ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সালতামামি

সালতামামি ২০২৩

আদিলুরের দণ্ডে আলোচনা, সেঞ্চুরি পেরিয়েও ঝুলছে সাগর-রুনি ইস্যু

খাদেমুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩
আদিলুরের দণ্ডে আলোচনা, সেঞ্চুরি পেরিয়েও ঝুলছে সাগর-রুনি ইস্যু

ঢাকা: ২০২৩ সালে ঢাকার নিম্ন আদালতে বেশ কয়েকটি আলোচিত মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। যার মধ্যে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে সাজার ঘটনায় দেশ ও বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

এছাড়াও এ বছর দুর্নীতি মামলায় আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার, পুলিশের বরখাস্ত উপমহাপরিদর্শক মিজানুর রহমানসহ বেশ কয়েকজনকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তবে আগের বছরের মতোই সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলাসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় প্রতিবেদনই দাখিল হয়নি। ২০২৩ সালে ঢাকার নিম্ন আদালতের উল্লেখযোগ্য এসব ঘটনা নিয়ে সালতামামির এই পর্ব।

আদিলুর-এলানের কারাদণ্ড: এক দশক আগে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে হওয়া প্রথম মামলায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও সংগঠনটির পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। গত ১৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত এ রায় দেন। রায় পর্যবেক্ষণে আসেন অনেক বিদেশি পর্যবেক্ষক। কারাদণ্ডের রায়ের পর ইউরোপীয় পার্লামেন্টসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন আদিলুরের মুক্তি দাবি করে। দেশে-বিদেশে তৈরি হয় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া।

২০১৩ সালের ৫মে হেফাজতের শাপলা চত্বরে সমাবেশে ৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। একই বছর ১০ আগস্ট গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ডিবির উপপরিদর্শক আশরাফুল ইসলাম। ওইদিনই গ্রেপ্তার হন অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান। ওই বছরের ৯ অক্টোবর হাইকোর্ট থেকে জামিন পান তিনি আদিলুর। তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ৩২ জনকে সাক্ষী করে আদিলুর ও এলানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ৮ জানুয়ারি মামলাটিতে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচারকাজ শুরু হয়।

প্রথমবার দণ্ডিত পিকে হালদার: গ্লোবাল ইসলামী (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের অর্থপাচার নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশে বেশ আলোচনা চলছে। তার বিরুদ্ধে ডজনের বেশি মামলা হয়েছে। তবে গত ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের আদালতে প্রথম দণ্ডিত হন তিনি। ভারতের কারাগারে বন্দি থাকা পিকে হালদারকে ৪২৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং তা পাচারের অভিযোগে ২২ বছর কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে-১০ এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম।

পিকে হালদার ২০০৮ সালে আইআইডিএফসির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে তিনি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন।   ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান- পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেড, এফএএস ফাইন্যান্স এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন পিকে হালদার ও তার সহযোগীরা। গত বছর ১৪ মে কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়ে সেখানেই বন্দি আছেন তিনি।

স্ত্রীসহ দণ্ডিত ডিআইজি মিজান: অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচার আইনের মামলায় বরখাস্ত পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানকে পৃথক তিন ধারায় ১৪ বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। এছাড়া তার স্থীসহ অপর তিনজনকে ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। গত ২১ জুন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক মঞ্জুরুল ইমাম এ রায় দেন। এর মাধ্যমে ঘুষ লেনদেনের পর দ্বিতীয় কোনো মামলায় দণ্ডিত হন তিনি।

২০১৯ সালের ২৪ জুন দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (ঢাকা-১) দুদকের পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদ বাদী হয়ে ডিআইজি মিজানসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ২৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ৩ কোটি ৭ লাখ ৫ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়। ২০২০ সালের ১ জুলাই শাহবাগ থানা পুলিশ মিজানকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান আদালত।

জিকে শামীমের কারাদণ্ড: ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সময় আলোচনায় আসা কথিত যুবলীগ নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমকে গুলশান থানার মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় ১০ বছর ও তার সাত দেহরক্ষীকে ৪ বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। গত ১৭ জুলাই ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০ এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম এই রায় দেন। এছাড়া তাদের সম্মিলিতভাবে ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৩৫ হাজার ৮১৪ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত।

২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দুপুরে নিকেতনের নিজ বাসা থেকে শামীমকে আটক করা হয়। এ সময় জিকে শামীমের কাছ থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকার এফডিআর চেকসহ বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি টাকা জব্দ করা হয়। তার কাছ থেকে একটি অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার পর র‌্যাব-১ এর নায়েব সুবেদার মিজানুর রহমান ২১ সেপ্টেম্বর গুলশান থানায় মামলাটি দায়ের করেন।

দণ্ডিত এনু-রূপন: ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সময় বেশ আলোচনায় আসেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের পরিচালক ও গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু এবং তার ভাই থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন ভূঁইয়া। সেই আলোচিত দুই ভাইকে গত ২৮ নভেম্বর বংশাল থানার মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন ২৮ নভেম্বর ঢাকার বিশেষ জজ-৮ এর বিচারক মো. বদরুল আলম ভূঞা। এর আগে ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল ওয়ারী থানার মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় আরেক মামলায় এনু-রুপনসহ ১১ জনকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। এটি ছিল তাদের বিরুদ্ধে একই অপরাধে দ্বিতীয় রায়।

ঝুলে আছে যেসব মামলা

সাগর-রুনি হত্যা: ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি তাদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। এই মামলায় বিভিন্ন সংস্থার ডজন খানেক কর্মকর্তা ১০৪ বার সময় নিয়েও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি।  

ফারুকী হত্যা: ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট টেলিভিশনে ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী খুন হন। ওইদিন এশার নামাজের পর পূর্ব রাজা বাজারের নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তরা বাসায় ঢুকে স্ত্রী-ছেলেসহ তিন স্বজনের হাত-পা বেঁধে ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করে। ওই ঘটনায় পরে তার ছেলে ফয়সাল ফারুকী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় এক‌টি হত্যা মামলা করেন। দীর্ঘ নয় বছরে একাধিক সংস্থা তদন্ত করেও দাখিল করতে পারেনি প্রতিবেদন। বর্তমানে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডিতে আছে।

সুরাহা হয়নি রিজার্ভ চুরির মামলা: ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়ে যায়। পরে হ্যাকার গ্রুপ অর্থপাচারের মাধ্যমে ওই টাকা ফিলিপাইনে পাঠিয়ে দেয়। অর্থ চুরির এ ঘটনায় ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের উপ-পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা মতিঝিল থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা করেন। মামলাটি সাত বছর ধরে তদন্ত করছে সিআইডি। এরই মধ্যে ৭৫ বারের মতো সময় নিয়েও প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি সংস্থাটি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩
কেআই/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।