ঢাকা: দেশের অধিকাংশ কোম্পানিতে প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্ট নেই বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম।
সোমবার (২৪ নভেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে শেয়ারবাজারের সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।
বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, জিডিপির হার অনুসারে আমাদের পুঁজিবাজারের মার্কেট ক্যাপিটাল হচ্ছে সর্বনিম্ন। বিনিয়োগ ক্ষেত্রে ব্যাংক খাত থেকে যে পরিমাণ ঋণ যাচ্ছে, তার তুলনায় পুঁজিবাজার থেকে যে অর্থ যাচ্ছে তা একেবারেই নগণ্য।
তিনি বলেন, কোম্পানির মালিকানা ও প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্ট পৃথক ধারণা। মালিকানা না থাকলেও প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্ট থাকলে কোম্পানির অবস্থা ভালো হবে। তবে আমাদের দেশে কতোটি কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট প্রফেশনাল তা দেখার বিষয়। হাতে গণা কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া কোনো কোম্পানিতে প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্ট নেই।
পুঁজিবাজারে সরকারি কোম্পানি তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে পরিচালকরা যে গাড়ি সুবিধা পান, বোর্ড মিটিং বাবদ যে অর্থ পান তাতে কিছুটা অসুবিধা সৃষ্টি হবে। এই অসুবিধা দূর করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। সরকারের এই রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব কবে দূর হবে তা বলা দূরুহ।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্বপন কুমার বালা, পরিচালক শাকিল রিজভী, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলিউর মারুফ মতিন, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সহ-সভাপতি ও ডিএসই’র সাবেক সভাপতি আহসানু ইসলাম টিটু প্রমুখ।
আবু আহমেদ বলেন, কিছু কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে টাকা তুলছেন। এর কিছুদিন পরেই আবার বোনাস শেয়ার ঘোষণা করছেন। এতে শেয়ারটির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ বিষয়টি বিবেচনা করে বোনাস শেয়ারের ওপর একটি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত।
ফিন্যান্সিয়াল রিপোটিং অ্যাক্ট’র বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আমরা কি মূর্খ হয়ে গেলাম যে এডিবি বলার কারণে আমাদের ফিন্যান্সিয়াল রিপোটিং অ্যাক্ট পাস করতে হবে। এটি আমাদের করা উচিত ছিলো। পত্রিকা দেখে জেনেছি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শুধু পেপার দেখে আইপিও’র অনুমোদন দিয়ে দেয়। এ অবস্থা পরিবর্তন না করলে যেমন তেমন প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাবে।
পদ্মা সেতুকে লিমিটেড কোম্পানি করে শেয়ারবাজার থেকে টাকা তোলা যায় উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, পদ্মা সেতুর জন্য শেয়ারবাজার থেকে টাকা তোলার মাধ্যমে আরও একটি সেতু করা সম্ভব। কিন্তু সরকার তা না করে এডিবি, অমুক, তমুক টাকা দেবে এই আশায় বসে আছে। সরকারের এমন মানসিকতা থাকলে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আর্জন কখনোই সম্ভব হবে না। সরকারের উচিত হাইওয়েগুলো এবং সরকারি হোটেলগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করা।
তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারণে। ১৯৯৬ সালে, ২০১০ সালে যে কেলেঙ্কারি হয়েছিল তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারণে এবং বর্তমান সময়ে যে ছোট ছোট কেলেঙ্কারি হচ্ছে তাও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারণে। অপরদিকে সুদের হার সব সময় শেয়ারবাজারে প্রভাব ফেলে। গত তিন বছর বাংলাদেশ ব্যাংক ভুল মুদ্রানীতি দিয়েছে।
স্বপন কুমার বালা বলেন, বাজারে কিছু ট্রেজারি বিল আছে যেগুলোর কোনো লেনদেন হয় না। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর অবস্থাও ভালো না। ফান্ড ম্যানেজমেন্টের কারণেই মিউচ্যুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফান্ড ম্যানেজারদের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা দরকার।
ডেরিভেটিভ মার্কেটের বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। অচিরেই ক্লিয়ারিং হাউজ প্রতিষ্ঠিত হবে। এরপর ডেরিভেটিভ মার্কেট চালু করা সম্ভব হবে। আগামী বছর ডিএসই ইসলামিক বন্ডের জন্য নতুন পোডাক্ট আনবে।
নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির বোনাস শেয়ার ঘোষণা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে স্বপন কুমার বলেন, নতুন আইপিও কোম্পানির বোনাস শেয়ার নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলো কাজ করছে। আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জের সম্পর্ক ভালো ছিলো না। এখন এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে কোনো প্রস্তাব দেওয়া হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তা বাস্তবায় করছে।
ফিন্যাসিয়াল রিপোর্টি অ্যাক্ট’র বিষয়ে তিনি বলেন, এডিবির চাপে সম্ভাবত এ মাসেই ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টি অ্যাক্ট পাস হবে। কিন্তু এর খসড়া এখনো আমারা দেখিনি। একটি পাবলিক আইন কেন এতো গোপনীয়ভাবে তড়িঘড়ি করে করতে হবে তা বিবেচনার বিষয়।
শাকিল রিজভী বলেন, অডিট রিপোর্টের ওপরই সব কিছু নির্ভর করে। অডিট রিপোর্ট গুণগত মানসম্পন্ন না হলে সঠিক দাম পাওয়া যাবে না। বাজারে কোম্পানির অডিট রিপোর্ট ভালো, কোম্পানির গ্রোথ ভালো সেই বাজারকেই ভালো বাজার বলা যায়। দেশের অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যে বাজার বাড়ে সেই বাজার স্থিতিশীল হয়। অন্যথায় বাজার স্থিতিশীল হয় না। কোম্পানির গ্রোথ, কোম্পানির লভ্যাংশ, শেয়ার প্রতি আয়, নেট সম্পদমূল্য দেখে শেয়ার কেনা উচিত।
রিজভী বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের যে অবস্থা তা খুবই দুঃখজনক। ১৮ হাজার কোটি টাকার মিউচ্যুয়াল ফান্ড এখন দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকায়। মিউচ্যুয়াল ফান্ড তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেই পাশাপাশি তা এক লাখ কোটি টাকার বাজার ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
রিভজী আরও বলেন, আমাদের বাজারে বিনিয়োগকারী আছেন। তবে বর্তমানে বাজারে যে পরিমাণ লেনদেন হচ্ছে বাজারের আকার তার থেকে অনেক বড়। বাজারে ভালো কোম্পানি আনতে পারলে বিনিয়োগকারীরা অবশ্যই বিনিয়োগ করবেন।
আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, আগে ধারণা ছিলো আইপিও আসলে স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যরা কিছু লুটেপুটে খাবে। এখন পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে। এখন বাজারকে এগিয়ে নিতে হলে আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে আগে কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত সবশর্ত পূরণ করতে হবে। তারপর নিয়ন্ত্রক সংস্থা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেবে। এটি করা হলেই আইপিও নিয়ে যে কথা হচ্ছে তা বন্ধ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি এসএমই কোম্পানি, গ্রিন ফিন্ড কোম্পানি কীভাবে পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলতে পারে তার একটা নীতিমালা করতে হবে।
বর্তমানে যে আইপিও পদ্ধতি রয়েছে তা পাবলিককে খাওয়ায়ে দেওয়ার পদ্ধতি বলেও মন্তব্য করেন টিটু।
ডিএসই’র সাবেক এই সভাপতি আরও বলেন, ডিমিউচ্যুয়াল বোর্ডের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ পাবলিক কোম্পানি হিসেবে স্টক এক্সচেঞ্জকে লাভজনক করা। স্টক এক্সচেঞ্জকে লাভজনক করতে পারলে স্ট্যাটেজিক পার্টানার পাওয়া যাবে।
সিএসই ব্যবস্থাপনা পরিচালক অলিউর মারুফ মতিন বলেন, ফোর্সসেল বলে কিছু নেই। ফোর্সসেল বন্ধের কারণেই বিনিয়োগাকরীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মিউচ্যুয়াল ফান্ডের বিষয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। আমি বলি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে যা হয়েছে তা স্রেফ চুরি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৪