ঢাকা, বুধবার, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ জুন ২০২৪, ১৮ জিলহজ ১৪৪৫

শেয়ারবাজার

নির্বাচন পর্যন্ত পুঁজিবাজার ভালো রাখতে বিশেষ উদ্যোগ

মাহফুজুল ইসলাম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩, ২০১৮
নির্বাচন পর্যন্ত পুঁজিবাজার ভালো রাখতে বিশেষ উদ্যোগ Dhaka stock bg

ঢাকা: নির্বাচনী বছর (চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত) পুঁজিবাজারকে ভালো রাখতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত জানুয়ারিতে শুরু হওয়া দরপতন থেকে উত্তরণের পাশাপাশি বাজারের চলমান তারল্য ও আস্থার সংকট দূর করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের আগে নতুন করে পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল না হয়। এ কারণে সরকারকে যাতে বিব্রত হতে না হয়।

বিশেষ উদ্যোগ গুলো হচ্ছে- ব্যাংকের বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমিয়ে আনা, ব্যাংক ঋণ আমানতের রেশিও (এডিআর) সুদের হার সমন্বয়ের সময় বৃদ্ধি, ব্যাংক-ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি ও মার্চেন্ট ব্যাংকের বিনিয়োগের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) মতো পুঁজিবাজারেকে সার্পোট দেওয়ার জন্য আরো একটি প্রতিষ্ঠান করছে সরকার।

এ ছাড়াও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে চীনা কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ডিএসইর কাছে সংশোধনী প্রস্তাব চেয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

বিনিয়োগকারীদের মন জয় করার উদ্দেশ্যে গঠিত বিশেষ উদ্যোগের ফলে ইতোমধ্যে পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতি নজর দিতে শুরু করেছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ভয় কাটতে শুরু করেছে। বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীরাও নতুন করে বাজারে আসতে শুরু করেছে। এসবের ফলে সর্বশেষ তিন কার্যদিবস সূচক, লেনদেন ও বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দামও বেড়েছে। এতে বিনিয়োগকারীরাও হারানো পুঁজি ফিরে পেতে শুরু করেছে।

যেভাবে শুরু হয় দরপতন:
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধসের টানা সাত বছর পর, গত জুন থেকে ইতিবাচক ধারায় লেনদেন শুরু হয়। এই সময়ে তলানিতে থাকা পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেন বাড়তে থাকে। যা অব্যাহত ছিলো ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

ফলে বিনিয়োগকারী ও শেয়ারব্যবসায়ীরা প্রত্যাশা করতে থাকে, যে ২০১৮ সাল হচ্ছে সরকারের নির্বাচনী বছর। এই বছরের সরকার পক্ষ থেকে কোনো নেতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হবে না যাতে পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল হয়। কিন্তু তাদের এই আশায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের বিষয় নিয়ে নজরদারি বাড়ায়। বিনিয়োগ সীমা অতিক্রম করায় কয়েকটি ব্যাংকে বড় ধরনের জরিমানা করে। বেশি কিছু ব্যাংকে সতর্ক করে। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে শুরু হয় পুঁজিবাজারে দরপতন। এরপর জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে এডি রেশির হার কমানোর সার্কুলার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তার সঙ্গে যোগহয় বিএনপির চেয়ারপারসনের দুর্নীতির মামলার রায়ের ইস্যু। তার ওপরে নতুন করে ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী নিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি হয়।

এসব ইস্যুতে জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পরর্যন্ত, টানা তিন মাস পুঁজিবাজারে চলে দরপতন। এই দরপতনে ডিএসই থেকে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারিয়েছে ৩৬ হাজার ২১৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আবারো অতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বাজারে প্রতিদিনই কমেতে শুরু করে লেনদেন ও সূচক। ফলে সৃষ্টি হয় তারল্য ও আস্থা সংকটের। বাজার হয়ে উঠে অস্থিতিশীল। বিনিয়োগকারী ও শেয়ার ব্যবসায়ীরা লোকসান ঠেকাতে শুরু করে শেয়ার বিক্রি।

শুরু হয় পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের দৌড়ঝাঁপ:
ঠিক এই অবস্থা থেকে উত্তোলনে বাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ডিএসই, সিএসই, ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ), বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ), আইসিবিসহ বাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিকবার জরুরি বৈঠকে বসে।

বৈঠকের চলমান অবস্থা উত্তোলনে, সলো ভিত্তিতে পুঁজিবাজারে এক্সপোজার গণনা করা। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন বন্ড ডিবেঞ্চার প্রেফারেন্সিয়াল শেয়ার ও তালিকাভুক্ত মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে ব্যাংকের এক্সপোজার হিসাবের বাইরে রাখা, কৌশলগত বিনিয়োগ যা পুরো মেয়াদকাল পর্যন্ত ধরে রাখা এবং যে সব সিকিউরিটিজের লেনদেন হয় না সেসব সিকিউরিটিজকে এক্সপোজার গণনা থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব আনা হয়।

এই প্রস্তাবগুলোর পাশাপাশি আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাবগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, অর্থমন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেওয়া হয়। রাজনৈতিভাবেও বেশ কিছু জায়গায় তদবির করা হয়।

সরকারের বিশেষ উদ্যোগ:
এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পক্ষ থেকে নির্বাচনের বছরে পুঁজিবাজারকে ভাল রাখতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়। যা গত রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। অর্থমন্ত্রীর প্রত্যাশা এর ফলে ব্যাংক ও পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট দূর হবে, ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদ হার কমে আসবে। ব্যাংক ও পুঁজিবাজার ভাল হবে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাজার নিয়ে আস্থার যে সংকট রয়েছে কমে আসবে। উদ্যোগগুলো নিম্নরূপ-

সিআরআর কমছে ১ শতাংশ:
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট এবং ব্যাংক মালিকদের দাবির মুখে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সিআরআর ১ শতাংশ কমিয়ে ৬ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ রাখার ঘোষণা দিয়েছে অর্থমন্ত্রী। এতে ব্যাংকগুলো হাতে ১০ হাজার কোটি টাকা আসবে। তাতে ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার দ্রুত কমে দুই অংকের ডিজিট থেকে নেমে আসবে। বাজারে তারল্য সংকট কমে আসবে, ব্যাংক এবং ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগের সক্ষমতা বাড়বে।

এডিআর সমন্বয়ে সময় বাড়ল মার্চ পর্যন্ত:
চলতি বছরে ২৮ জানুয়ারি ব্যাংকগুলোর এডিআর কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। তার জন্য প্রথমে সময় বেধে দেয় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের বাধার আলোকে এরপর সেই সময় ছয় মাস বৃদ্ধি করে ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। দ্বিতীয় দফা সমন্বয়ের সময় বাড়িয়ে রাখা হয়েছে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত।

বিশেষ গ্রুপকে পুঁজিবাজারের দায়িত্ব দেওয়া:
রোববার অর্থমন্ত্রী পুঁজিবাজারে সব সমস্যা-সমাধানে একটি গ্রুপকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। যারা দরপতনের সময় শেয়ার কিনে মার্কেটকে সাপোর্ট দিবে। আর উত্থানের সময় শেয়ার বিক্রি করে টাকা রিজার্ভ রাখার সব নানা উদ্যোগ নিবে। বিনিয়োগকারীদের ভাবনা এই গ্রুপের প্রধান হবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা ও আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান।

তবে ডিবিএ’র সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেকের মতে, এটি হবে আইসিবির মতই পুঁজিবাজারকে সার্পোট দেওয়ার জন্য একটি ব্যাংক। যার দায়িত্ব দেওয়া হবে হয়তো কয়েকটি ব্যাংক মালিকদের। কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে। যার কাজ হবে মার্কেটকে সাপোর্ট দেওয়া।

বিনিয়োগকারীদের দাবি:
১৯৯৯ ও ২০১০ সালের ধসের মতই চলতি বছরের টানা তিন মাস পুঁজিবাজারে ধস হয়েছে। এই ধসের কারসাজির সঙ্গে যারা জড়িত, যারা এই সময়ে শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। তাদের সঠিক বিচার হলে পুঁজিবাজারে কারসাজি বন্ধ হয়ে যাবে। বিনিয়োগকারী নেতা আতা উল্লাহ নাঈম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা শুনেছি, লঙ্কাবাংলা, ব্র্যাক ইপিএলসহ বড় ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে কিছু বড় বড় ইনভেস্টর শেয়ার বিক্রি করে মার্কেট ফেলেছে। আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

বাজার বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য:
অধ্যাপক আবু আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারের বড় উপকারে আসবে। বাজারের তারল্য সংকট কাটবে। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিক্রেতারা সক্রিয় হবে। তাদের হাতে টাকা থাকলে শেয়ার কিনতে পারবে। আর কেনার চাপ থাকলেই শেয়ারের দাম বাড়ে। কাজেই এই সিদ্ধান্তে পুঁজিবাজার ভালো হবে।

ডিবিএ সভাপতি মোস্তাক আহমেদ বলেন, মুদ্রাবাজারে সংকটের ফলে পুঁজিবাজারেও তারল্য সংকট দেখা দেয়; যার দরুন বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর হাতে টাকা ছিল না। সিআরআর কমানোয় তারল্য বাড়বে আর পুঁজিবাজারের সংকটও দূর হবে। তার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সিআরআর কমানোয় বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করবে না ব্যাংক। পুঁজিবাজারেও অর্থ আসবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৩, ২০১৮
এমএফআই/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।