ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৯ মে ২০২৫, ০১ জিলহজ ১৪৪৬

সারাদেশ

লক্ষ্মীপুরে এক বছরে পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক শিশু

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১:০৯, মে ২৮, ২০২৫
লক্ষ্মীপুরে এক বছরে পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক শিশু লক্ষ্মীপুরের মানচিত্র

লক্ষ্মীপুর: মায়েদের সঙ্গে নানার বাড়িতে বেড়াতে আসে শিশু নাজিম হোসেন ও জিহাদ হোসেন। উঠোনে খেলা করছিল তারা।

পরক্ষণেই তাদের মরদেহ পাওয়া যায় পুকুরের পানিতে। সম্পর্কে তারা দুইজন ছিল খালাতো ভাই। বয়স আড়াই থেকে তিন বছরের মধ্যে।  

গত ১৫ মে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাঞ্চানগর এলাকায় এমন দুর্ঘটনায় পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজনদের কাঁদিয়ে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছে তারা। যেখানে এ দুই শিশুর পদচারণায় নানা বাড়ি আলোকিত হয়ে থাকতো, সেখানে তাদের অকাল মৃত্যুতে পুরো এলাকা শোকের ছায়ায় ডেকে গেছে।  

এর আগের দিন ১৪ মে বিকেলে জেলার কমলনগরের চর লরেন্স ইউনিয়নের উত্তর চর লরেন্স গ্রামে আল-আমিন নামে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশু পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায়।  

গত ১৭ মে জেলার রায়পুরের বামনী ইউনিয়নের বাঁশতলি নামক স্থানে সিমি নামে দুই বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে।  

গেল ২৩ ডিসেম্বর সদর উপজেলার দক্ষিণ হামছাদী ইউনিয়নের হামছাদী গ্রামে শিশু হাফসা ও তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের আঁধারমানিক গ্রামে শিশু সোহাগ পানিতে ডুবে মারা যায়।

এসব শিশুরা বাড়ির উঠোনে খেলা করার সময় পরিবারের লোকজনের অগোচরে ঘরের পাশে থাকা পুকুরের পানিতে পড়ে যায়। জীবন শুরুর আগেই জীবন প্রদীপ নিভে যায় তাদের।  

লক্ষ্মীপুরে ব্যাপকহারে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও প্রাণহানি ঘটছে এইসব কোমল প্রাণের। বসতবাড়ির আশপাশে থাকা পুকুর, ডোবা, নালাতে পড়ে প্রাণ জহারাচ্ছে শিশুরা।  

অভিভাবকদের অসচেতনতা, বেখেয়ালিপনা ও শিশুদের সাঁতার না জানার কারণেই এমন মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।  

স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেব মতে, জেলাতে গত এক বছরে পানিতে ডুবে ১১১ জন শিশু মারা গেছে। তবে বেসরকারি হিসেব মতে মৃত্যুর সংখ্যা দুই শতাধিক ছাড়িয়ে যাবে।  

পানিতে পড়া বেশির ভাগ শিশুই হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই মারা যায়।  

চিকিৎসকরা বলছে, পাঁচ মিনিটের মতো পানিতে ডুবে থাকলেই শিশুর মৃত্যু হয়। মৃত অবস্থায়ই বেশির ভাগ শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) অরূপ পাল বলেন, বসতবাড়ির আশপাশে অরক্ষিতভাবে ডোবা বা পুকুর থাকার কারণে শিশুরা খুব সহজেই পানিতে পড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে এবং ডোবা-পুকুর পাড়ে ব্যারিকেট দিলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।  

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গেল বছরের মে থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত জেলাতে পানিতে ডুবে ১১১ জন শিশুর মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি মে মাসে আরও চারজন শিশু পানিতে পড়ে মারা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। পানিতে পড়া যে সব শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, ওইসব শিশুর মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড করা হয়। কিন্তু এর বাহিরে আরও অনেক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়, যাদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় না। ফলে পানিতে পড়ে শিশুর মৃত্যুর সংখ্যা দুই শতাধিক ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।  

হাসপাতালের হিসাব অনুযায়ী, এক বছরে জেলা সদর হাসপাতালে ৩৫ জন, রামগতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ জন, কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৭ জন রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৫ জন এবং রামগঞ্জে ২৪ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে।  

একই দুর্ঘটনায় একই সঙ্গে দুই বা তিন শিশুর মৃত্যুর ঘটনাও অহরহ ঘটছে। একসঙ্গে খেলা করতে গিয়ে এমন দুর্ঘটনার শিকার হয় তারা। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি শিশু পানিতে পড়ে গেলে সঙ্গে থাকা অপর শিশু তাকে রক্ষা করতে গিয়ে কিংবা না বুঝেই পানিতে নেমে পড়ে। এতে দু'জনেরই প্রাণ যায়।  

২০২৪ সালের ১১ মে রামগতি উপজেলার চর বাদাম এলাকায় একটি গর্তে পড়ে ডুবে গিয়ে দুই ভাই-বোনের মৃত্যু হয়। নিহত শিশুরা হলো তাহিয়া আক্তার (৫) ও তার ভাই মো. আবদুল্লাহ (৩)। ঘরের পাশে পাকাভবন নির্মাণে পিলারের জন্য খোঁড়া গর্তে জমে থাকা পানিতে পড়ে এমন নির্মম ঘটনার শিকার হয় তারা। একজন পড়ে যাওয়ার পর আরেকজন তাকে বাঁচাতে গিয়ে দুইজনেরই প্রাণ যায়।

২০১৮ সালের ১৭ আগস্ট সদর উপজেলার দালাল বাজার মহাদেবপুর এলাকায় পুকুর পাড়ে খেলতে গিয়ে তিন শিশু পানিতে পড়ে মারা যায়। নিহত শিশুরা হলো বায়েজিদ (৭),  মো. আলী (৬) ও  ইয়ামিন (৭)। এদের মধ্যে দুইজন একই পরিবারের সদস্য। স্বজনদের ধারণা, একটি শিশু পড়ে যাওয়ার পর তাকে বাঁচাতে গিয়ে পর পর আরও দুই শিশু পানিতে নেমে পড়ে।  

গেল ১০ জুলাই রামগতিতে একই দিনে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পৃথক স্থানে চার শিশু পানিতে ডুবে যায়। তাদের মধ্যে তিন শিশুর মৃত্যু হয়। নিহত শিশুরা হলো দুর্জয় (২), আব্দুল্লাহ (২) ও ফাতেমা (৩)।

গেল ঈদুল আজহার দিন (১৭ জুন) সকালে সদর উপজেলার যাদৈয়া গ্রামে আয়ান নামে আড়াই বছরের এক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এতে ওই গ্রামে ঈদের আনন্দ শোকে পরিণত হয়েছে।  

পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে শিশুদের প্রতি পরিবারের সদস্যদের আরও সতর্কতা অবলম্বন এবং সাঁতার শেখানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করছেন চাইল্ড অ্যান্ড উইমেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এর নির্বাহী পরিচালক পারভীন হালিম।  

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, পানিতে পড়ে যে সংখ্যক শিশুর মৃত্যু হচ্ছে, এর সুনির্দিষ্ট কোনো হিসেব নেই। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেব থেকেও সংখ্যাটা কয়েকগুণ বেশি হবে। উপকূলীয় এ জেলাতে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। বর্ষায় বৃষ্টিপাতের কারণে বসতবাড়ির আশপাশে থাকা ডোবা বা নালা পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। এছাড়া পুকুর তো রয়েছেই। এগুলো অরক্ষিত থাকায় শিশুরা খুব সহজেই পানিতে নেমে যেতে পারে। তখনই দুর্ঘটনাটি ঘটে। কিছু সময়ের জন্য শিশুদের মায়েরা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যদের বেখেয়ালি বা অসাবধানতার কারণে এমন ঘটনা ঘটে।  

তিনি জানান, সাধারণত এক বছর বয়স থেকে শুরু করে ৭-৮ বছর বয়সী শিশুরা পানিতে পড়ে মারা যায়। যে সব শিশু একেবারে ছোট, তাদের দিকে পরিবারের সদস্যদের সর্বক্ষণিক নজরদারি রাখতে হবে। আর সাঁতার শেখার উপযোগী শিশুদের অবশ্যই সাঁতার শেখাতে হবে। এটা খেলাধুলার একটি অংশ হতে পারে। তবে জেলাতে শিশুদের সাঁতার শেখানোর মতো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় শিশুরা সাঁতার শিখতে পারছে না। সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে শিশুদের সাঁতার শেখার জন্য পুকুর বা সুইমিংপুলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।  

এদিকে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে ২০২২ সালের দিকে সাঁতার প্রশিক্ষণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে রয়েছে শিশু একাডেমি।

প্রকল্পের অধীনে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা, কমলনগর ও রামগতি উপজেলা রয়েছে। এ তিন উপজেলাতে এখনো মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়নি। তবে 'পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র' নামের একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যে সুবিধাভোগী শিশু ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে।

প্রকল্পের লক্ষ্মীপুর জেলার পোগ্রাম  কো-অর্ডিনেটর মিনহাজ হাসান বাংলানিউজকে বলেন, ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা এ প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারবে। আমরা শিশু এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু করে দিয়েছি। বৃষ্টিতে পুকুরের পানি বৃদ্ধি পেলে আগামী জুনের পর থেকে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে পারবো বলে আশাবাদী। এ জেলার চার হাজার শিশু প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবে।

তিনি জানান, তিন ধাপে শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। শিশুরা যাতে কমপক্ষে একনাগাড়ে ২৫ মিনিট সাঁতার কাটতে পারে। কারো সাহায্য ছাড়াই কমপক্ষে ৩০ সেকেন্ড যাতে পানিতে ভেসে থাকতে পারে। একই সাথে একাধিক শিশুর মৃত্যু হয়, তাই একটি শিশু যাতে নিজেকে রক্ষা করতে পারে এবং অন্যকে সহায়তা করতে পারে, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।  

জেলা শিশু একাডেমির আইসিডিসি প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, পানিতে ডুবে শিশুরা মারা যাচ্ছে। সাঁতার না জানার কারণেই মৃত্যু হার বেড়েছে। তাই মৃত্যুহার কমাতে শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।  

বেসরকারি একটি এনজিও সংস্থা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে দিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন আমরা মনিটরিং করবো।  

আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।