বিকেএসপি থেকে ফিরে: ২০০০ সাল থেকে বিকেএসপি’র ফুটবল কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন উজ্জ্বল চক্রবর্তী। দেশের একমাত্র এ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তার কাছে তালিম নিয়ে প্রতিবছরই বের হন শিষ্যরা।
ভালো নাম উজ্জ্বল চক্রবর্তী হলেও, বন্ধু মহল ও ফুটবল অঙ্গনে শিবু নামে বেশ জনপ্রিয় তিনি। খেলোয়াড়ি জীবনের শুরু সেই ৮০’র দশকে, তখন তিনি স্কুল পড়ুয়া। ওই সময় ফুটবলে প্রতিভাবান খেলোয়াড় বের করে আনতে এনএসসি (জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ) ‘ক্রীড়া প্রতিভা অন্বেষণ’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো। উজ্জ্বল চক্রবর্তী সেই প্রকল্পেরই ফসল।
১৯৮৯-৯০ সালের কথা, এসএসসি পরীক্ষা সামনে। পড়ালেখার বিস্তর চাপ মাথায় নিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ওই প্রতিভা অন্বেষণ মঞ্চে নওগাঁ থেকে নিজেকে প্রমাণ করতে ঢাকা এসেছিলেন শিবু নামে পাঁচ ফুট ১১ ইঞ্চি গৌঢ় বর্ণের এ কিশোর। আর প্রতিভা প্রমাণের মঞ্চে নিজেকে এতোটাই উজ্জ্বল প্রমাণ করেছিলেন যে, তার ক্রীড়া নৈপুণ্যে একটি-দু’টি নয়, ফরাশগঞ্জ, ফকিরাপুল ও বিজেএমসির মতো ঢাকার তিন তিনটি ক্লাব তাকে পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তবে শেষ পর্যন্ত তার ঠিকানা হয় ফরাশগঞ্জ।
সেই থেকে শুরু। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শিবু একের পর এক খেলে গেছেন মোহামেডান, ওয়ারি, মুক্তিযোদ্ধা ও ধানমন্ডির মতো ঐতিহ্যবাহী একেকটি ক্লাবে। শুধু ক্লাবের হয়েই নয়, ১৯৯১-৯২ মৌসুমে জাতীয় দলে খেলেছেন রক্ষণ ভাগের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে।
খেলার পাশাপাশি পড়ালেখাতেও কম যাননি শিবু। ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে এইচএসসির পর ১৯৯৩-৯৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগে স্নাতকে ভর্তি হন। দেশের শ্রেষ্ঠ এ বিদ্যাপীঠে অধ্যায়নকালীন শুধুই ছাত্র ছিলেন না, ছিলেন ঢাবি ফুটবল দলের দলপতিও।
‘বর্তমান সরকারের ক্রীড়া উপমন্ত্রী ও আবহিনীর সাবেক অধিনায়ক আরিফ খাঁন জয় বিশ্ববিদ্যালয় টিমে আমার সঙ্গে খেলেছেন। আর ওই সময় আমাদের এক একজন প্লেয়ারের কী কদর! আমি জগন্নাথ হলে থাকতাম। হলে ঢুকতে ও বের হতে সহপাঠী, জুনিয়র, সিনিয়রদের সম্মান ও ভালোবাসা দেখে আপ্লুত হতাম। ভালো খেলোয়াড় ছিলাম তাই হল প্রশাসন আমার জন্য একটি সিঙ্গেল রুমেরও ব্যবস্থা করেছিলো’।
‘১৯৯৯ অথবা ২০০০ সালের কথা, মাস্টার্সে পড়ি। একদিন আমার এক বন্ধু একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে আমাকে বললো, এই দ্যাখ বিকেএসপিতে ফুটবল কোচ নেবে। আবেদন কর। আবেদনটি দেখে আমিও দেরি করলাম না। রেভিনিউ ও প্রজেক্ট, এ দুই ক্যাটাগরিতে কোচ চাচ্ছিলো বিকেএসপি। রেভিনিউয়ে বেতন কম ছিলো তাই প্রজেক্টে দশ হাজার টাকার পদের জন্য আবেদন করলাম। হয়েও গেল’, বলেন শিবু।
১৯৯১-২০০০ পর্যন্ত খেলোয়াড়ি জীবনের মতো এরপর ফুটবল কোচ হিসেবেও দ্যুতি ছড়িয়েছেন শিবু। তারই শিষ্যত্ব নিয়ে বর্তমান জাতীয় দলে খেলছেন- বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম, হেমন্ত, আমিনুল ইসলাম সবুজ, তৌহিদুল ইসলাম, আলমগীর কবির রানা, মিসবাহ উল হক মানিক ও মাকসুদুর রহমান।
শুধু জাতীয় দলেই নয়, গেলো আগস্টে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সেখানে ২০ সদস্যের স্কোয়াডের ১১ জনই বিকেএসপি’র।
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ বাছাইপর্বের খেলায় দেশের একমাত্র এ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হয়ে খেলেছে তারই ছয়জন শিষ্য। এছাড়া বয়সভিত্তিক বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে তার শিষ্যরা প্রতিনিয়তই অংশ নিয়ে রেখে যাচ্ছেন সাফল্যের ছাপ।
এদিকে, ভালো কোচ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে বিকেএসপিতে প্রতিনিয়ত কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি।
কোচিং ক্যারিয়ারকে আরও উজ্জ্বল করতে স্কলারশিপ নিয়ে এরই মধ্যে ভারতের পাটিয়ালা থেকে শেষ করেছেন একবছরের ডিপ্লোমা, গিয়েছেন জার্মানিতেও। এখানেই থেমে থাকেননি শিবু, কোচ হিসাবে সেরা হতে করেছেন এএফসি’র সর্বোচ্চ কোচিং লেভেলও।
তবে কোচ হিসেবে তিনি বিকেএসপিতে যেসব আর্থিক সুযোগ-সুবিধাসহ অন্য যেসব ভাতা পাচ্ছেন, তা জীবন জাপনের জন্য অপ্রতুল।
এ প্রসঙ্গে শিবু বলেন, আর্থিক সুযোগ-সুবিধার কমতি ছাড়াও এখানে কোচদের কোনো টেকনিক্যাল ভাতা নেই, যা আর্মি বা পুলিশে রয়েছে। তাদের মতো আমাদের কাজেও ঝুঁকি রয়েছে। আমরা যে কাজগুলো করি তা একদিকে যেমন মাঠে তেমনি মাঠের বাইরেও। কাজগুলো এতোই টেকনিক্যাল যে এখানে শরীর, মন ও মেধার সঠিক সমন্বয় হতে হয়। আর এই ভাতাটি দিলে আমরা উপকৃত হতাম। অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও এখানে রয়েছি কারণ, ফুটবলকে ভালবাসি।
বিকেএসপিতে বর্তমানে যে ক’জন কোচ রয়েছেন তারা সংখ্যায় পর্যাপ্ত কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বর্তমানে ঢাকা ও খুলনায় বিকেএসপি’র ফুটবল চালু রয়েছে। ঢাকায় কোচের সংখ্যা আট ও খুলনায় দু’জন। এদিকে, ফুটবলে এ মুহূর্তে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ১শ ৩৯ জন। তাই প্রশিক্ষণার্থীদের তুলনায় প্রশিক্ষক অপ্রতুল। আরও কোচ নিয়োগ দিলে আন্তর্জাতিক মানের একটি দল গড়ে তোলা সম্ভব।
‘এখন আধুনিক যুগ। আর আধুনিক ফুটবলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিদেশে ফিটনেস কোচ, গোল কিপিং কোচ থেকে শুরু করে এখন হেডিং কোচও রাখা হচ্ছে। বিষয়টি অনুকরণ করে এখানেও যদি বেশি সংখ্যায় কোচ নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে তা কখনওই নেতিবাচক ফল বয়ে আনেবে না। ’
বিষয়টি নিয়ে বিকেএসপি’র ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা বললেন শিবু। এছাড়াও একাডেমির ফুটবল উন্নয়নে মহাপরিচালকের সঙ্গে ফুটবল কেচিং স্টাফরা নিয়মিতই সাপ্তাহিক ও মাসিক সভা করে থাকেন বলে তিনি জানান।
তবে এখন স্যাটেলাইটের বদৌলতে ফুটবলপ্রেমীরা ঘরে বসেই ইউরোপিয়ান লিগের হাই ভোল্টেজ ম্যাচগুলো দেখতে পারেন বলে, মাঠে গিয়ে বাংলাদেশের পেশাদার লিগগুলো দেখতে চান না বলে মনে করেন তিনি।
এর বাইরে দর্শকদের মাঠে গিয়ে খেলা না দেখার আরেকটি অন্যতম কারণ হিসেবে বললেন, ট্রাফিক জ্যাম। তার মতে, রাস্তায় যানজট এতই বেড়েছে যে, মিরপুরের একজন বাসিন্দা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলার দেখার কথা ভাবতে পারেন না। তাই মাঠের দর্শক কমে গেছে।
এদেশে আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরি না হওয়ার কারণ হিসেবে এক্ষেত্রে তিনি মনে করেন, পর্যাপ্ত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও অবকাঠামোর অভাব, খেলোয়াড়দের সঠিক সময়ে ফুটবল শুরু না করা এবং একাডেমিতে আসা প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যার স্বল্পতার জন্যই এখনও এদেশ আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
উল্লেখিত জায়গাগুলোতে সঠিকভাবে কাজ করলেই এদেশে অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার তৈরি হবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৫
এমআর/এসএস