ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

আকরাম খানের ‘দেশ’

হাজার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে অসহায় আত্মসমর্পণ

ওয়ার্দা রিহাব (অতিথি লেখক) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৪
হাজার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে অসহায় আত্মসমর্পণ 'দেশ' প্রযোজনায় আকরাম খান / ছবি : নূর / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী আকরাম খান ঢাকায় এলেন তার নৃত্য প্রযোজনা ‘দেশ’ নিয়ে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশে পুরস্কার জিতেছে নৃত্য প্রযোজনাটি।

ঢাকায় ‘দেশ’-এর প্রদর্শনীকে ঘিরে নৃত্যাঙ্গন আলোচিত হয়েছে। এই প্রযোজনা দেখে বাংলানিউজের জন্য লিখেছেন নৃত্যশিল্পী ওয়ার্দা রিহাব

১৯ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। মনে হচ্ছিল শুক্রবারে রাস্তায় একটু যানজট কম হবে। কিন্তু বের হয়ে দেখলাম প্রচুর যানজট। ছুটতে ছুটতে পৌঁছালাম বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে। দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ভাবছিলাম, কোনো দৃশ্য মিস করে ফেললাম নাতো! অনেকদিন পর এমন উত্তেজনা অনুভব করছি। আমার মতো অনেকেই হয়তো করেছেন। বিশেষ করে নৃত্যশিল্পীরা। এর একটাই কারণ আকরাম খানের ‘দেশ’।

অন্ধকার মঞ্চ। হারিকেন হাতে এলেন আকরাম খান। দর্শকের চোখ তখন দেখছে- আঁধারে হাজার প্রশ্নের ভিড়ে নিজের অস্তিত্বকে হাতড়ে বেড়াচ্ছে একজন মানুষ। মঞ্চের সামনে ছোট একটি ঢিবি। তাতে বারবার হাতুড়ির আঘাত হেনে নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন কী তিনি?

কখনওবা কিশোর আকরাম খানের কথোপকথন হচ্ছে বাবার সঙ্গে। আবার তার নৃত্যচর্চা ও শিশুকন্যার সঙ্গে গল্পও ফুটে উঠেছে। নানা চরিত্র অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলছেন আকরাম খান। নিজের মাথায় চোখ, নাক, মুখ আঁকিয়ে বারবার চরিত্রের সঙ্গে বাংলা ভাষার ব্যবহার দর্শককে যেমন আনন্দ দিয়েছে, তেমনি তার দক্ষতার পরিচয়ও পাওয়া গেছে। ‘দেশ’-এ গভীর জঙ্গল, নদীর ঢেউ, উড়ন্ত পাখি, চলন্ত নৌকা, হাতি, মৌচাক থেকে মধু খাওয়া, একস্থান থেকে আরেক স্থানে ছুটে যাওয়ার চিত্র নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন আকরাম খান। অসাধারণ গ্রাফিক্সের ব্যবহার এবং সেই সঙ্গে তার দেহ ভঙিমা দেখে আমরা বিমোহিত হয়েছি বারবার।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের উজ্জ্বল অধ্যায় ও ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান ‘দেশ’-এ উঠে এসেছে গর্বের সঙ্গে। কখনওবা একটি তাল ও লয় ব্যবহার করে যানজটের তীব্র আওয়াজকে দুরন্ত গতির নৃত্যভঙিমার মাধ্যমে অসাধারণ নৃত্যশৈলীতে পরিণত করেন তিনি।

আকরাম খানের ‘দেশ’ আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে তার নিজের যোগসূত্র খুঁজে ফেরারই গল্প। এ যেন  হাজার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে পরিশেষে অসহায় আত্মসমর্পণ। নৃত্যনাট্যের শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি শুন্য থেকে উল্টো হয়ে ঝুলছে একজন মানুষ। যার শেষ কোথায় আসলে কেউই জানে না। তার পরিবেশনাকে নাচ, গ্রাফিক্স, ছায়া নৃত্য কিংবা অভিনয়- কোনো নামেই সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। প্রতি মুহূর্তে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন চরিত্রে। তার নৃত্যভঙিমার দুর্দান্ত গতি, অসাধারণ দৃশ্যকল্প, আলোকসম্পাত, গল্পের চরম নাটকীয়তায় কি করে যে ৮০ মিনিট কেটে গেলো তা একেবারেই টের পেলাম না।

১৬ সেপ্টেম্বর আকরাম খানের পরিচালনায় তিন ঘণ্টার একটি মাস্টার্স ক্লাসে তার সঙ্গে কথোপকথন হয়েছিল। সেখানে তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি এমন পরিবেশনা উপহার দিতে চান যা দর্শকদের ভাবায়। দর্শকদের মনে প্রশ্নের আর্বিভাব ঘটাতে চান তিনি। যদি সবই পরিবেশনার মধ্যে ফুটিয়ে তোলা হয় তাহলে ভাবার বিষয় কোথায়?

সত্যিই তাই। নৃত্যনাট্যের শেষ ভাবেতে উল্টো হয়ে ঝুলতে থাকা আকরাম খানের মতোই এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে থাক গল্পের পরিণতি। তাই পরিবেশনার শেষে আধ ঘণ্টার প্রশ্নোত্তর পর্বে দর্শকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তিনি তার চিন্তা-ভাবনাগুলো প্রকাশ করেন। সবশেষে করতালিতে ফেটে পড়ে হলভর্তি দর্শক। হল থেকে বাইরে বেরিয়েও পরিবেশনা নিয়ে ভাবতে থাকলাম। ভাবনাটা চলছে এখনও। নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে এখনও। বুঝলাম এখানেই আকরাম খান ও তার ‘দেশ’-এর সার্থকতা।

অনুলিখন : কামরুজ্জামান মিলু

* (ওপরের ছবিতে) আকরাম খানের সঙ্গে ওয়ার্দা রিহাব

বাংলাদেশ সময় : ১৮২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ