্ঠান। যার সুফল ভোগ করবে দ্বীপের ৬ লক্ষাধিক মানুষ।

বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রফিকুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগের ফলে এখানকার আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যাপক পরিবর্তন হবে, বিকশিত হবে পর্যটন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১ 
এসএইচডি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।