ঢাকা: ২০১৮ সাল। শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির সব কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে।
তিন বছর পর ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল জারি করেন। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে চলতি বছরের ৫ জুন রায় দেন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
রায়ে কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে কোটা বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব, আদেশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে পরিপত্র জারি করতে নির্দেশ দেন।
এরপর জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কার চেয়ে নতুন করে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। প্রথম কয়েক দিন মিছিল, মানববন্ধনের মতো সাধারণ কর্মসূচি থাকলেও পরে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে শুরু হয় অবরোধ কর্মসূচি।
আন্দোলনকারীরা শুরুতে চার দফা দাবিতে বিক্ষোভ করলেও পরে তাদের দাবি এক দফায় এসে ঠেকে। শিক্ষার্থীদের দাবিতে বলা হয়, সব গ্রেডে সব ধরনের ‘অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক’ কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ‘ন্যূনতম পর্যায়ে’ এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতি সংশোধন করতে হবে৷
প্রথম দিকে রাষ্ট্রপক্ষ এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন না করলেও আন্দোলনের মাত্রা বাড়ার পর আবেদন করে। কিন্তু আপিল বিভাগ তাতে সাড়া দেননি। বাড়তে থাকে আন্দোলনের তীব্রতা। ১০ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেন। পরদিন হাইকোর্টের রায়ের আদেশ অংশ প্রকাশিত হয়। তিন দিন পর ১৪ জুলাই প্রকাশিত হয় পূর্ণাঙ্গ রায়।
এরপরও আন্দোলনকারীরা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকেন। গত ১৪ জুলাই ‘সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি আদালতেই ফয়সালা করতে হবে’ বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া ‘রাজাকার’ সংক্রান্ত তার একটি বক্তব্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আরও চাঙ্গা করে তোলে। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ছাত্রলীগ কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে।
এ ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সারা বাংলার ছাত্র সমাজ। ১৬ জুলাই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে পুলিশ গুলি চালায় এবং ছাত্রলীগ হামলা করে। রংপুরে প্রাণ হারান রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ ছয়জন। পরদিনও বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ। যোগ দেয় যুবলীগ, কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সরকার সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেয়।
১৭ জুলাই সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং সন্ত্রাসীরা এদের মধ্যে ঢুকে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। ’ তিনি দেশজুড়ে সংঘাতের বিচারবিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দেন ও সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। ছাত্রসমাজ ন্যায়বিচার পাবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন, সে কথাও উল্লেখ করেন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানে সাড়া না দিয়ে গত ১৮ জুলাই সারা দেশে ‘শাটডাউনের’ ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারীরা। তাদের এ কর্মসূচিতে প্রায় অচল হয়ে পড়ে সারা দেশ। বিভিন্ন স্থানে নিহত হন ৪১ জন। সেদিন দুপুরে এক ব্রিফিংয়ে এসে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আন্দোলনকারীরা যখন চাইবে, তখনই তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সরকার প্রস্তুত। কোটা সংস্কারের বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে একমত। কোটা নিয়ে পরিপত্র বাতিলের হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার যে আপিল করেছে, তার শুনানি এগিয়ে আনা হয় ২১ জুলাই।
পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, কয়েক দিনের সংঘাত ও প্রাণহানির সার্বিক ঘটনা তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করতেও প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করা হবে বলে জানান আনিসুল। তার এ ব্রিফিংয়ের পরও আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে সরকার মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। ফলে সামাজিক ও সাধারণ যোগাযোগ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাংলাদেশ।
১৮ জুলাই সারা দেশেই ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। এদিন দিবাগত রাত ১২টা থেকে পুরো দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। সেনাবাহিনী মাঠে নেমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। কারফিউর মধ্যেই আদালত বসে। ২১ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করেন। ঠিক করে দেন কোটা ব্যবস্থার নতুন বিন্যাস। আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনার সন্তানের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত থাকবে। বাকি ৯৩ শতাংশ পদে নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। সরকার অবিলম্বে গেজেট জারি করে এ নির্দেশনা কার্যকর করবে।
সেই গেজেট জারিও হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এটি প্রত্যাখ্যান করে। সরকারবাহিনী দ্বারা সারা দেশে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চরমে পৌঁছে যায়। সাধারণ জনতাও অকাতরে জাতির প্রয়োজনে এক হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রূপ নেয় গণ অভ্যুত্থানে। গত ৩-৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলন ও শহীদ মিনার থেকে সরকার পতনের ডাক ঘরে ঘরে স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়। ৫ আগস্ট বাংলাদেশের মানুষ অবিচার-হত্যার প্রতিবাদে নামেন রাস্তায়। তারপরই প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন শেখ হাসিনা। পালিয়ে যান ভারতে। পরে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেন। ৮ আগস্ট সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত নিয়ে অন্তর্বতী সরকার শপথ নেয়। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪
ইএস/এমজে