চট্টগ্রাম: আদিকাল থেকেই সংস্কৃতির সমৃদ্ধ জনপদ চট্টগ্রাম। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য লুসাই পাহাড় আর কর্ণফুলী নদীর ঐতিহ্যের সঙ্গে বুক উঁচু করে আছে এ জনপদের নিজস্ব সংস্কৃতি।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ধারা জন্ম দিয়েছে অনেক গুণীজনের। আঞ্চলিক গানের রাজা-রানী শেফালী ঘোষ-শ্যামসুন্দর বৈঞ্চব তো ছিলেনই; কুমার বিশ্বজিৎ, নকীব খান, আইয়ুব বাচ্চু, মিষ্টি মেয়ে কবরীর মতো দেশের বহু নামীদামী শিল্পীর জন্মভূমি এই চট্টগ্রামের মাটি।
সংস্কৃতির সেই ঐতিহ্য ধরে রেখে চর্চা করে যাচ্ছে নবীন শিল্পীরাও। সংস্কৃতির পাঁচটি স্বতন্ত্র ধারায় কাজ করে যাওয়া চট্টগ্রামের পাঁচ নবীন শিল্পীর গল্প বলছে বাংলানিউজ। বয়সে নবীন হলেও স্বপ্রতিভায় তারা জায়গা করে নিয়েছেন চাঁটগা তথা দেশের শিল্পবোদ্ধা মানুষের হৃদয়ে।
বৈশাখী নাথ
গান গেয়ে আর গান শুনিয়েই বৈশাখীর তৃঞ্চা মেটে। যখন থেকে পড়ালেখায় হাতেখড়ি, তখন থেকেই সংগীতের সঙ্গে তার সখ্য। শৈশব থেকেই গানের তালিম নিয়েছেন সংগীত শিক্ষক সুব্রত দাশ অনুজের কাছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যয়নরত বৈশাখীর কাছে প্রোগ্রামিং আর কোড-আনকোডের দুনিয়ার চেয়ে বেশি ভালো লাগে হারানো দিনের সুরে ভেসে থাকতে। বাংলাদেশ বেতারের আধুনিক গানে তালিকাবদ্ধ এ শিল্পীর ঝুলিতে রয়েছে ডজনখানেক সরকারি ও বেসরকারি পুরস্কার।
নিজের সংগীতসাধনা প্রসঙ্গে বৈশাখী বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি চাই মানুষ আমাকে না দেখে আমার গান শুনুক। চোখবুজে আমার গান শুনে একমুহূর্তের জন্য হলেও মগ্ন হোক শ্রোতা। ’ প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে সংগীত সাধনা আজ লোকদেখানো হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রিয়াঙ্কা বড়ুয়া
ঘুঙুরের সঙ্গেই প্রিয়াঙ্কার সখ্য। মায়ের ইচ্ছায় হাঁটতে শেখার বয়স থেকেই নাচ শেখা শুরু করেন তিনি। শৈশবে নৃত্যগুরু প্রমা অবন্তী, রূপক সেনের কাছে নাচের পাঠ নেওয়া সেই ছোট্ট প্রিয়াঙ্কা এখন দেশের নৃত্যাঙ্গনে পরিচিত মুখ।
নিজের নৃত্যচর্চা সম্পর্কে প্রিয়াঙ্কা বাংলানিউজকে বলেন, ‘নাচই আমার বেঁচে থাকার রসদ। নাচের মাধ্যমেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। ’ তিনি আরও বলেন, ‘ফিউশন বা পশ্চিমা ধাঁচের হোক, নৃত্য শুদ্ধভাবে করতে হবে। ’
এ বছর চ্যানেল আই আয়োজিত ‘সেরা নাচিয়ে’ প্রতিযোগিতায় সেরা সাতে স্থান করে নেন প্রিয়াঙ্কা। বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ পড়ুয়া এই তরুণী ভারতে ওড়িশী নৃত্যের ওপর তালিম নিয়েছেন।
১৯ বছরের নৃত্যজীবনে শেখা নৃত্যজ্ঞান উজার করে ঢেলে দিচ্ছেন নিজের বাসায় পরম যত্নে গড়ে তোলা নৃত্যম একাডেমিতে। নৃত্যের তালে বাঁধা প্রিয়াঙ্কার স্বপ্ন নাচের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের সুনাম ছড়িয়ে দেওয়া।
মুজাহিদুল ইসলাম
আবৃত্তিতে নিবেদিত তরুণ মুজাহিদুল ইসলাম। পেশায় আইনজীবী মুজাহিদ আইনের মারপ্যাঁচের চেয়ে প্রিয় কবিদের কবিতায় মগ্ন থাকতে ভালোবাসেন। কবিতার ছন্দেই তিনি খুঁজে পান স্বপ্নের ঠিকানা। ২০০৭ সাল থেকে চট্টগ্রামের আবৃত্তি অঙ্গনে তার পরিচিতি রয়েছে সফল আবৃত্তি সংগঠক হিসেবে। তারই সুদক্ষ পরিচালনায় সাত বছর ধরে চলছে চট্টগ্রামের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন বাচিক শিল্পচর্চা কেন্দ্র ‘তারুণ্যের উচ্ছ্বাস’। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে দেশ-বিদেশের আবৃত্তিশিল্পীদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে তার স্বপ্নের সংগঠনটি।
সৎ ও কুশলী শিল্পী হয়ে আবৃত্তি অঙ্গনে কাজ করে যেতে চান জানিয়ে মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আবৃত্তি জগতে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে চাই। নিজের অধ্যবসায় ও চর্চার মাধ্যমে চট্টগ্রামের আবৃত্তি অঙ্গনকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিণত করতে চাই। ’
নিশু শিকদার
সপ্রতিভ অভিনয়শিল্পী নিশু শিকদার তীর্যক নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে মঞ্চে কাজ করছেন। সেই থেকে তার পথচলা থামেনি। অভিনয়ের স্বপ্নিল জগতে তিনি কাজ করেছেন ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে। নননপুরের কমলাসুন্দরী, বিলজানবানু চরিত্রের পাশাপাশি আরও বহুমুখী চরিত্রে অভিনয় করে চাঁটগার দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। নাটকের পাশাপাশি কাজ করছেন ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন টিভি নাটক, বিজ্ঞাপনে অভিনয় ও র্যাম্প মডেলিং করেছেন তিনি।
নিশুর স্বপ্ন নিরন্তর চর্চার মাধ্যমে ভবিষ্যতে অভিনয়জগতে নিজের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলবেন তিনি। বাংলানিউজকে তার ভাষ্য, ‘অভিনয়শিল্পী হিসেবে কাজ করে যেতে চাই আজীবন। ভালো অভিনেত্রী হতে হলে ভালো মানের কাজ বেশি পরিমাণে করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ’
মাহমুদুল হাসান
নির্বাক অভিনয়ে সরব নাট্যকর্মী মাহমুদুল হাসান। শিল্পী নয়, নিজেকে মূকাভিনয় কর্মী হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। প্যান্টোমাইম মুভমেন্টের হাত ধরে ২০০৯ সাল থেকে তার মূকাভিনয় শুরু। পার্থপ্রতীম মজুমদার, রণেন চক্রবর্তীর মতো মাইম গুরুদের সঙ্গী হয়ে ঘুরেছেন পুরো দেশ।
নির্বাক অভিনয় দিয়ে সমাজের নানা অসঙ্গতি, শোষণ ও বঞ্চনার কথা মানুষের সামনে সরাসরি তুলে ধরা যায় বলে মনে করেন মাহমুদুল। তরুণ এই মূকাভিনয় কর্মী বাংলানিউজকে বলেন, ‘মাইম আমার ধ্যান-জ্ঞান। মাইমের জগতে দক্ষ কর্মীর মতো কাজ করে দেশবাসীকে মাইমের নির্বাক ভাষার শক্তি ছড়িয়ে দিতে চাই। অভিনয়ের এই নির্বাক ধারায় সংলাপ না থাকলেও আছে দেহ আঙ্গিকের খেলা। ’
বাংলাদেশ সময় : ১৪২০ ঘন্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৪