যশোর: তারিখটি ছিল ১৯ জুলাই। ঢাকার রাজপথ তখন উত্তাল।
চোখের সামনে অসংখ্য মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছেন। তাদেরকে উদ্ধারে এগিয়ে যান তিনি। রিকশা, ভ্যানে করে কয়েকজনকে পৌঁছেও দিয়েছেন নিকটবর্তী নাগরিক হাসপাতালে। এরই মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে আরও অনেকে রাজপথে পড়ে রয়েছেন। তাদের উদ্ধারে ফের এগিয়ে গেলে গুলিবিদ্ধ হন ইমন কবির।
ইমন কবিরের বাড়ি যশোর শহরের ষষ্টিতলায়। পিটিআই সড়কের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন তারা। বাবা হুমায়ুন কবির টেইলার, মা স্বপ্না কবির গৃহিনী। তাদের সাথে ভাড়া বাড়িতে নানিও থাকেন। যশোর নবকিশলয় থেকে প্রাথমিক পাশ করে জিলা স্কুল থেকে এসএসসি। এরপর ইলেকট্রিক্যালে ভর্তি হন যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। এখান থেকে গাজিপুরে মাল্টিপারপাস নামে একটি কোম্পানিতে ইন্টার্নি করতে গিয়েছিলেন। থাকতেন বাড্ডায়। পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য রাইড শেয়ার করতেন।
সোমবার (২৮ জুলাই) দুপুরের পর বৃষ্টির মধ্যে যেয়ে ইমন কবিরদের বাড়ির প্রবেশ পথে জলাবদ্ধতার কবলে পড়তে হয়। পানি মাড়িয়ে যেয়ে দেখা যায় তিন কক্ষের টিনশেড বাড়ির একটি কক্ষে খাটের ওপর বসে আছেন তিনি। পায়ের গুলিলাগা স্থানে ফিক্সএটর (Fixator) লাগানো রয়েছে।
ইমন বলেন, প্রায় এক বছর হলো এই যন্ত্র দিয়ে পা আটকানো। গুলি তার ডান পায়ের টাকনুর একটু ওপরের অংশে লেগে বের হয়ে আর একজনের শরীরে বিদ্ধ হয়। গুলিতে ইমনের পায়ের ওই অংশের হাড় গুড়ো গুড়ো হয়ে যায়। ওটিতে নিয়ে অপারেশনের পর তার পায়ে ওই যন্ত্র লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় এক বছর হলো এই অবস্থায় রয়েছেন। খোলার জন্য তিনবার ওটিতে নিয়েও ফিরিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসক। বলেছেন, এখনই ঝুঁকি নেওয়া যাচ্ছে না। সামান্যতেই আবার প্রথম থেকে শুরু করা লাগতে পারে। সেজন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলেছেন।
তবে, ইমনের আশংকা তিনি আর দুই/তিন বছরেও ভালো হতে পারবেন কি না তাই নিয়ে। যদি আশংকা সত্যি হয় তাহলে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া, বিএসসি সম্পন্ন করা, বিদেশে যাওয়া আর ভালো চাকরি করে উপার্জন করার স্বপ্ন অধরা থেকে যেতে পারে। তবে, এর মাঝেই তিনি ডিপ্লোমা শেষ করেছেন। এখন শুধু রিটেক বাকি, যা মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) অনুষ্ঠিত হবে। ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন আহত অবস্থায়।
ইমন বলেন, আফতাবনগর গেটে যেখানে তিনি এবং আন্দোলনকারীরা গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তার অদূরে রামপুরা ব্রিজের ওপাশে ছিল সশস্ত্র পুলিশ ও বিজিবির অবস্থান। তিনি বলেন, ‘আমি যখন গুলিবিদ্ধদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছিলাম তখনই আমাকে টার্গেট করে গুলি চালায় পুলিশ-বিজিবি’।
তিনি বলেন, আমি গুলি খাওয়ার পর ভাইয়ারা (আন্দোলনকারী) আমাকে উদ্ধার করে নাগরিক হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে নেওয়া হয় পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়ে যশোরে বাসায় ফেরেন। আবার ২৬ ডিসিম্বর ভর্তি হয়ে ফিরে আসেন ২ জুন।
কোরবানির ঈদের পর আবার ভর্তি হতে গেলে তাদেরকে গেটের সামনে থেকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল পুলিশ। অনেক কষ্টে তারা ভর্তি হলেও তাদেরকে এইবার যেখানে রাখা হয়েছিল তা খুবই নোংরা একটা স্থান। সেখানে টিকতে না পেরে মাত্র দুই দিন থেকে ফিরে আসেন বাড়িতে।
ইমন কবির বলেন, যশোরে আসার পর বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত এসেছিলেন। এছাড়া, জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক রুহুল কুদ্দুসও এসেছিলেন। তারা আর্থিক সহায়তা করেছেন। বিশেষ করে পরীক্ষা দিতে যাতে কোনো সমস্যা না হয় সে ব্যাপারে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে যাবতীয় ব্যবস্থা করেন।
চিকিৎসার ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করে ইমন ও তার মা স্বপ্না কবির বলেন, এখন কী করবো, কোথায় যাবো সে ব্যাপারে কোনো দিক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে না। বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে পারলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারতেন বলে জানান তারা।
দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ইমন কবির। তিনি বলেন, যা হচ্ছে তা শংকার। নিজেরা নিজেরা কামড়াকামড়ি করে ফ্যাসিবাদকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে। যদি তারা আবার ফিরতে পারে তাহলে জুলাই যোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতা চাঁদাবাজির ঘটনায় গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় তিনি নিন্দা জানান। বলেন, ‘এখন বুঝতে পারছি উমামা ফাতেমা কেন পদত্যাগ করেছেন। যশোরের রাশেদ ভাই কেন পদত্যাগ করেছেন। এগুলোর জন্যতো এদেশের মানুষ আন্দোলন করেনি। এটা বন্ধ করতে হবে, অবশ্যই করতে হবে। তা না হলে মানুষের আস্থা ধরে রাখা যাবে না। ’
ইমন কবির অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকলাপে ভুল ত্রুটি আছে উল্লেখ করে বলেন, ব্যক্তি হিসেবে ইউনূস স্যার অনেক নরম। তবে, মনে হচ্ছে উপদেষ্টারা না, সরকার চালাচ্ছেন সচিবরা। এসব সচিব আওয়ামী লীগের দোসর। তাদেরকে সরাতে না পারলে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া খুব কঠিন।
দেশের পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির জন্য তিনি সরকারকে কঠোর অবস্থান গ্রহণ, জুলাই সনদ ঘোষণা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এসএইচ