ফুটবল এক আবেগের নাম। ফুটবলকে ঘিরেই সবশ্রেণীর সববয়সী মানুষের মধ্যে দেখা যায় বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস।
নাটক-কাহন
খায়রুল বাসার নির্ঝর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
অভিনেতা-নাট্য নির্মাতা কচি খন্দকার বলছিলেন, ‘ফুটবল আমাদের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য। এ দেশের আপামর জনগোষ্ঠী এ খেলার সঙ্গে পরিচিত বহুদিন ধরেই। এটি এখন আমাদের সংস্কৃতির বড় একটা অংশ। ’ ফুটবলকে ঘিরে তিনি একটি টেলিছবি নির্মাণ করেছিলেন। এ নাটকে তিনি তুলে এনেছিলেন কুষ্টিয়া অঞ্চলের একঝাঁক ফুটবলপ্রেমীর গল্প। ‘অব দ্য ফুটবল ফর দ্য ফুটবল বাই দ্য ফুটবল’ নামের টেলিছবিটি দুই বছর আগে এনটিভিতে প্রচারিত হয়। এতে অভিনয় করেছিলেন মোশাররফ করিম, নিপুণ, তানিয়া, স্বাধীন খসরু, রিফাত চৌধুরী প্রমুখ। মোশাররফ করিম বললেন এতে অভিনয়ের মধুর স্মৃতি, ‘এ টেলিছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে কুষ্টিয়া স্টেডিয়ামে দুই দিন ফুটবল খেলেছি। রোদ, বৃষ্টিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুধু ফুটবল খেলাই ছিল কাজ। খুব চমৎকার একটা টেলিছবি। আর কুষ্টিয়া জায়গাটাও সুন্দর। সব মিলিয়ে দারুণ উপভোগ করেছি। ’
কিন্তু যত সহজে বলে দেওয়া গেলো, ফুটবলকেন্দ্রিক কাহিনী নিয়ে টেলিছবি নির্মাণ ঠিক ততটাই কঠিন। আবার ফিরে যাওয়া যাক কচি খন্দকারের বক্তব্যে, ‘এ ধরনের গল্প নিয়ে এগোনো খুব কঠিন। চ্যানেলের পক্ষ থেকে বাধা তো ছিলই, প্রযোজকও পাচ্ছিলাম না। কেউ এ গল্পে অর্থলগ্নি করতে রাজি হয় না। কিন্তু আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম কাজটি করবোই। খুব কষ্টে টাকা জোগাড় করে টেলিছবিটি বানিয়েছি। ’
ওই বছরেই ফুটবলপ্রেমী চার তরুণের গল্প নিয়ে রেদওয়ান রনি পরিচালনা করেন নাটক ‘কিক-অফ’। প্রচারিত হয় এনটিভিতে। অভিনয় করেন পার্থ বড়ুয়া, বিদ্যা সিনহা মিম, শহীদুল আলম সাচ্চু, ইলোরা গহর, অ্যালেন শুভ্র প্রমুখ। আলাপকালে রেদওয়ান রনির মুখ থেকেও বেরিয়ে এলো প্রতিবন্ধকতার এদিক-সেদিক, ‘একটা স্টেডিয়ামে দৃশ্যধারণ করতে গেলে কমপক্ষে ৩০ জন অভিনয়শিল্পী দরকার। গ্যালারিতে দর্শক দেখাতে হবে। টিভিতে ফুটবল ম্যাচ দেখাতে কমপক্ষে ১৫-২০টি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু নাটকে আমরা দুটির বেশি ক্যামেরা ব্যবহার করতে পারি না। তাতে খরচ বেড়ে যায়। ’
মূলত বাজেটের সীমাবদ্ধতার কারণেই ফুটবল নিয়ে কাজ করতে নির্মাতারা সাহস পান না বলে মনে করেন রনি। ফুটবল নিয়ে নাটক কম হওয়ার এটাই প্রধান কারণ। প্রযোজকের অর্থ খসে, লাভ হয় কম। চ্যানেল কর্তৃপক্ষও এত বাজেট দিতে চায় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। নাটকটিতে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা হয় পার্থ বড়–য়ার সঙ্গে। তার অভিনয় জীবনে এ কাজটি বিভিন্ন কারণেই স্মরণীয়।
এরও আগে ২০১০ সালে আরটিভিতে প্রচার হয় ‘ব্রাজেন্টিনা’। নোমান রবিনের রচনা ও পরিচালনায় এ নাটকে অভিনয় করেন মোশাররফ করিম, তিশা, মাজনুন মিজান, অন্তু করিম, রাশেদ মামুন অপু প্রমুখ। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় একটি এলাকার ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যে সংঘটিত নানান মজার ঘটনা তুলে ধরা হয় এতে।
এবারের বিশ্বকাপ উপলক্ষে চ্যানেল আইয়ে প্রচার হচ্ছে ধারাবাহিক নাটক ‘জার্সি নাম্বার টেন’। ফেরদৌস হাসানের রচনা ও পরিচালনায় এতে অভিনয় করেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন, রোকেয়া প্রাচী, সৈয়দ হাসান ইমাম, ইরফান সাজ্জাদ প্রমুখ। এ নাটকে অভিনয় করতে পেরে ইলিয়াস কাঞ্চনের জীবনের বড় একটি আক্ষেপ পূরণ হয়েছে। কিছুটা হলেও। সেটি কেমন? তিনি বললেন, ‘ছোটবেলায় ফুটবল খেলতাম। প্রিয় দল ছিল মোহামেডান। খুব ইচ্ছা ছিল ফুটবলকেন্দ্রিক কাহিনীর কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয় করার। নব্বই দশকের মাঝামাঝি প্রয়াত জহিরুল হক এ ধরনের একটি ছবি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। নায়ক হিসেবে আমার অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। প্রয়াত শিবলী সাদিকও চেয়েছিলেন ছবি করতে। তিনিও পারেননি। ফুটবল নিয়ে নাটকে অভিনয় করার প্রস্তাব আসতেই দেরি করিনি। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছি। অনেকদিনের স্বপ্ন তো।
’ফুটবল এবং ‘জাগো’
ফুটবল খেলা সত্যিই অতুলনীয়। এ দেশের চলচ্চিত্রে ফুটবলকে টুকটাক উপস্থাপন করলেও পূর্ণাঙ্গ ছবির প্রসঙ্গে এলে কেবল ‘জাগো’র কথাই বলা যাবে। ২০০৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পায় ছবিটি। এটি পরিচালনা করে প্রশংসিত হয়েছিলেন খিজির হায়াত খান। তার কাছ থেকে শোনা যাক ‘জাগো’র নির্মাণ-গল্প এবং ফুটবল নিয়ে ছবি তৈরির বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কথা...
আমি মফস্বলের ছেলে। ছোটবেলা কেটেছে বন্ধুদের সঙ্গে ডানপিটে সময় কাটিয়ে। সিলেট ক্যাডেট কলেজে পড়তে গিয়ে শৈশবেই সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। জীবনে নতুন বন্ধুরা এসেছে, কিন্তু ছোটবেলার পাড়ার বন্ধুদের আর কুমিল্লায় আমার বেড়ে ওঠাকে ভুলতে পারিনি কখনও। ইচ্ছে ছিল ছোটবেলার স্মৃতিগুলোকে ধরে রাখার জন্য কিছু একটা করব। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আমার পরিবারের আপনজনরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। আমি মনে মনে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে নিয়ে কিছু করতে চাইছিলাম। আমার ছবিতে এ দিকটি একটু দেখানো হয়েছে (তারিক আনাম খানকে দিয়ে)। কারণ সবাই যখন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছে, তখন এ দেশের ক’জন ফুটবলার ফুটবল খেলে দেশের জন্য সমর্থন আর অর্থ জোগাড় করেছে। এই দুটি ভাবনাকে একত্র করেই ‘জাগো’ ছবির গল্প সাজানো হয়েছে। এ ছবি তৈরির সময় মজার ঘটনা অনেক আছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার ইউনিটের (প্রায় ৮০ জন মানুষ) সবাই ছবিটির কোনো না কোনো দৃশ্যে অভিনয় করেছে। কারণ আমাদের অনেক অতিরিক্ত লোক প্রয়োজন ছিল।
ফুটবল নিয়ে এ দেশে ছবি হয়নি। আরও ব্যাপকভাবে বললে খেলাধূলা নিয়েই ছবি হয়নি। কারণ এ ধরনের ছবি বানাতে অনেক খরচ। আর যে ধরনের কারিগরি সহায়তা লাগে তা আমাদের দেশে পর্যাপ্ত নেই। এখন অবস্থার উন্নতি হলেও ২০০৮ সালে ‘জাগো’ বানানোর পাগলামিতে নামার সময় এত সুযোগ-সুবিধা ছিল না। বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইন্টারস্পিডের সহায়তায় এবং আমার দুই প্রযোজক শার্জিল ও আদনান করিমের সঙ্গে আরও কিছু চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষকে নিয়ে আমরা ছবিটি নির্মাণের দুঃসাহস দেখিয়েছি।
মূলত ফুল এইচডি ফর্ম্যাটে ‘জাগো’ ছবিটির চিত্রায়ণ হয়েছিল। দুটি ক্যামেরা সনি সিনেআল্ট্রার সঙ্গে লেন্স অ্যাডাপটর এবং প্যানাসনিক এইচভিএক্স ২০০ ছিল আমাদের প্রধান ক্যামেরা। কিন্তু খেলার সময় আমরা আরও চারটি সনি এইচডি ক্যামেরা ব্যবহার করেছি। ফুটবল বা খেলাধূলা নির্ভর ছবি করতে হলে পর্যাপ্ত বাজেট প্রয়োজন। পাশাপাশি দরকার সঠিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ। দক্ষ টেকনিশিয়ানের অভাব এখনও আমাদের রয়ে গেছে। সঠিক পরিবেশনা আর বিপণণও জরুরি। কাকরাইল পাড়ার পরিবেশক কমিটির সদস্যরা এ ছবিগুলোকে অবহেলার চোখেই দেখেন।
আর প্রেক্ষাগৃহ পাওয়া নিয়ে তো একটা সমস্যা আছেই। ‘জাগো’র সময় প্রেক্ষাগৃহ পাচ্ছিলাম না। চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নতির জন্য সারাদেশে অন্তত ৩০টি সিনেপ্লেক্স দরকার। যেহেতু প্রেক্ষাগৃহে মধ্যবিত্ত পরিবারের দর্শক এখনও তেমন যায় না, তাই এ ধরনের ছবিকে ব্যবসাসফল করতে অনেক বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। যদি অটুট লক্ষ্য আর হৃদয়ে বিশ্বাস থাকে, তাহলে নিশ্চিত দেখা হবে বিজয়ে! জাগো...।
অনুলিখন : কামরুজ্জামান মিলু
বাংলাদেশ সময় : ১৫৩১ ঘণ্টা, ১৮ জুন, ২০১৪