কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু, পরে গণঅভ্যুত্থান, প্রাণকেন্দ্রে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিদায়ী ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পতন হয় ফ্যাসিস্ট ও একনায়ক শেখ হাসিনার।
অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
চলতি বছরের জুন মাসে হাইকোর্টের একটি রিটের ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে আসে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। পরে দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও নিজ ক্যাম্পাসে আন্দোলন গড়ে তোলেন।
একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও ছাত্রদের গুলি করে হত্যার কারণে আন্দোলনটি কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। পরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাসহ তার দলীয় সঙ্গীদের অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
আন্দোলনের শুরু থেকে নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন তারা। সেখানে সমম্বয়ক হিসেবে নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী হাসনাত আব্দুল্লাহ, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আব্দুল কাদের, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী উমামা ফাতেমা, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী সারজিস আলম, ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী আবু বাকের মজুমদার, বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহিন সরকার, ইংরেজি ভাষা (ইএসওএল) বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল হান্নান মাসউদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত তাবাসসুম, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের রাফিয়া রেহনুমা হৃদি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী রিফাত রশীদ প্রমুখ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক যখন ডিবি অফিসে বন্দি, তখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাদের, মাহিন, মাসউদ ও রিফাত রশীদরা কর্মসূচি ঘোষণা চালিয়ে যান। পরে ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে এক দফা ঘোষণা করেন নাহিদ ইসলাম। এরপর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ঘটে।
ঢাবি প্রশাসনে বড় রদবদল
অভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল পদত্যাগ করলে ৩০তম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান নিয়াজ আহমেদ খান। উপ-উপাচার্য পদ থেকে নীল দলের সীতেশ চন্দ্র বাছারকে সরিয়ে মামুন আহমেদ এবং মুহাম্মদ সামাদকে সরিয়ে সায়মা হক বিদিশাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্রক্টর মাকসুদুর রহমানসহ পুরো প্রক্টরিয়াল বডি পদত্যাগ করলে নতুন করে প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পান সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমেদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডিতে আরও ১৫ জন শিক্ষককে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত তিন সদস্যকে বাদ দিয়ে নতুন করে তিনজন সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ‘ল অ্যান্ড রিভিউ কমিটির’ সুপারিশে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক পদের প্রতিনিধিদের বাদ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় এ আসনগুলো পূরণ হবে।
১১২ দিন বন্ধ ছিল শ্রেণী কার্যক্রম
গ্রীষ্মকালীন ছুটি, শিক্ষকদের সার্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে ১১২ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ ছিল। ১ জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে। শেষে বিগত সরকার পতনের আগে স্কিমটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত জানায়। এরপর কোটা সংস্কার চেয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরবেন না বলে ঘোষণা দেন। নতুন উপাচার্য নিয়োগ হওয়ার পর সিন্ডিকেট সদস্যের সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীরা পুনরায় ক্লাসে ফেরেন।
হলছাড়া ছাত্রলীগ
দীর্ঘ ১৫ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্যে ছিল ছাত্রলীগ। পুরোটা সময়জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে তারা একক দখলদারত্ব বজায় রাখে। সিট দখল, গণরুম বাণিজ্য, ছাত্রদের জোরপূর্বক দলীয় অনুষ্ঠানে নিয়ে তারা শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ধ্বংস করেছিল। এ ছাড়া বিরোধী মত দমনে অনেক শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করে হল থেকে বের করে দেয় ছাত্রলীগ।
তবে অভ্যুত্থানের আগে আগেই শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ সদস্যদের হল থেকে বের করে দেয়। বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগের আধিপত্যের অবসান ঘটে। ১৬ জুলাই রাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগের নেতারা পালাতে থাকেন। ১৭ তারিখের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারায় ছাত্রলীগ।
শিক্ষার্থীরা প্রভোস্টের মাধ্যমে হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু ১৭ জুলাই দুপুরের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয় এবং ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।
গণরুম-গেস্টরুম মুক্ত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষার্থীদের সিট দখল করে তাদের গণরুমে রাখার প্রথা চলে আসছিল। ছাত্রলীগের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের ১২২টি গণরুমে দুই হাজারের অধিক শিক্ষার্থীকে থাকতে হতো। এই গণরুমে থাকতে তাদেরকে নিয়মিত রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যেতে হতো। রাতে আবার শিকার হতে হতো গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার। পরে চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির এক সভায় গণরুম প্রথা বিলুপ্ত করেন উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান।
গণত্রাণ কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া
৫ আগস্টের পর দেশের দক্ষিণাঞ্চল বন্যার কবলে পড়ে। অনেকেই একে ‘রাজনৈতিক’ বন্যা বলে আখ্যায়িত করেন। শিক্ষার্থীরা বন্যায় মানুষের পাশে থাকার জন্য গণত্রাণ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ২১ আগস্ট গণত্রাণ কর্মসূচি শুরু হয়। এ সময় সাধারণ মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কেউ নিয়ে আসেন শুকনো খাবার, কেউ জামা; কেউবা নগদ অর্থ।
টিএসসিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা ত্রাণ কার্যক্রমে সেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। টিএসসির এই ত্রাণ কার্যক্রমে ১১ কোটি ৬৯ লাখ ৮৪ হাজার ৪২০ টাকা ওঠে। সেখান থেকে কিছু অর্থ তখন ব্যয় করা হয়। পরে উত্তরবঙ্গের বন্যার্তদের সহায়তায় কিছু টাকা ব্যয় করা হয়। বাকি আট কোটি টাকা বন্যার্তদের পুনর্বাসনে সরকারের ত্রাণ তহবিলে হস্তান্তর করা হয়।
র্যাংকিংয়ে ৫৫৪তম ঢাবি
এ বছর আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে প্রথমবারের মতো ৬০০-র ঘরে প্রবেশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন স্বীকৃত জার্নালে শিক্ষকদের গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশে অনুদান প্রদান, বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পরিচয় ও যোগাযোগ বাড়ানো এবং গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধে নীতিমালা প্রণয়নসহ একাধিক উদ্যোগের কারণে র্যাংকিংয়ে এগোয় এই বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪
এফএইচ/আরএইচ