ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সালতামামি

জীবনের আর্তনাদ ‘ঐশী’

নুরুল আমিন ও আদনান রহমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩
জীবনের আর্তনাদ ‘ঐশী’ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম/ফাইল ফটো

ঢাকা: ঐশী! ২০১৩ সালের দেশের আবহে একটি বহুল আলোচিত নাম। বাবা-মাকে ‘নিজ হাতে’ খুন করে দেশজুড়ে চাঞ্চল্যকর ও মর্মাহত ঘটনার জন্ম দেয় পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদশর্ক মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমান দম্পতির একমাত্র মেয়ে।



মেয়ের বেপোরোয়া ও উশৃঙ্খল জীবনে বাধা দেওয়ার কারণেই গত ১৬ আগস্ট রাজধানীর চামেলীবাগের নিজ ফ্ল্যাটে এ দম্পতি খুন হয়েছেন বলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা।

নিজ মেয়ের হাতে মাহফুজ ও স্বপ্না খুন হওয়ার সঙ্গে নতুন করে আলোচনায় আসে ভয়ংকর মাদকদ্রব্য ‘ইয়াবা’। পুলিশের অনুসন্ধান, ঐশী ইয়াবা আসক্ত। এ মরণ নেশাই কাল হয়ে দাঁড়ায় আইনের রক্ষক এ পুলিশ দম্পতির। ইয়াবার কারণেই বাবা-মায়ের সঙ্গে ঐশীর সাপে–নেউলে সর্ম্পক সৃষ্টি হয়, পরিণতিতে খুনে।

একমাত্র মেয়ে ঐশীকে ঘিরে স্বপ্ন ছিল বাবা-মার। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে তাকে ভর্তি করেন ধানমন্ডির ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনালে। এখানে ভর্তি হয়েই পাল্টাতে থাকে ঐশী। অগাধ টাকায় গা ভাসিয়ে দেওয়া উচ্ছৃঙ্খল বন্ধুদের সঙ্গে বেপরোয়া জীবনযাপন, অনিয়ণ্ত্রিত প্রেম ও মাদক সেবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে সে। আর তাতে বাধা পেয়েই নিজের পিতা মাতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বলে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।

চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা দেশবাসিকে নতুন করে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কঁচিকাঁচা শিশুরা আসলে কি শিখছে। সেখানে কী আদর্শিক শিক্ষাটা ঠিকমতো পাচ্ছে।

পুলিশের অনুসন্ধানে জানা যায়, ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে মা স্বপ্না রহমানকে কুপিয়ে ও পরে পিতার গলায় খঞ্জর চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে ঐশী। পেছন থেকে মন্ত্রণা দেয় ঐশীর বন্ধু রনি ও জনি।

ঐশীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে। পেছনের সারির ছাত্রী সেখানে ভাল ফল না করায় স্কুল পরিবর্তন করে বাবা-মা। ভর্তি হয় অক্সফোর্ড স্কুলে। বাবা-মায়ের বড় মেয়ে ঐশীকে তার সব আবদার পূরণ করার সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন। যা চাইতেন তাই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বাবা-মা।

কিন্তু অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তির পরই ঐশীর আচার ও জীবনযাপনে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে বলে জানা যায় ঐশীর পারিবারিক সূত্রে। সালোয়ার কামিজ ও স্কার্ফ ছেড়ে পাশ্চাত্য ঢঙের পোশাক পরা শুরু করে।

এরপর খোলামেলা পোশাকে ছেলে বন্ধু ও প্রেমিকের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতো। এ কারণে কখনো কখনো তার মা বকাঝকা করতেন। স্কুলের কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে কখনও গভীর রাতে বাসায় ফিরতো। স্কুল ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিতো ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে। যোগ দিতো ইয়াবা ও গাঁজার আসরে। নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয় ডিজে ও ড্যান্স পার্টিতে। শুধু তাই নয়, পার্টিতে অংশ নেওয়া বন্ধু মহলে যাকে ভাল লাগতো, তার সঙ্গেই অন্তরঙ্গ সময় কাটাতো।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এসব পার্টি ও আড্ডার আসরে পরিচয় হয় পুরান ঢাকার ডিজে জনির সঙ্গে। তার সঙ্গে কিছু দিন মেলামেশার পর তারই বন্ধু রনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ঐশীর। এ রনি ও জনির হাত ধরেই নেশার জগতে পা বাড়ায় ঐশী। নিয়মিত মাদক গ্রহণের সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত যৌনাচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঐশীর ডজনখানেক ছেলেবন্ধু ছিল। তাদের সঙ্গে নিয়মিত বিভিন্ন পার্টিতে অংশ নিতো। এর বাইরে তার আরও একজন প্রেমিক ছিল। তার নাম পারভেজ। মূলত এ পারভেজের নির্দেশনা মোতাবেক ঐশী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।
 
গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী জানায়, গত ৩১ জুলাই তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় মা। তারপর থেকে বন্ধু মহলের সঙ্গে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে সে। এ সময় থেকে পিতামাতাকে তার কাছে শক্র মনে হতে থাকে। কখনো নিজেকে শেষ করা আবার কখনো বাবা-মাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আটতে থাকে।

এক পর্যায়ে ঐশী ১২ পৃষ্ঠার সুইসাইডাল নোট লিখে বাসায় রেখে দেয়। লাশ উদ্ধারের পর বিভিন্ন আলামতের সঙ্গে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ঐশীর হাতের লেখা ওই চিঠি উদ্ধার করেছে। সেখানে তার জীবনের সুখ, দুঃখ ও কষ্টের কথা প্রকাশ করেছে।

নিজেকে খারাপ প্রকৃতির মেয়ে হিসেবে দাবি করার সঙ্গে কেউ তার কষ্ট বুঝতে চায়নি বলেও দাবি করেছে। আর এ কারণেই আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেছে। অবশ্য ঐশী আত্মহত্যা না করে পিতা-মাতাকেই হত্যা করেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, মাদক সেবনে অভ্যস্ত হওয়ায় ঐশী মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। ফলে পিতা-মাতার মতো সবচেয়ে কাছের মানুষজনকে এত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে পেরেছে।

গোয়েন্দারা জানান, নিজের পিতা-মাতাকে খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি ঐশী। নিথর ও রক্তাক্ত মায়ের শরীর থেকে গহনাও খুলে নিয়েছে। রান্নাঘর থেকে বঁটি এনে স্বপ্না রহমানের কোমরে থাকা বাসার চাবির গোছা কেটে নেয়। এরপর একে একে কানের দুল, গলার চেইন, হাতের বালা ও নাকফুল খুলে নেয়। আলমারিতে রক্ষিত আরও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে ব্যাগে ভরে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

সূত্র জানায়, ১৬ আগস্ট দিবাগত রাত ২টার দিকে ঐশী একাই তার পিতা-মাতাকে কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যার আগে সন্ধ্যার পর মার জন্য তৈরি করা কফিতে ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে দেয়। মা ঘুমিয়ে পড়লে তার সঙ্গেই শুয়ে থাকে ঐশী।

এরপর ঠিক রাত ১১টার পর তার পিতা বাসায় ফিরলে তাকেও ঘুমের ট্যাবলেট মিশ্রিত কফি খেতে দেয়। তিনিও ঐশীর বেডরুমে ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর রাত ২টার দিকে ঐশী খঞ্জর টাইপের একটি ধারালো ছুরি নিয়ে ঘুমন্ত মায়ের ওপর হামলে পড়ে। প্রথম কোপেই তার মা জেগে ওঠেন। নিজ মেয়ের এমন বর্বরতা দেখে বলতে থাকেন ‘তুই আমার মেয়ে না?’ তাই বলে ঐশীর ছুরি থামেনি। এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন মা।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ছোট ছেলে ঐহী মায়ের সঙ্গেই ঘুমিয়ে ছিল। হত্যাকাণ্ডের সময় সে জেগে ওঠে। তখন ঐশী তাকে ধরে নিয়ে বাথরুমে আটকে রাখে। এরপর পিতার গলায় খঞ্জর চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

পরে কাজের মেয়ে সুমির সহায়তায় তাদের লাশ কাপড়ে মুড়িয়ে টেনেহিঁচড়ে বাথরুমে নিয়ে ফেলে রাখে। দুজনে মিলেই রক্তাক্ত ঘর ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে। এরপর নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ব্যাগে ভরে ছোট ভাই ঐহী ও কাজের মেয়েকে নিয়ে বাইরে যায়।

সূত্র আরও জানায়, হত্যার পরের দিন রাতে তার বান্ধবী তৃষার বাসায় ছিল ঐশী। পরের দিন বন্ধু রনির এক খালার বাসায় অবস্থান করে। ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় ঢাকার চামেলীবাগের একটি ফ্ল্যাট থেকে মাহফুজ ও স্বপ্নার ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দুই সন্তান ঐশী ও ঐহী এবং গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন তারা। এর দুই দিন পর পল্টন পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করে ঐশী।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ জানান, নিহত পুলিশ কর্মকর্তার দেহে ছুরিকাঘাতের দুটি এবং তার স্ত্রীর দেহে ১১টি চিহ্ন পাওয়া গেছে। হত্যার আগে পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজ ও তার স্ত্রীকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় ঐশী।

বাবা-মা খুনের পর প্রশ্ন ওঠে ঐশীর বয়স নিয়ে। তাকে কিশোর সংশোধনাগারে রাখা হবে কি-না কারাগারে-এমন প্রশ্নে কয়েক দফা পরীক্ষার পর প্রমাণ মেলে ঐশী প্রাপ্ত বয়স্ক। পরে তাকে কারাগারেই পাঠানো হয়।

ঐশীর কাণ্ডের পর ফেঁসে যায় কাজের মেয়ে সুমি। ঐশীর স্বীকারোক্তিই বেরিয়ে আসে সুমি এ কাজে জড়িত ছিল না। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীদের নানা প্রশ্নের মুখে সুমি এখনো কারাগারে।

ঐশী এখন গাজীপুর কাশিমপুর কারাগারে। সে বাবা-মা হত্যা মামলার আসামি। মামলার তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ (দক্ষিণ বিভাগ)। তার মানসিক অবস্থা যাচাইয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনা চলছে ঢাকা মেডিকেল কলেজে।

কিন্তু অল্পবয়সী এ মেয়েটি কেন এ কাজ করেছিল, তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের নানা প্রশ্ন আছে। কেন ঐশী এমন বেপরোয়া হলো, কেন তাকে এতো টাকা দেওয়া হতো, পুলিশ পরিদর্শকের মতো এতো ছোট কর্মকর্তা কীভাবে এতো টাকার যোগান দিতেন, তার টাকার উৎস কি, ঐশীর এমন বেপরোয়া হওয়ার পেছনে বাবা-মার কতোটা ভূমিকা ছিল, ঐশীর বাঁচার জন্য তার নিজের কোনো জায়গা ছিল বাবা-মার কাছে, শহুরে ইট-কাঠ-পাথরের ঘরের বাইরে ঐশীর নিজের জায়গাটা কোথায় ছিল, সামনে যার দিগন্ত বিস্তৃত পৃথিবী, সেই মেয়েটার জন্য দৃষ্টি সীমানটা কতটা প্রসারিত ছিল, তার নিজের কোনো জানালা বিস্তৃত ছিল কী এ সুন্দর পৃথিবীটা দেখার জন্য-এমন অনেক প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে এখনো।

এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না। হয়তো ঐশীর যাবজ্জীবন কারাবাস হবে। সে যখন বেরিয়ে আসবে তখনো তার সামনে থাকবে এক বিশাল জীবন। সেই জীবনটা তার কাছে কতটা প্রাণময় হয়ে উঠবে, আদৌ কখনো উঠবে তো!

বাংলাদেশ সময: ১৩৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩
সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।